
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৩৬
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুন ১২, ২০১৯
স্তালিন রোজ সকালে একটা শিশুর মগজের ভুনা দিয়ে নাস্তা খেতেন। সেই জন্য বেছে বেছে শিশুদের ধরে এনে আটকে রাখা হতো ক্রেমলিনের গোপন একটা ঘরে। যাতে কোনো অবস্থাতেই স্তালিনের নাস্তার সময় শিশুর মগজের ঘাটতি না পড়ে। পশ্চিমা বিশ্বের প্রচারণার গুণে এমন কথা বিশ্বাস করার মতো লোকেরও ঘাটতি পড়েনি দুনিয়ার দেশে দেশে। এখানে স্তালিনকে নিয়ে পর্যালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। সেই কাজ অনেকটাই করেছি আমি ‘১৯৯২’ নামের উপন্যাসে। আমি স্তালিনের একটি সমালোচনা করতে চাই এই বলে যে, তিনি বিরোধী দলের কণ্ঠরোধ, লেখকদের লেখার স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে অনেক বড় ক্ষতি করে গেছেন রাশিয়ার সাহিত্যের। এবং সমাজতন্ত্রেরও। অবশ্য স্তালিন এই সেন্সরশিপ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন লেনিনের কাছ থেকে। রোজ লুক্সেমবুর্গের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও লেনিন কমিউনিস্ট বলশেভিক পার্টি ছাড়া অন্য কোনো দলকে কার্যক্রম চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। ভিন্নমতের সকল পত্রিকা নিষিদ্ধ করেছিলেন। এমনকী ম্যাক্সিম গোর্কির পত্রিকাও। অনেকেই সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এইসব বিধিনিষেধের সপক্ষে যুক্তি দাঁড় করান। তবে শেষ বিচারে যে সেগুলো ভুলই ছিল, তা প্রমাণ হয়েছে সত্তর বছর পরে।
রুশসাহিত্যে অসামান্য প্রতিভার মিছিল শুরু হয়েছিল ঊনিশ শতকের শুরুতে। আলেকজান্ডার পুশকিনকেই (জন্ম ১৭৯৯) যদি শুরুর বিন্দু হিসাবে ধরা হয় তাহলে সেই মিছিল ছিল প্রায় দেড়শো বছর ব্যাপী দীর্ঘ। এত এত প্রতিভাবান লেখক-কবির আবির্ভাব ঘটেছে সেই দেড়শো বছরে যে নাম উল্লেখ করতে গেলেই দরকার হবে অন্তত এক ফর্মা পরিসর। রুশবিপ্লবে সাহিত্যিকরাও অংশগ্রহণ করেছিলেন সাগ্রহে। তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন যে দারিদ্র্যমুক্ত শোষণমুক্ত রাশিয়াতে শিল্প-সাহিত্যের প্রবাহ আরো অনেক বেশি প্রাণবান হয়ে উঠবে। কিন্তু দেখা গেল বিপ্লবের পরবর্তী সত্তর বছরে রাশিয়াতে বড় লেখক-কবির তেমন আবির্ভাব আর ঘটেনি। মায়াকোভস্কি, বরিস পাস্তেরনাক, মিখাইল শোলোকভ ছাড়া বিপ্লবপূর্ব সময়ের তুল্য কোনো লেখক-কবির নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। এদের মধ্যে আবার আত্মহত্যা করতে হয়েছিল মায়াকোভস্কিকে। পার্টির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তার ইচ্ছামতো লেখার স্বাধীনতা ছিল না। আলুর উপকারিতা নিয়ে আর কত কবিতাই বা লেখা যায় তার মতো কবির পক্ষে!
বরিস পাস্তেরনাককে লিখতে দেওয়া হয়নি। কেবলমাত্র শেক্সপিয়ার অনুবাদ করেই পেট চালাতে হয়েছে তাকে। ‘ডাক্তার জিভাগো’ উপন্যাসটি রাশিয়াতে প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। প্রকাশিত হয়েছিল বিদেশে। নোবেল পুরস্কার পেলে তা প্রত্যাখ্যানে বাধ্য করা হয়েছিল। অনেকেই বলেন যে বরিস পাস্তেরনাককে যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি, তার কারণ হচ্ছে স্তালিন এবং পাস্তেরনাক, দুজনেরই জন্মস্থান ছিল জর্জিয়ায়। দেশি ভাইকে ধনে মারলেও প্রাণে মারেননি স্তালিন। আন্না আখমাতোভাকে লিখতে দেওয়া হতো না। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হতো। তার স্বামী-সন্তানদের বার বার জেলে পাঠানো এবং এবং এক পর্যায়ে হত্যাও করা হয়। তার রেশনকার্ডসহ অন্যান্য কাগজপত্র কেড়ে নেওয়া হয়। চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। না খেয়ে মরার পথে ঠেলে দেওয়া হয়। আন্না আখমাতোভা যে না খেয়ে মরেননি, তা পাড়া-পড়শিদের কল্যাণে। পড়শিরা গোপনে ভোররাতে তার দরজায় রেখে যেত নানা ধরনের খাবারের প্যাকেট।
রুশবিপ্লবের আগে অনেক ভাষা কেবলমাত্র মুখের ভাষা হিসাবে প্রচলিত ছিল। তাদের বিপ্লবের পরে ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে সেইসব ভাষার বর্ণমালা উদ্ভাবন করা হয়। সবচেয়ে পশ্চাৎপদ জাতি-গোষ্ঠীর মানুষও নিজেদের মাতৃভাষায় একটা পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষালাভের সুযোগ পায়, যা তাদের কাছে ছিল অচিন্ত্যনীয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের সময় পর্যন্ত যে কবি সবচাইতে জনপ্রিয় ছিলেন তার নাম রাসুল গামজাতভ। মুসলমান। এবং তিনি রুশভাষী ছিলেন না। আর সবচাইতে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ছিলেন চেঙ্গিস আইৎমাতভ। তারও মাতৃভাষা রুশ নয়। তারা দুইজনেই এমন ভাষার মানুষ ছিলেন, যাদের ভাষার কোনো লিখিত রূপ বা বর্ণমালা ছিল না রুশবিপ্লবের আগে। তবু এটাই সত্য যে, রুশবিপ্লবের পরে রুশসাহিত্যের উৎকর্ষে ভাটা পড়েছিল।
প্রাসঙ্গিকভাবেই আরেকটি প্রশ্ন এসে যায়। তাহলে মুক্ত দুনিয়ার নেতা, তথাকথিত অবাধ স্বাধীনতার দেশ, কবি-সাহিত্যিকদের স্বর্গভূমি হওয়ার কথা ছিল যে দেশের, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহিত্য কেন উন্নত নয়? ফকনার, হুইটম্যান, হেমিংওয়ে ছাড়া আর কোনো লেখক সেই দেশে কেন জন্মাননি যিনি বিশ্বসাহিত্যে প্রভাব রেখে যেতে পেরেছেন? সেই দেশে কেন পুঁজিবাদের সমালোচনামূলক লেখালেখির জন্য হাওয়ার্ড ফাস্টকে অত্যাচারিত হতে হয়? পল রবসনকে কেন গণসঙ্গীত পরিবেশনার দায়ে মামলা-হয়রানির শিকার হতে হয়? অথবা হালের নোয়াম চমস্কিকে কেন মূলধারার মিডিয়াতে জায়গা দেওয়া হয় না? রাশিয়া-আমেরিকার কথা বলা হলো বাংলাদেশের প্রসঙ্গেই ফিরে আসার জন্য। এখানে সরকার তো বটেই, সরকারের ধামাধরা লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক-টকশোজীবীরা চেঁচিয়ে গলা ফাটান যে বাংলাদেশে এখন পূর্ণ গণতন্ত্র বিরাজ করছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, বছরে সাড়ে চার হাজার বই প্রকাশিত হচ্ছে, অর্ধশত টিভি চ্যানেল আছে, হাজারখানেক দৈনিক-সাপ্তাহিক-মাসিক পত্রিকা আছে, অসংখ্য অনলাইন নিউজ চ্যানেল আছে। অতএব মত প্রকাশের এবং লেখার দ্বার পুরোপুরি অবারিত। এই দাবি অর্ধসত্য। আর অর্ধসত্য মানেই অর্ধেক মিথ্যাও। ৫৭ (৩২) ধারায় জেলখাটা লেখক-কবি-সাংবাদিকরা তার প্রমাণ। নিহত ব্লগাররা তার প্রমাণ। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে ব্লগারদের তো সরকার হত্যা করেনি। আমরাও জানি যে সরকার ব্লগারদের হত্যা করেনি। তবে হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ প্রধান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ব্লগারসহ সব লেখকদেরই বুঝে-শুনে লেখার উপদেশ দিয়েছেন। যা পরোক্ষভাবে হত্যাকারীদের উৎসাহিতই করে।
এখানে লেখকের স্বাধীনতা খুঁটিবাধা ছাগলের মতো। খুঁটি পোঁতা আছে মাঠের মাঝখানে। আর ছাগলের গলায় আছে দড়ি। ছাগল সেইটুকু এলাকা জুড়ে ঘাস খেতে পারবে যতটুকু তার গলার দড়ির বিস্তৃতি। খুঁটি এবং দড়ির সীমানা মেনে নেওয়া ছাগলের মতো সন্তুষ্ট যারা, তাদের হাতে আর যা-ই হোক, উন্নত সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক