
পুলিশের হাতে আটক ক্ষুদিরাম
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৪২
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুন ২১, ২০১৯
অধ্যাপক আহমদ শরীফ বলতেন, ‘আমার সাহসের উৎস নিহিত আছে আমার বৈষয়িক-সামাজিক-পারিবারিক ক্ষতি মেনে নেয়ার মানসিক শক্তির মধ্যে। সাহসী কথা বলতে গেলে বা কাজ করতে গেলে নিজের কিছু ক্ষতি তো স্বীকার করতেই হবে।’ দুষ্কৃতিকারীদের যে কোনো সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা মানেই হচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির সাথে একধরনের সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া। কারণ কোনো সিন্ডিকেটই রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না। আপনি সেই অপশক্তির বিরোধিতা করবেন আর রাষ্ট্র আপনাকে কোলে তুলে আদর করবে, এমনটা তো হতে পারে না। রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতাসীনরা যেসব যুক্তি দিয়ে নিজেদের অপকর্মগুলোকে জায়েজ করিয়ে নিতে চায়, আপনি সেইসব যুক্তিকে পাল্টা অমোঘ যুক্তি দিয়ে ধূলিস্মাৎ করে দেবেন, আর রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবী-টেকনোক্র্যাটরা সেই অপমান ভুলে যাবে, এমনটি তো আপনি আশা করতে পারেন না। অতএব আপনি কোনো-না-কোনো ভাবে শক্তিমানদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এমন মানসিক প্রস্তুতি আপনাকে রাখতে হবে।
সরকারের যে কোনো কথায় বা কাজে দুইহাত তুলে সমর্থন জানানোর মতো বুদ্ধিজীবীর অভাব নেই। কোনো কালেই ছিল না। সেই বুদ্ধিজীবীরা বলবেন যে কিছু অনিয়ম সত্ত্বেও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের ভোট ভালোই হয়েছে। কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ। তবে শেষ পর্যন্ত ভালোই। কিন্তু আপনি যদি ঘোর সত্যিকথাটা বলে ফেলেন যে, ‘স্বাধীনতার পরে এই একটিমাত্র ভোট হয়েছে যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশই নেই। কারণ ভোট হয়ে গেছে আগের রাতে’ তাহলে সরকার ও বেচারা সরকারি বুদ্ধিজীবীদের তো আপনার প্রতি ক্রোধান্বিত হবারই কথা। দেশের কোটি কোটি লোক চোখ বন্ধ করে থাকল, আমরা চোখ বন্ধ করে থাকলাম, আর তুমি কেন চোখে মরিচ ডলে ঘুম তাড়িয়ে রাখো? এসেছে শালা এক মহামানব!
প্রত্যেক বছর বাজেট নিয়ে দেখা যায় দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া। একদল বলবে বাজেট হচ্ছে উন্নয়নের। আরেক দল বলবে বাজেট হচ্ছে গণবিরোধী। ১৯৭৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই দুইয়ের বাইরে কোনো কথা নেই। কখনো আওয়ামী লীগ বাজেটকে একধরনের আখ্যা দেয়। কখনো আওয়ামী বিরোধীরা সেই একই আখ্যা দেয়। ১৯৭৩ সালে থেকে দুইটি প্রেস রিলিজ লিখে রাখা আছে। শুধু সন-তারিখ আর নিচের স্বাক্ষরকারীর নাম বদল হয়। আর বাদবাকি একই থাকে। এই দুই প্রেস রিলিজই যে অন্তঃসারশূন্য, বুলিসর্বস্ব, গতানুগতিক চিন্তার মানুষদের তৈরি তা ভেবে দেখার অবসর ও ইচ্ছা এখন আমাদের লেখাপড়াজানা মানুষদের নেই। বর্তমানের সরকার প্রচারমাধ্যমের একচেটিয়া সুবিধা গ্রহণ করে প্রচার করতে থাকবে এই বাজেটে ৮৯ লক্ষ মানুষকে মাসিক ভাতার মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। সত্যসত্যই আনা হয়েছে। আপনি একথা স্বীকার করবেন। কারণ বাজেট আপনি পড়েছেন। সরকারি বুদ্ধিজীবীদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে আপনার এই স্বীকারোক্তির কথা জেনে। কিন্তু আপনি যখন বলবেন, এই ভালো অধ্যায়টির পাশাপাশি খুব কালো একটি অধ্যায় আছে বাজেটে, সেকথা শোনামাত্র মুখ অন্ধকার হয়ে যাবে তাদের। তারা বলবে, আপনি সরকারের ভালো কাজ চোখে দেখতে পান না। এটি যে মিথ্যা অপবাদ তা একটু আগের উদাহরণ থেকেই পরিষ্কার। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে ৮৯ লক্ষ মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আপনি তো প্রশংসা করেছেন বাজেটের। কিন্তু যখন আপনি বলবেন কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ বাজেটে রাখা হয়েছে তা আমাদের সংবিধানের স্পিরিটের পরিপন্থি, তখন তারা হা রে রে করে তেড়ে আসবে।
কালো টাকা জিনিসটা কী? যে টাকা মালিক কীভাবে কোত্থেকে উপার্জন করেছে তার হদিস দিতে পারে না, বা দিলে অপরাধী হিসাবে প্রমাণিত হবে, সেটাই তো কালো টাকা। গত দশ বছরে বেশিরভাগ কালো টাকা কীভাবে এসেছে মালিকদের হাতে? এসেছে ব্যাংকলুটের মাধ্যমে, পদ-পদবির সুযোগ নিয়ে ব্যাপক ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে, মানুষের সম্পত্তি দখল করে নেবার মাধ্যমে, শেয়ার বাজার লুটের মাধ্যমে, বিদেশিদের হাতে দেশের সম্পদ তুলে দেওয়ার কমিশন হিসাবে।
বাজেটের প্রস্তাব অনুসারে, এই অবৈধ টাকার একটি অংশ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার মাধ্যমে বাকি টাকাগুলো সাদা হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাট-হলমার্ক কেলেঙ্কারি, শেয়ার কেলেঙ্কারি— সব বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে। সরকারের যুক্তি হচ্ছে, এই টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে তা দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, এবং কল-কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগ হবে। ফলে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। অতীতেও এই একই যুক্তিতে বার বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সেই টাকা কি বিনিয়োগ হয়েছে দেশে? নাকি প্রতিবছর গড়ে ৭০ লক্ষ কোটি টাকা করে পাচার হয়ে গেছে বিদেশে? মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, কানাডায় বেগম পাড়া, আমেরিকায় বেগম পাড়া, এমনকী ভারতেও নানা নামে ফ্ল্যাট-সম্পত্তি-ব্যবসার পার্টনারশিপ কিনে রাখা হয়েছে সেই পাচারকৃত টাকা দিয়ে।
আমাদের দেশে এখন মধ্যবিত্ত তো বটেই, নিম্নবিত্ত স্বল্পশিক্ষিত মানুষরাও সন্তানকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। শিক্ষার মাধ্যমে সন্তান একটি মর্যাদাজনক স্থান লাভ করবে, সমাজে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, এমন আশা প্রতিটি পিতা-মাতার। পাশাপাশি এটাও আশা করেন সবাই যে সন্তান শিক্ষিত হয়ে উপার্জন করতে শুরু করলে নিজের পাশাপাশি তার বাপ-মা-ভাই-বোনদেরও দেখতে পারবে। সেই কারণে পিতা-মাতা নিজেদের অনেক স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে, অনেক প্রয়োজনীয় খরচ বাঁচিয়ে, নিজেদের ওপর বাড়তি চাপ নিয়েও সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলতে চান। সংসারের অন্য খাতে কৃচ্ছতা সাধন করে সন্তানের শিক্ষার জন্য টাকা ব্যয় করেন অকাতরে। অর্থাৎ সকল পিতা-মাতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে শিক্ষা হচ্ছে তার সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। পৃথিবীর সকল উন্নত এবং অনুন্নত দেশও সেই একই উপলব্ধিতে পৌঁছেছে যে মানসম্মত শিক্ষাই হচ্ছে জাতির জন্য শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। আমাদের দেশের সব সরকারের সব স্তরের হোমড়া-চোমড়ারা শিক্ষার উন্নতির কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। কিন্তু বাজেটে আমরা কী দেখছি? দেখছি জিডিপি-র মাত্র ২.০৮ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে শিক্ষাখাতে। এমনকী যুদ্ধআক্রান্ত সুদান বাদে আফ্রিকার অন্য দেশগুলিতেও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ এরচেয়ে বেশি। তারপরেও কি সন্তুষ্টি বজায় থাকবে বাজেট নিয়ে?
আহমদ শরীফ এবং তার মতো কিছু মানুষ এই ফাঁকিগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরতেন, ধরেন, ধরবেন। তাতে যে খুব একটা ফলাফল পাওয়া গেছে তা-ও নয়। সরকারগুলো গায়ের জোরে বা তাদের ডুগডুগিবাদকদের দিয়ে মগজ ধোলাই-এর মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে জনসাধারণকে। তবু আহমদ শরীফদের উত্তরসূরিরা আওয়াজ জারি রাখেন। ফলাফলটা বোঝা যাবে কোনো এক ভবিষ্যতে। ২০, ৩০, ৫০ বছর পরে হলেও এইদেশে সত্যিকারের ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। সেই সময়কার প্রজন্ম ইতিহাস পর্যালোচনা করতে বসে আবিষ্কার করবে, তাদের পূর্বপুরুষদের সবাই আপসকামী, সুবিধাবাদী বা মেরুদণ্ডহীন ছিল না। কেউ কেউ অন্তত ছিলেন ক্ষুদিরাম-সূর্যসেন-প্রীতিলতা, বাহান্নোর শহীদ, একাত্তরের শহীদদের মতোই সত্যের শহীদ। তখনকার প্রজন্ম এখনকার শক্তিমানদের নিয়ে নয়, গর্ব করবে ঝুঁকি নিয়ে সত্য বলার সাহস যারা করেছেন, তাদের নিয়ে। এটাই ঘটবে। ক্ষুদিরামকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানোর ব্যবস্থা করেছিল যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইংরেজ বিচারক ও উকিল-পুলিশরা, তাদের নাম ইতিহাসের আস্তাকুড়ে চলে গেছে। অমর হয়ে আছে ক্ষুদিরামকে নিয়ে লেখা গীত, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি! চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক