রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৪৩

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুন ২৩, ২০১৯

সাম্প্রদায়িকতাকে আমি একটি মারাত্মক মানসিক রোগ বলে মনে করি। সেই রোগীর সংখ্যা এখন সুস্থ মানুষের তুলনায় এতই বেশি যে সুস্থ মানুষরাই এখন উল্টো রোগী বলে চিহ্নিত হয়। ভারতে হিন্দুত্ববাদ যে পুরোপুরি ক্ষমতায় আসন গেড়ে বসবে, এটি প্রায় নিশ্চিতই ছিল। আফগানিস্তান যদি গোঁড়া মুসলমানের দেশ হয়, পাকিস্তান যদি ইসলামি জামহুরিয়াত হয়, বাংলাদেশ যদি মদিনা সনদে পরিচালিত হয়, সেক্ষেত্রে ভারত এত উন্নতমানের মানুষের দেশ নয় যে, তা হিন্দু ভারতে পরিণত হবে না। হয়েছে। কেউ কেউ বলবেন যে, ভারতে সংবিধানে এখনো ধর্মনিরপেক্ষতা রয়েছে। সে তো বাংলাদেশের সংবিধানেও শব্দ হিসাবে রয়ে গেছে। বরং ভারতের অনেক আগে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সন্নিবেশিত হয়েছিল। সেই ১৯৭২ সালেই। কিছু ত্রুটি থাকলেও আমাদের বাহাত্তরের সংবিধান ছিল এশিয়ার শ্রেষ্ঠ সংবিধান। কিন্তু কাজে তো আমরা লাগাতে পারিনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়েও না।

১৯৪৭-এর দেশভাগ যে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান নয়, তা মওলানা আজাদের মতো নেহরু-প্যাটেল-জিন্নাহও জানতেন। আবার দ্বিজাতি তত্ত্বের একমাত্র প্রবক্তা যে জিন্নাহ নন, সেটাও এখন ইতিহাসে প্রমাণিত। জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্ব ঘোষণা করেছিলেন ১৯৪০ সালে লাহোর অধিবেশনে। অন্যদিকে ১৯২৩ সালেই সাভারকর ‘হিন্দু’ একটি ভিন্ন জাতি বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। লালা লাজপৎ রায় ১৯২৩ সালে তার পত্রিকায় পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেন যে, ভারতের হিন্দু এবং মুসলমান দুই ভিন্ন জাতি। জিন্নাহ এই দ্বিজাতি তত্ত্বকে ট্রাম্পকার্ড হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি তুললে কংগ্রেস বাধ্য হবে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য অর্থনীতি ও শিক্ষার পরিসর বাড়াতে। কিন্তু নেহরু-প্যাটেল যে আগেই সেই ভারত ভাগের জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে আছেন, তা জিন্নাহ ধারণা করতে পারেননি। প্যাটেল ‘মুসলিম লীগের জন্য একটুকরো জমি ছেড়ে দিতে’ নেহরুকে রাজি করিয়েই রেখেছিলেন। গান্ধী সকালে ভারতভাগের বিরোধিতা করেন, আবার সন্ধ্যায় বিড়লাদের প্ররোচনায় ভারতভাগকে সমর্থন জানান। শেষ পর্যন্ত তিনিও সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগে চূড়ান্ত সম্মতি জানালেন।

বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তান অর্জিত হয়েছে এই বাংলাদেশের মুসলমানদের ভোটে। জানি না তখন বাংলার মুসলমানরা পাকিস্তান প্রস্তাবে ভোট দিয়েছিল নাকি মুসলিম লীগকে বাংলার সরকার গঠনের জন্য ভোট দিয়েছিল। তাছাড়া তখন ভোট দিতে পারত কেবল তারাই যারা কমপক্ষে বার্ষিক ৫টাকা খাজনা দিতে পারত ব্রিটিশ সরকারকে। সেই ৫টাকা খাজনা প্রদানের সামর্থ্য কি সাধারণ চাষী-মজুর, দিন আনা দিন খাওয়া মুসলমানের ছিল বাংলাতে? থাকলে কত পার্সেন্ট? এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না। সবই চেপে যাওয়া হয়েছে। এসব নিয়ে গবেষণা হওয়া খুব দরকার। আর গবেষণা দরকার ঠিক কারা ইন্ধন জুগিয়ে মূল ভূমিকা পালন করেও আড়ালে থেকে দাঙ্গা বাঁধিয়েছে সেইসময়। সেই দাঙ্গাকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করেই বাংলাভাগ। দাবিটা উঠেছিল শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু সমাজের তরফ থেকেই। কলকাতায় ঘনশ্যাম দাস বিড়লার বাড়িতে মিটিং হতো হিন্দু বিদ্বান এবং বুদ্ধিজীবীদের। বাঙালি মুসলমানের কোনো বুদ্ধিজীবী সমাজ তো তখনো গড়েই ওঠেনি। ঢাকাকেন্দ্রিক শিখা গোষ্ঠীর কোনো রাজনৈতিক প্রভাব ছিল না। ছিলেন কেবলমাত্র আবুল হাশিম। তিনি শরৎ বসুকে সামনে নিয়ে চেষ্টা করেছেন বাংলাবিভক্তি রোধ করতে। বামপন্থিরা বলেন, পশ্চিমবঙ্গে ততদিনে টাটা-বিড়লা-বাজাজরা ব্যাপক ইনভেস্ট করেছে। (পূর্ববঙ্গেও লতিফ-বাওয়ানীরা শুরু করেছে)। অবিভক্ত স্বাধীন সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ বাংলা হলে টাটা-বিড়লাদের ব্যাপক ক্ষতি। আর গান্ধী থাকতেনই তো বিড়লাদের বাড়িতে। তিনি মত দিলেন বাংলাভাগের। পশ্চিমবঙ্গ চলে গেল ভারতের মধ্যে। আমাদের পূর্ববাংলা হলো পাকিস্তানের অংশ।

আজ এতদিন পরেও মনে হয়, অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারত না। তা হয়নি। তবে আমাদের পূর্বপুরুষরা যে পাকিস্তানের সাথে যোগ দিয়েছিলেন, সেইটা অন্তত মন্দের ভালো হয়েছিল। কারণ পাকিস্তান নামক অস্বাভাবিক রাষ্ট্রটি টিকে থাকার কথা নয়। থাকেওনি। ফলাফল হিসাবে আমরা পেয়েছি হাজার বছরে বাঙালির একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। অস্বাভাবিক মূল্য দিতে হয়েছে আমাদের। তবে পেয়েছি। ভারতের অংশ হলে আমরা কোনোদিনই হয়তো স্বাধীন হতে পারতাম না। স্বাধীনতার স্পৃহাই হয়তো মুছে যেত মন থেকে। হিন্দি বলয়ের পদানত হয়ে জীবন যাপন করতে হতো আমাদের। বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-কৃষ্টি হুমকির মুখে পড়ত।

তবে আমাদের দেশটাকে যে আমরা এতদিনেও মনের মতো করে গড়তে পারিনি তার কারণ হচ্ছে সবসময় যাদের শাসনে আমরা থেকেছি, তারা দেশপ্রেম, সততা দিয়ে দেশটা পরিচালনা করেনি। পাকিস্তানের ২২ পরিবারকে উৎখাত করে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু ২২ পরিবারের জায়গায় তৈরি করা হয়েছে ৪৫ হাজার পরিবার। সবকিছু ঘটে এই ৪৫ হাজার পরিবারের স্বার্থকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু এই কথাও সত্য যে, আমাদের দেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে অবশ্যই একদিন হাতবদল ঘটবে। ক্ষমতাসীন দল শুধু নয়, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীটারই বদল হবে। আমরা আমাদের দেশটাকে নিজেদের স্বপ্নের মতো করে গড়ে নিতে পারব।

সাম্প্রদায়িকতা দূর না হয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে ভারতে-পাকিস্তানে-বাংলাদেশে। বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে সংখ্যালঘু হিন্দুরা যে ভারতে যায়, তার কারণ ভারত আছে বলেই, তাদের যাওয়ার একটা জায়গা আছে বলেই। ভারতের আয়তনিক বিশালতা, ভারতে সব ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য উদ্বাস্তু মানুষদের জায়গা করে দিতে পারে। কিন্তু ভারতের সংখ্যালঘুদের তো অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই তারা সব অত্যাচার, নিপীড়ন, মানসিক নির্যাতন ও ঘৃণা সহ্য করেও পড়ে থাকতে বাধ্য হয় ভারতেই। বাংলাদেশে যেমন দাঙ্গা হয় না। হয় একতরফা হিন্দু নির্যাতন। আবার ভারতেও একই ঘটনা। বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের অব্যাহত দেশত্যাগের ফলে এখন সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৯ বা ১০ শতাংশ। তবে এর মধ্যে একটি আশার দিক হচ্ছে ৯ শতাংশ হিন্দু বাংলাদেশের সরকারি চাকুরিতে বড়-ছোট মিলিয়ে আছে ১২ শতাংশের বেশি পদে। কিন্তু ভারতে ২৫-৩০ শতাংশ মুসলমানদের মধ্যে সরকারি চাকুরিতে আছে খুব বেশি হলে ২ শতাংশ। যুক্তি হিসাবে বলা যেতেই পারে যে সেখানকার মুসলিমরা শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে, তাই তারা সরকারি চাকুরিতে ঢুকতে পারে না। পাল্টা একটা প্রশ্ন তোলা যায় যে, সেখানকার মুসলমানদের কি শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে?

এতসব কথা একটা কারণেই বলা যে দেশভাগ এই উপমহাদেশের মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে বাঁচাতে পারেনি। বরং তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তার সাথে আরেকটি কথা বলতে চাওয়া যে, সাম্প্রদায়িকতা একটি রোগ। ‘স্বাস্থ্য নয়, রোগই সংক্রামক’। সংক্রামক রোগ যখন মহামারিতে পরিণত হয়, তখন সীমিত চিকিৎসা দিয়ে কোনো লাভ হয় না। তখন তাকে নির্মূলের পদক্ষেপ নিতে হয়। যেমন নির্মূল করা হয়েছে গুটিবসন্তকে, কলেরাকে। সাম্প্রদায়িকতাকে নির্মূল করার পদক্ষেপই কেবল উপমহাদেশের মানুষকে বাঁচার আশা দেখাতে পারে। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক