রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৪১

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুন ১৯, ২০১৯

প্রত্যেক ধার্মিকই নিজ ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে বিশ্বাস করেন। এই বিশ্বাস না থাকলে কেউ-ই ধর্ম পালন করতেন না। এই শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে মৌলবাদের বীজ। তবে তা সুপ্তই থাকে কোটি কোটি মানুষের জীবনে। শত শত বছরেও প্রকাশিত হয় না বীভৎস রূপ নিয়ে। বিশেষ করে যতক্ষণ না রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্মনেতারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উস্কে দেয় তাদের। যখন এক ধর্মাবলম্বী মনে করে যে অন্য কোনো ধর্মের টিকে থাকার অধিকার নেই; টিকে থাকলেও তাকে থাকতে হবে অধস্তন-আজ্ঞাবহ হয়ে, তখনই সেটি মৌলবাদ। এখন সেই মৌলবাদের যুগ চলছে। কোনো ধর্মই আর পরমতসহিষ্ণু ধর্মনেতাদের অধিনায়কত্বে নেই। এখন সকল ধর্মের নেতারাই কম-বেশি রক্তপিপাসু এবং ধর্মব্যবসায়ী।

পৃথিবীতে প্রথম মৌলবাদী বিধান হচ্ছে বৈদিক হিন্দু ধর্মের চতুর্বর্ণ প্রথা। এই বিধান নিজ ধর্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদেরই শোষণের শিকারে পরিণত করেছিল। এখনো, এই পাঁচ হাজার বছর পরেও তা বহাল তবিয়তে টিকে আছে। এমনকী গান্ধী পর্যন্ত ‘অপরিবর্তনীয়’ বলে মেনে নিয়েছেন এই প্রথাকে।

ইহুদিরা হচ্ছে একমাত্র গোষ্ঠী যারা তাদের ধর্ম এবং জাতিকে পুরোপুরি বিশুদ্ধ বলে দাবি করে। ইহুদির কাছে ইহুদিত্ব কেবল একটি ধর্মই নয়, একটি জাতিত্বও বটে। জাতি সম্পর্কে এমন অবৈজ্ঞানিক ধারণা কীভাবে পোষণ করে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-বাণিজ্যে সবচাইতে অগ্রসর ইহুদি ধর্মের মানুষ, তা বোঝা মুশকিল।

ইহুদি ধর্ম এবং জাতির বিশুদ্ধতার ধারণার প্রবর্তক কিন্তু নবি হজরত মুসা বা মোজেস নন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৭ সালে ইহুদি ধর্মগুরু এজরা এই বিধান ঘোষণা করেন এবং তা ওল্ড টেস্টামেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তখন থেকেই ইহুদি মৌলবাদিত্বের সূচনা। প্রচণ্ড অমানবিক এবং অবৈজ্ঞানিক এই চিন্তাধারাই বোধহয় একসময় হিটলারকে ‘বিশুদ্ধ জার্মান রক্ত’ তত্ত্বের জন্ম দিতে সাহায্য করেছে।

যীশুর জন্মের ১৩০০ বছর আগে ইহুদি ধর্মের প্রবর্তক মোজেস বা মুসা নবির আগমন। ‘মোজেস’ একটি মিশরীয় শব্দ। যার অর্থ ‘পুত্র’। বোঝাই যায় যে, মোজেস ছিলেন একজন মিশরীয়। তার গোত্র ছিল যোসেফ গোত্র। তাদের ভাষা ছিল হিব্রু। এই গোত্র বিভিন্ন কারণে ফারাও সম্রাট দ্বিতীয় র‌্যামেসিসের বিরাগভাজন হয়। এবং সম্রাট এই গোত্রকে ক্রীতদাস হিসাবে ঘোষণা করে সকল নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়। একই সাথে তাদেরকে রাজধানী থেকে দূরে কাদেস নামক মরুদ্যানে নির্বাসনে পাঠায়। মোজেসের নেতৃত্বে যোসেফ গোত্র ফারাও-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিদ্রোহে পরাজিত হয়ে তারা পালিয়ে নীলনদ অতিক্রম করে প্যালেস্টাইনে আশ্রয় গ্রহণ করে। এখানে আগে থেকে অনেক মরুচারী গোত্রের বসবাস ছিল। এখানেই যোসেফ গোত্র স্থানীয় ইসরাইলি গোত্রের সাথে একীভূত হয়ে মোজেস প্রবর্তিত জুডাইজম বা ইহুদি ধর্মের অনুশাসনগুলি পালন করতে থাকে।

সেই সময় প্যালেস্টাইনের সবচেয়ে উন্নত এবং সভ্য ছিল কানান নামক গোত্র। তারাও ইহুদিদের মতোই জিহোভাকে (ঈশ্বর) সর্বশক্তিমান হিসাবে উপাসনা করত। মোজেসের মৃত্যুর পরে যশুয়া ইহুদিদের নেতা হন। তার নেতৃত্বে ইহুদিরা কানানদের ১০টি শাখাকে ইহুদিদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে। ডেভিডের (মুসলিমদের কাছে হজরত দাউদ) সময়কালে প্যালেস্টাইনের দক্ষিণাঞ্চলের আরো তিনটি এলাকা ইসরাইলিদের অধিকারে আসে। মুসলিমরা সকল নবির মাজেজা বা অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করে। হজরত দাউদ সম্পর্কে বলা হয় যে, তার আঙুলে আল্লাহ এমন শক্তি দিয়েছিলেন যে তিনি লোহাকে মোমের মতো গলিয়ে ইচ্ছামতো আকার দিতে পারতেন। বাস্তবে ডেভিডের সময় ইসরাইলিরা লোহার ব্যবহারে অধিকতর দক্ষ হয়ে উঠেছিল। তারা উন্নত যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরি করেছিল লোহা গলিয়ে। তাই বিভিন্ন যুদ্ধে জয়লাভ করা তাদের জন্য সহজ হয়েছিল। ডেভিডের পুত্র সলোমন (মুসলমানদের হজরত সোলায়মান) জেরুজালেম দখল করেন। এবং সেখানেই জিহোভার উপাসনার জন্য প্রথম উপাসনালয় বা সিনাগগ নির্মাণ করেন। বহুবার ধ্বংস এবং পুনর্নির্মাণের পর সেটাই এখন বায়তুল মুকাদ্দাস নামে পরিচিত।

এই সলোমন বা হজরত সোলায়মান নিজেই কিন্তু ইহুদি জাতি এবং ধর্মের বিশুদ্ধতার দাবির বিপক্ষে সবচাইতে বড় একটি প্রমাণ। কারণ সলোমনের মাতা ইহুদি ছিলেন না। ছিলেন ডেভিডের সৈন্যদলের একজন সৈনিকের স্ত্রী। তার রূপে পাগল হয়ে ডেভিড সেই রূপসীর স্বামীকে একটি ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধে প্রেরণ করেন। সেই যুদ্ধের নকশা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে, যুদ্ধে ডেভিডের সৈন্যদল জয়লাভ করলেও উক্ত নারীর স্বামীর মৃত্যু ঘটে। এরপর ডেভিড সেই বিধবা সুন্দরীকে বিয়ে করেন। এবং তার গর্ভেই সলোমনের জন্ম হয়। অর্থাৎ ইহুদি রক্তের বিশুদ্ধতার দাবি এই সলোমনেই নিরর্থক বলে প্রমাণিত হয়। সলোমনের মৃত্যুর পরে ইসরাইলিরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি শুরু করে। ফলে ইসরাইল দুইভাগে ভাগ হয়ে দুটি ছোট সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। একটির নাম ছিল কিংডম অফ ইসরাইল, যার রাজধানী ছিল সামারিয়া। অপরটি কিংডম অফ জুডা, যার রাজধানী জেরুজালেম। জুডাইজম বা জায়নবাদ শব্দটি এসেছে এই জুডা থেকে। আর জেরুজালেম নামটি এসেছে জিয়ন পর্বতের নাম থেকে।

ইহুদিরা ব্যাবিলনের সম্রাট নেবুচেদনেজারকে নানাভাবে বিরক্ত করছিল। শাস্তি হিসাবে ব্যাবিলনের সম্রাট পুরো ইসরাইল দখল করে নেন খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে। সলোমনের সিনাগগ ধ্বংস করা হয়। জেরুজালেম নগরীকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়। আর ৭ হাজার ইহুদি নরনারীকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় ব্যাবিলনে। সেখানে তাদেরকে ভূমিদাস হিসাবে কাজ করানো হতো। মালিকরা ভূমিদাসীদের শয্যাসঙ্গিনী করার পাশাপাশি তাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের অধিকার সংরক্ষণ করত। ফলে ব্যাপক রক্তসংমিশ্রণের ঘটনা ঘটে যায়। (প্রকৃতপক্ষে হেলেনীয় শাসনামলে জুডা এবং ইসরাইল এক হাজার বছর রোমের সম্রাটের অধীনে থাকার সময়েও রক্তের ব্যাপক সংমিশ্রণ ঘটে ইহুদিদের মধ্যে।)

১৪২ বছর পরে সম্রাট সাইরাস ব্যাবিলন দখল করার পরে দয়াপরবশ হয়ে ১৭০০ জন ইহুদিকে জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেন। রাব্বি (ধর্মনেতা) এজরা এবং ইহুদি দলনেতা নহিমীয়ার নেতৃত্বে তারা ফিরে আসে জেরুজালেমে। এজরা নিজেকে দাবি করতেন মোজেসের ভাই হারোনের (হজরত হারুণ) সপ্তদশ অধস্তন পুরুষ বলে। এখানেই এজরা ঘোষণা দেন যে ইহুদি রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে। অন্য ধর্মের বা জাতির স্ত্রীদের গর্ভে যে ইহুদি পুরুষরা সন্তান উৎপাদন করেছে, সেই স্ত্রী-সন্তানদের তারা ত্যাগ করবে। যে ইহুদি রমণীরা অন্য ধর্মের পুরুষের সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে তারা সেই স্বামী-সন্তানদের ত্যাগ করবে। এই সময়েই অর্থাৎ মোজেসের মৃত্যুর ৭৬৩ বছর পরে তার বাণী বা ওল্ড টেস্টামেন্ট (মুসলমানদের ভাষায় তাওরাত, যা হজরত মুসার ওপর নাজিল হয়েছিল তুর পাহাড়ে) লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়।

শ্রুতি থেকে লিখিত আঙ্গিক দেবার সময় পরিত্যক্ত নর-নারী-সন্তানদের সম্পর্কে এজরার একটি ঘোষণা সন্নিবেশিত করা হয় ওল্ড টেস্টামেন্টে, ‘তাহাদের শান্তি ও মঙ্গলের চেষ্টা কখনও করিবে না’। সেই সময় থেকেই বোধহয় ইহুদি মৌলবাদের ভয়ঙ্কর প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক