রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৪৫

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুন ২৬, ২০১৯

অনেক বিষয়েই অনেকের তুলনায় পিছিয়ে ছিলাম আমি। (এখনো আছি)। তবে কিছু কিছু কাটিয়ে উঠেছি পরে। পিছিয়ে থাকার একটা কারণ হয়তো মফস্বল শহরে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। বাংলাদেশে নগর বলতে তো একটাই। ঢাকা। ঢাকার দিকে চোখ-কান মেলে রাখতাম। শুনতাম, আসলে গিলতাম, ঢাকার গল্প। দুই-চার দিনের জন্য ঢাকায় আসা তো ঢাকায় বাস করার সমান হতে পারে না। তবে, কেবল ঢাকা নয়, আমার সমসাময়িক মফস্বলের তরুণদের তুলনাতেও অনেকখানি পিছিয়ে ছিলাম আমি।

যেমন মেয়েদের সাথে স্বাভাবিকভাবে মিশতে আমার সময় লেগেছে প্রচুর। মেয়েদের আমি চিনতামই না বলতে গেলে। মনে হতো মেয়েরা যেন কল্পলোকের প্রাণী। এখন কারণ খুঁজতে গেলে মনে হয়, সেই সময় সমবয়সী মেয়েদের সাথে আমার ওঠাবসার কোনো সুযোগ ছিল না। আমার বড় বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল নিতান্ত অল্প বয়সে। তখন আমি ক্লাস ফোরের ছাত্র। আমার পরের বোন আমার আট বছরের ছোট। কাজেই বোনও ছিল না যার সাথে কথা বলে সহজ হতে পারতাম। মহল্লার সমবয়সী মেয়েদের সাথে মা মিশতেই দিত না। কারণ যে মেয়েরা সকাল-সন্ধ্যায় কোনো কাজ ছাড়া রাস্তায় বেরুত, আমার মায়ের চোখে তারা ছিল সন্দেহজনক মেয়ে। ভালো মেয়েরা তো লেখাপড়ার জন্য ছাড়া বাইরে বেরুবে না। অতএব তাদের সাথে কথাবার্তার কোনো সুযোগ ছিল না। তদুপরি আমি ছিলাম আবার পুরোপুরি বয়েজ স্কুলের ছাত্র। এসএসসি পর্যন্ত কোনো মেয়েদের স্কুলের সীমানায় যাইনি। আমাদের স্কুলেও কোনো মেয়ের পা পড়েনি। এর মধ্যেও বন্ধুদের কেউ কেউ একাধিক প্রেমের স্বাদ পেয়ে গেছে। তাদের অনেকের প্রেমপত্র লিখে দিতে হতো আমাকে। কারণ কোনো মেয়ে প্রেমপত্র অভিভাবককে দেখালে চিঠিটা যে সেই ছেলেটির হাতের লেখা নয়, এই একটা অজুহাতেই বেঁচে যেত বন্ধু। তার পরেও কোনো কোনো বন্ধুকে তার বাপ প্রকাশ্য দিবালোকে জুতাপেটা করেছে। তাদের কেউ কেউ এখন দেশে খুব সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। নাম বললেই লক্ষ লক্ষ না হোক, হাজার হাজার লোকে চিনবে। আর যাদের প্রেম হতো না, বা মেয়েদের সাথে সখ্য হতো না, তারা আমাকে সান্ত্বনা দিত-- দুঃখ করিস না দোস্তো। প্রেম করা মানে একটা মিয়্যা মানুষের কাছে ছোট হওয়া। আমরা “থাকিতে নিজের হস্ত, হইব না নারীর দ্বারস্থ”। রশিদ ভাই আমাদের এক বছর আগে কলেজে ঢুকেছেন। খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। যে কোনো অঙ্ক করে দিতে বললে তৎক্ষণাৎ করে দিতেন। অন্য কোনো বিষয়ে উত্তর জানতে চাইলে সুন্দরভাবে শিখিয়ে দিতেন। কিন্তু পরীক্ষাতে কী কারণে যেন নম্বর পেতেন কম। টেনে-টুনে ফার্স্ট ডিভিশনটা পেতেন। তবে তিনি প্রেম করতেন ঘন ঘন। তিনি আবার আমাকে সান্ত্বনা দিতেন অন্যভাবে। বলতেন, আর একখান বছর সবুর করো ভাই। তোমাক নিয়া এই টাউনের মিয়্যাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি হবি।

কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। মেয়েদের সামনে পড়লেই আমার হাঁটু কাঁপত। কলেজে মেয়েরা সহপাঠিনী হলো। ক্লাসে তাদের উপস্থিতিটাই ছিল আমার জন্য বিড়ম্বনার। স্যার কোনো প্রশ্ন করলে জানা উত্তর দিতে গিয়েও তোতলাতে থাকতাম অনবরত। ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক করতে দিলে হাত-পা এমনই কাঁপত যে হাতের লেখা কেউ বুঝতেই পারত না। এখন বুঝি, (তখনো বুঝতাম), আমি আসলে নিজেকে নিয়ে খুবই হীনম্মন্যতায় ভুগতাম। কোনো ছেলে বিশেষ কিছু না হলে মেয়েরা তাকে পাত্তা দেবে কেন? আর আমি ছিলাম সবদিক থেকে নিতান্তই সাধারণ। পড়তি পরিবারের সন্তান। খুব সাধারণ পোশাক। লিকলিকে চোয়াল ভাঙা চেহারা। বন্ধুরা বলত, মাডগার্ড বসা।

পরে জেনেছি, চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতা অনেক বড় বড় মানুষেরও থাকে। জ্যাঁ পল সার্ত্রের মতো প্রায় মহামানবও সেই হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। তিনি সিমন দ্য বুভোয়াকে আড়াল করে রাখতে চাইতেন আলবেয়ার কামুর কাছ থেকে। কামু ছিলেন খুবই সুপুরুষ। সিমনকে নিয়ে প্যারিসের ক্যাফেতে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে সার্ত্রে আর কামুর মধ্যে। কামুকে একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না সার্ত্রে। তিনি যে নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তার কারণ হিসাবে নানা ধরনের আদর্শিক এবং রাজনৈতিক বিষয়ের কথা বলা হয়। সেগুলো অবশ্যই কারণ হতে পারে। তবে আমার কেন যেন মনে হয়, কামু যে সার্ত্রের কয়েক বছর আগেই নোবেল পুরস্কার পেয়ে গিয়েছিলেন, সার্ত্রে সেটি মেনে নিতে পারেননি। অন্য কারণের সাথে পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের পেছনে এই কারণটাও যোগ হতে পারে হয়তো। ইয়েটস-ও পারেননি তার আগে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা মেনে নিতে।

তবু পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের মতো আমার প্রেম হয়ে গেল। নিজে থেকে এগুনোর সাহস আমার ছিল না। সম্ভবও হতো না কোনোদিনই। তবু প্রেম হয়ে গেল আমার।

প্রেমের পরেও মেয়েদের সাথে আমার আচরণের জড়তা কাটতে সময় লেগেছে অনেক। এমনকী মেডিক্যাল কলেজে গিয়েও। আমি তখন পুরোপুরি বিশুদ্ধ প্রেমিক। অন্য কোনো মেয়ের সাথে রিক্সায় উঠি না। একা কোনো মেয়ের সাথে বসে চা খাই না। প্রয়োজনীয় কথা চালাচালি হয়, কিন্তু দীর্ঘক্ষণ কারো সাথে গল্প করি না।

জড়তা কেটেছে রাজনীতির সাথে যুক্ত হবার পরে। একটি ছেলে আর একটি মেয়ের মধ্যে প্রেম বা শারীরিক সম্পর্ক ছাড়াও আরো অনেক ধরনের মানবিক সম্পর্ক যে তৈরি হতে পারে, তা নিজেই দেখতে পেয়েছি। পাঠ্যক্রম থেকে জেনেছি, শারীরিক গঠনগত ভিন্নতা ছাড়া নারী আর পুরুষ একই। শারীরিক গঠনের এই ভিন্নতা প্রকৃতি তৈরি করেছে মানবজাতি যাতে টিকে থাকতে পারে সেই কারণেই। প্রাণীজগতটাও একারণেই নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গঠিত।

যখন গল্প লিখেছি, অবশ্যম্ভাবীরূপেই নারী এসেছে গল্পে। লেখার মধ্যে নারীকে যে আলাদাভাবে উপস্থাপন করা দরকার তেমনটি কখনোই মনে হয়নি আমার। কোনো গল্পে নারী খুবই শক্তিশালী, কোনো গল্পে হয়তো ততটা ঋজু নয়। পুরুষের মতোই আমি নারীর মধ্যেও দেখেছি সংগ্রাম, প্রতিবাদ, সাহস, ভীরুতা, সুযোগসন্ধানী ভূমিকা, উদারতা, নীচতা। দেখেছি নারীত্ব নিয়ে বিন্দুমাত্র বাজে ইঙ্গিত দেখলেই বারুদের মতো জ্বলে উঠতে। আবার দেখেছি খুব ছোট কোনো প্রাপ্তির জন্য নারীকে ন্যাকামি, সেক্স অ্যাপিল ব্যবহার করতে। সেটি চোখে, দেহভঙ্গিতে, কণ্ঠস্বরে। দেখে ঘৃণায় গা রি রি করে উঠেছে। তাই নারীগতভাবে কোনো সাধারণ সিদ্ধান্ত আমার নেই যে নারীরা নিচু বা উঁচু। নারীরা ব্যক্তিত্বসম্পন্না হবেই বা উন্নত রুচির হবেই, এমন কোনো নারীবাদী উপসংহারে আমার আস্থা নেই। পুরুষের মতোই নারী প্রচণ্ড নোংরা হতে পারে, আবার খুবই রুচিশীলও হতে পারে। অনেক অফিসে নামাজের জন্য অজু করতে করতে পুরুষ অফিসারকে দেখেছি ঘুষের টাকা জোব্বার পকেটে ঢুকিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত করতে, তেমনই নারী অফিসারকে দেখেছি ঘুষের টাকার বান্ডিল ব্লাউজের ভাঁজে ঢুকিয়ে রাখতে।

পাঠচক্রে জেনেছিলাম মাও সে তুং-এর নারীবিষয়ক চিন্তা। তিনি বলছেন, নারীও পুরুষের মতোই সমাজে শোষিত। মালিক-শ্রমিকের মধ্যে যে শোষক-শোষিতের সম্পর্ক, সেখানে নারী শ্রমিকও পুরুষ শ্রমিকের মতোই শোষিত। তবে নারী দ্বিতীয়বার শোষিত হয় পরিবারের মধ্যে। প্রশিক্ষককে জিগ্যেস করেছিলাম, পরিবারের মধ্যে শোষণ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? শ্রম বিভাজন? পরিবারে নারী একধরনের কাজ করে আর পুরুষ আরেক ধরনের কাজ করে। শিশুরাও কিছু কাজ করে। বৃদ্ধরাও কিছু কাজ করে। কারণ সবার সব কাজে দক্ষতা সমান হয় না। তাই সবাই সব কাজ করে না। কে কোনটা করবে তা আপনাআপনিই নির্ধারিত হয়ে যায়। যদি একজন অপরজনের কাজের মূল্যায়ন করে, অন্ততপক্ষে প্রশংসা করে, তখন তো আর একের অবদান অন্যের অস্বীকার করার বিষয়টি থাকছে না। তাহলে পারিবারিকভাবে শোষণের প্রশ্নটি আসছে কেন? পরিবারে যখন কেউ অক্ষম বা অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন কী অন্যজন তার হয়ে বাড়তি দায়িত্ব পালন করে না? সেদিন তো বটেই, এখন পর্যন্ত আমি এই প্রশ্নের মনঃপুত উত্তরটা পাইনি।

সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ হিসাবে নারীর জন্য ‘পজিটিভ ডিসক্রিমিনেশন’-এর ব্যবস্থা থাকতে হবে, সে ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নেই। কোনো চাকুরির পরীক্ষাতে নারী আর পুরুষ যদি সমান নম্বর পায় তবে নিয়োগ দেওয়া হবে নারীকে, এনজিওদের এই কনসেপ্টে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা মানদণ্ড ব্যবহার করার কোনো উপায় নেই। যেমন সৃজনশীল সাহিত্যচর্চা। নারী লেখকদের একটি সেমিনারে আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেছিলেন, লেখালেখির উৎকর্ষ বিচারের ক্ষেত্রে কে কতটা অসুবিধা মোকাবেলা করে লেখালেখি করেছে তা বিচার্য নয়। বিচার্য একমাত্র লেখাটাই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার বাঁচাতে যুদ্ধ করেছেন প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের সাথে। অন্যদিকে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত হাকিমগিরি করেছেন, বাস করেছেন উচ্চ সমাজে। কিন্তু লেখার বিচারের সময় দারিদ্র্য বা প্রাচুর্য কোনোটাই বিবেচনায় আনা হয় না। বিবেচনায় আসবে কেবলমাত্র লেখার মান। একই ভাবে, নারী কত হ্যাপা সামলে লেখালেখি করছে, তা কেউ বিবেচনায় আনবে না। আনা উচিতও না। বিবেচনায় কেবলমাত্র সেটাই আসবে, যা সেই নারী লিখেছেন, ছেপেছেন, বই আকারে প্রকাশ করেছেন। আপনি বা আমি কত পদের শুটকি ভর্তা করতে জানি, তা পাঠক কখনোই বিবেচনায় নেবেন না। বিবেচনায় আসবে কেবলমাত্র আমাদের সৃষ্টি।

এই জায়গাতে এসে নারী আর পুরুষ পুরোপুরি সমান হয়ে যায়। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক