রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৩৫

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুন ১১, ২০১৯

সব লেখক-কবির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস হচ্ছে, থামতে জানা। সব মানুষের জন্যই অবশ্য থামতে জানা দরকারি। সমর সেন কবিতা লিখেছিলেন বারো বছর। যখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে, সেই সময়েই কবিতা লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কেন বন্ধ করলেন, তা নিয়ে মুখ খোলেননি। বহু বছর পরে (মৃত্যুর দুই-তিন বছর আগে) স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি আর নতুন কিছু লিখতে পারছিলেন না। লিখতে বসলে তা আগের লেখার রিপিটেশন বা পুনরাবৃত্তি হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, তিনি নিজেই নিজের লেখা থেকে চুরি করছেন আরেকটি কবিতা লিখতে বসে।

মাহমুদুল হক শেষ গল্প বা উপন্যাস লেখার পরেও শারীরিকভাবে বেঁচে ছিলেন প্রায় বিশ বছর। কিন্তু তিনি আর লেখেননি। এবিষয়ে তিনি সমর সেনের মতো কোনো স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। তবে হয়তো টের পেয়েছিলেন যে, তিনি ফুরিয়ে গেছেন। জোর করে লেখা চালিয়ে গেলে তা হবে তার লেখকসত্তার অবমাননা। তাই আর লেখেননি। হয়তো শহীদ কাদরীর ক্ষেত্রেও কথাটা আংশিক বা পূর্ণ সত্য। এই যে বুঝতে পারা, নিজেকে নিঃশেষিত বলে স্বীকার করে নিতে পারা, এবং তারপরে কলমটাকে সরিয়ে রাখা— এ এক বিরল শক্তির পরিচয়।

অধিকাংশ লেখক-কবিই বুঝতে পারেন না যে, তিনি ফুরিয়ে গেছেন। অভ্যাশবশে লিখে যান গতানুগতিক লেখা। বুঝতেও পারেন না যে, তার লেখা একসময়ের উৎসাহী পাঠককে এখন ক্রমাগত তার প্রতি বিমুখ এবং বিরক্তই করে চলেছে। সম্পাদকরা তার বয়সের কারণে বা অতীত সম্মানের কারণে তার লেখা ছাপতে বাধ্য হন। কিন্তু পাঠক একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেন তার থেকে। দীর্ঘজীবীতা তাই অনেক সময় হয়ে ওঠে কবি-সাহিত্যিকদের জন্য একধরনের অভিশাপই। সবাই তো আর রবীন্দ্রনাথ নন, যিনি মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত নিজেকে নতুন করে নির্মাণ করতে পারেন।

সময় কখনো কখনো মেধাহীন লেখক-কবিকেও অমরত্ব দিয়ে দেয়। যেমন আবদুল গাফফার চৌধুরীর একুশের গানটি। কবিতা হিসাবে মোটেই আহামরি কিছু নয় সেটি। কিন্তু সেই বাহান্নো সালের একুশে ফেব্রুয়ারির গনগনে সময় এবং আলতাফ মাহমুদের সুর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটিকে অমরত্ব দিয়েছে। আবদুল গাফফার চৌধুরীর তো থাকার কথা বাঙালিমাত্রেরই শিরোভূষণ হয়ে। কিন্তু তিনি নিজের হঠাৎ পেয়ে যাওয়া এই সম্মানের গুরুত্বটি বুঝতে পারেননি। নিজেকে নিয়ে গেছেন সংকীর্ণ দলীয় এবং গোষ্ঠীস্বার্থের কানাগলিতে। তার কলামগুলো সুলিখিত। কিন্তু একই সাথে মানুষের মনে তা সন্দেহেরও জন্ম দিয়েছে। কারণ তিনি রেফারেন্স হিসাবে এমন সব ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেন, যারা সবাই মৃত। কেউ তার কথার সত্যাসত্য চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না। মৃত ব্যক্তির পক্ষে তো আর তা করা সম্ভবও নয়। জয়নাল হাজারীর মতো সারাদেশের মানুষের কাছে চিহ্নিত সন্ত্রাস-গুরুকে আওয়ামী লীগে পুনর্বাসনের জন্য তিনি এবং নির্মলেন্দু গুণ যখন জোরালো ভূমিকা নিয়েছিলেন, তখন বইমেলার মাঠে তাদের দুজনকে নিয়ে ব্যাপক হাস্য-কৌতুকে মেতে থাকতেন তরুণ সমাজ। এমন প্রশ্ন এবং আন্দাজি উত্তরও শোনা যেত জয়নাল হাজারীর কাছ থেকে তারা দুজনে কে কত নিয়েছেন। তখন হাজারীর সন্ত্রাসের শিকার সাংবাদিক টিপু সুলতানকে চোখের সামনেই দেখতে পেত সবাই।

অথচ উল্টোপিঠেই আছে হাসান হাফিজুর রহমানের উদাহরণ। একুশের প্রথম সংকলন হাসান হাফিজুর রহমান প্রকাশ করেছিলেন বাড়ির জমি বিক্রি করে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে নাম উঠে গেছে তারও। কিন্তু তা ভাঙিয়ে খেতে চাননি তিনি। দায়িত্ব নিয়েছেন, কাঁধে তুলে নিয়েছেন আরো বড় কাজ। মুক্তিযুদ্ধের দলিল ১৮ খণ্ডে সম্পাদনার গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন তিনি সব ধরনের ডামাডোলের বাইরে থেকে। পুরস্কার, খ্যাতি বা সম্মানকে কাজে লাগাতে জানেন না অনেকেই। বাংলাদেশের প্রথম নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব ড. ইউনুসের অবস্থান কোথায় থাকার কথা ছিল আর কোথায় আছে, তা খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, নিজের কর্তব্যকর্ম ঠিক করে নেবার শক্তিই তিনি অর্জন করে উঠতে পারেননি। তাই পুরস্কারটি তার একার শিরোভূষণ হয়েই থেকে গেছে। দেশের মানুষের কোনো কাজে বা উপকারে আসেনি। অন্যদিকে অরুন্ধতী রায় বুকার-প্রাপ্তির মাধ্যমে সেলিব্রেটি হয়ে সেই পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে পশ্চাৎপদ ভারতবর্ষে একের পর এক সত্য উচ্চারণে কাঁপিয়ে দিচ্ছেন এস্টাবলিস্টমেন্টকে।

সাহিত্যের বাইরেও একই হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা দেখি ইতিহাসে স্থান পেয়ে যাওয়া মানুষদের। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার প্রথম উত্তোলনকারী আসম আব্দুর রব স্বৈরাচারী এরশাদের সহযোগী হয়ে নিজের অবস্থান হারালেন। মুক্তিযুদ্ধে কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে যাওয়া কাদের সিদ্দিকী শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজেকে কোথায় নামিয়ে নিলেন! এখন লোকে তাকে নিয়ে ট্রল করে। এরচেয়ে রব সাহেব বা কাদের সিদ্দিকী যদি রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে কৃষিখামার করে নিভৃত জীবন যাপন করতেন, তাহলে নিজেদের অর্জনগুলো অন্তত কালিমালিপ্ত হতো না।

দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদসহ কয়েকজন ছাড়া আর কেউ আমৃত্যু ‍নিজের সম্মান বজায় রাখতে পারেননি। সিংহভাগ নেতাই স্বাধীনতার পরে আবির্ভূত হয়েছিলেন ভীতিকর খাদক এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকারী হিসাবে। পরবর্তীতে পাল্টিবাজিতেও রেকর্ড করেছেন অনেকে।

১৯৪৭ সালে ভারতবিভাগ বা হিন্দুস্তান-পাকিস্তানের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত সতীনাথ ভাদুড়ী ছিলেন বিহারে কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্মী এবং নেতা। দেশ স্বাধীন হবার পরে নেতাদের পদ-পদবি-মন্ত্রীত্ব পাওয়ার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা দেখে প্রায় নিঃশব্দে সরে এলেন রাজনীতি থেকে। পুরোপুরি মনোনিবেশ করলেন সাহিত্যে। লিখলেন ‘জাগরী’ এবং ‘ঢোঁড়াই চরিতমানস’ এর মতো অসাধারণ উপন্যাস। কেউ বাংলাসাহিত্যের চর্চা করতে গেলে সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্প-উপন্যাস না পড়লে তার সাহিত্যশিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই থামতে জানাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরে আসাটাও কখনো কখনো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক