
সৈয়দ মুজতবা আলী
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৫৩
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুলাই ১২, ২০১৯
সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন কট্টর কমিউনিস্ট-বিরোধী। সেই কারণে বামপন্থীদের কাছে তার রচনার সাহিত্যমূল্য বিন্দুমাত্র কমে যায়নি। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পেয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন, সম্মান পেয়েছেন, শিক্ষকদের কাছ থেকে স্নেহ পেয়েছেন, সাধারণ মানুষেরও ভালোবাসা পেয়েছেন। তাই জার্মান জাতির প্রতি তার ভালোবাসা ছিল ব্যাপক। হিটলারের হত্যাযজ্ঞ, ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে ঘৃণা প্রকাশের পাশাপাশি তিনি ব্যক্তি হিটলারের জীবনযাপনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে কিছুটা সহানুভূতিও আছে বলে মনে হতে পারে। হিটলার ছিলেন প্রচণ্ড সম্মোহনী শক্তির অধিকারী। ব্যক্তিগত জীবনে কঠোর সংযমী। কোনোদিন ধূমপান, মদ্যপান করেননি। নিরামিষ খেতেন। যারা মাংস খায় তাদের হিটলার বলতেন ‘শবাহারী’। স্বজনপ্রীতি তার ছিল না। কোনো আত্মীয়কে কোনো রাষ্ট্রীয় সুবিধা দেননি। চিত্রশিল্পের সমঝদার। নাৎসি বাহিনীর ওপর নির্দেশ ছিল কোনো দেশ দখল করার পরে সেখানকার কোনো চিত্রকর্ম বিনষ্ট করা যাবে না। বরং খুব যত্নের সাথে পাঠিয়ে দিতে হবে বার্লিনে। নারী নিয়ে কোনো বেলেল্লাপনা করেননি কখনো। খুব গোপন প্রণয় ঘটেছিল তার জীবনে দুইটি। তবে কোনো প্রেমিকাকেই তিনি রাষ্ট্রীয় কোনো কাজে নাক গলানোর সুযোগ দেননি কখনো। কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় প্রেমিকাদের কথা কানে তোলেননি। আসলে রাষ্ট্রের কোনো ব্যাপার তার প্রেমিকারা কোনোদিন জানারই সুযোগ পায়নি। কাজেই তার উত্থান এবং পতনের জন্য কোনো নারীর কুমন্ত্রণা বা সুমন্ত্রণাকে দায়ী করার সুযোগ নেই।
কিন্তু গান্ধীর প্রশংসায় সৈয়দ মুজতবা আলী সব সীমা অতিক্রম করে গেছেন। গান্ধীর পিতা-পিতামহ ছিলেন গুজরাটের গন্ধবণিক। আতর-অগুরু-সুগন্ধী ব্যবসায়ী। গন্ধ থেকেই তাদের পদবী গান্ধী। তার সাথে অনেক দ্বিমত সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দিয়েছিলেন। গান্ধীর অসংখ্য ভক্ত আছে। সৈয়দ মুজতবা আলী তাদের মধ্যে একজন হলে আমাদের আপত্তি করার কিছু থাকে না। কিন্তু তিনি যখন বলেন, মহাত্মাজীর মতো মহাপুরুষ এ পৃথিবীতে দ্বিতীয় জন্মাননি তখন এই দাবিটিকে খুব বেশি বলে মনে না হয়ে পারে না। শ্রীকৃষ্ণ, গৌতম বুদ্ধ, যীশুখ্রিস্ট, হজরত মোহাম্মদের সম্মিলিত সাফল্যের তুলাদণ্ডের ধারাবাহিকতায় তিনি গান্ধীকে বিবেচনা করতে চান। এ ব্যাপারে আমি নিঃসংশয় যে গান্ধী শতভাগ অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। সাধারণ মানুষকেও ভালোবাসতেন। যদিও শেষ পর্যন্ত বিড়লা-বাজাজ-কানেরিয়াদের আর উচ্চবর্গীয় মানুষদের স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে গান্ধীর দ্বারা।
মানুষের বিপ্লবী বা বিদ্রোহী হয়ে ওঠার পেছনে অনেক কার্যকারণ থাকে। কেউ কেউ বিপ্লবী হন আজীবনের জন্য, কেউ কেউ হন ঘটনাচক্রে। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি এবং শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ ব্রিটিশবিরোধী হয়েছিলেন আইসিএস পাশ করতে না পারার অপমান থেকে। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির অকালমৃত্যুর কারণে বলা যায় না যে বেঁচে থাকলে তিনি কতদিন বিপ্লবী থাকতেন। কিন্তু বোমা মামলায় জেলে গিয়েই অরবিন্দ ঘোষের বিপ্লবীপনা থমকে গিয়েছিল। ইংরেজ জজ সাহেব ছিলেন তার একসময়ের সহপাঠী। তার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের সাথে আপসরফায় পৌঁছুলেন অরবিন্দ। আর কোনোদিন ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করবেন না মর্মে মুচলেকা দিয়ে তিনি জেল থেকে এবং মামলা থেকে মুক্তি পেলেন। চলে গেলেন ফরাসি অধিকৃত পণ্ডিচেরিতে। বললেন, তিনি ধ্যানের মাধ্যমেই মুক্ত করবেন ভারতবর্ষকে। বিপ্লবী অরবিন্দ হয়ে গেলেন ঋসি অরবিন্দ। এখন তার ফটো সামনে রেখে লোবান জ্বালিয়ে ধ্যান করে লক্ষ লক্ষ ভক্ত। অন্যদিকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আইসিএস পরীক্ষায় পাশ করে সার্টিফিকেটটা মাকে দিয়ে বলেছিলেন— তুমি চেয়েছিলে তাই পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছি এই যে সার্টিফিকেট রইল। কিন্তু আমি ইংরেজদের চাকুরি করব না। বরং এদেশ থেকে তাদের তাড়ানোর জন্য যা করতে হয় তা-ই করব।
গান্ধীও বিলাতে ব্যারিস্টারি পাশ করে সাহেবই হতে চেয়েছিলেন। আইন ব্যবসা করতেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। পোশাকে-আসাকে ছিলেন পুরোদস্তুর সাহেব। কিন্তু গায়ের রঙ পাল্টাবেন কেমন করে? ট্রেনে উঠেছিলেন ফার্স্ট ক্লাসে। উচ্চমূল্যের টিকেট কেটে। কিন্তু সাদা চামড়া ছাড়া অন্যদের ফার্স্ট ক্লাসে ভ্রমণ নিষিদ্ধ। গান্ধীর যুক্তিতর্ক কোনো কাজেই এল না। অপমান করে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাকে নামিয়ে দেওয়া হলো ট্রেন থেকে। সাহেব হবার পথে এই প্রথম ধাক্কা খেলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তার পরেও ভারতবর্ষের রাজনীতির সাথে তার সম্পৃক্ততার কথা জানা যায় না। বরং তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাতেই ‘তলস্তয় ফার্ম’ খুলে তলস্তয়-প্রবর্তিত অহিংস জীবনের চর্চা শুরু করলেন।
সেই গান্ধীকে কে বা কারা ভারতবর্ষের ভাগ্যবিধাতা হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বোম্বাইতে নিয়ে এল, কোন কোন প্রচার-বিজ্ঞাপন-উপায় অবলম্বন করে হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত মানুষের মনে গান্ধীকে ত্রাণকর্তা হিসাবে অধিষ্ঠিত করা হলো, কংগ্রেসের সদস্য না হয়েও সেই দলের সব সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার কীভাবে তার হাতে কেন্দ্রিভূত হলো— এসব নিয়ে কোনো ভালো গবেষণা আমার চোখে পড়েনি। অন্ধভক্তদের কাছে এসব প্রশ্ন তোলাও অনেক সময় ব্লাসফেমির সমতুল্য। তবে এই তথ্য তো স্বীকার করতেই হবে যে গান্ধী চাননি বলে সুভাষ বসু দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়েও কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তাকে কংগ্রেস ত্যাগই করতে হয়েছিল।
তারপরে গান্ধী যেহেতু সাধারণ জীবন যাপন করবেন, তাই সবক্ষেত্রেই তার জন্য ‘অসাধারণভাবে’ সাধারণ ব্যবস্থা করতে হতো। তিনি ছাগলের দুধ খাবেন, তাই যেখানে যাবেন, সাঙ্গে কয়েকডজন দুগ্ধবতী ছাগল নিয়ে যেতে হতো। ট্রেনে তিনি থার্ডক্লাস ছাড়া ভ্রমণ করবেন না বিধায় পুরো ট্রেনটাকেই ভাড়া করে সবগুলো কম্পার্টমেন্টকেই তৃতীয় শ্রেণিতে রূপান্তরিত করে নিতে হতো। এইসব কারণে কংগ্রেসের আরেক বাঙালি সভাপতি বিক্রমপুরের ঠোঁটকাটা মেয়ে সরোজিনী নাইডু বলেছিলেন— গান্ধীজীকে গরিব দেখানোর জন্য আমাদের অনেক টাকা খরচ করতে হয়।
মনে রাখতে হবে সরোজিনী নাইডু ছিলেন কবি। কবিদের সত্য বলার সাহস থাকে, এই কথা তখনো সত্য বলেই বিশ্বাস করত মানুষ। ফলাফল ভালো হয়নি। সর্বভারতীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব থেকে বাঙালিদের চিরতরে দূর করে দিয়েছিলেন গান্ধীর আশীর্বাদপুষ্ট কংগ্রেস নেতারা। আমার মনে ভক্তিপ্রবাহের ঘাটতি আমি নিজেই অনুভব করি। তবে তার জন্য মোটেই অনুতপ্ত নই। বরং অন্ধভক্তি আমার কাছে সন্দেহজনক ব্যাপার। লেখকের জন্য অন্ধভক্তি একটি মানসিক কারাগার। আর অতিভক্তি যে চোরের লক্ষণ তা তো আমাদের আপামর জনগণ জানেই। প্রতি পদেই সেই কথার সত্যতা আমরা দেখতে পাই। এক মিনিট নিজের কথা বলার আগে দশ মিনিট নেতা বা নেত্রীর প্রশংসাগাথা যারা গায়, তাদেরকে বাইরে থেকে আমরা যতই ক্লাউন মনে করে হাসাহাসি করি না কেন, আসলে এরা চরম সেয়ানা পাবলিক। অতিভক্তি যে চোরের লক্ষণ তা যাকে অতিভক্তি দেখানো হচ্ছে তিনিও জানেন। কিন্তু তোষামোদি এমনই এক অব্যর্থ অস্ত্র বা অসুখ, যা ক্ষমতায় আসীন যে কোনো ব্যক্তিকে আক্রান্ত করবেই। তখন তিনি তার সম্পর্কে উচ্চারিত প্রশংসাগুলোকে সত্য বচন বলেই জ্ঞান করতে থাকেন।
অতিভক্তরা মূলত ব্যবসায়ী। জীবিত এবং মৃত ক্ষমতাবান মানুষদের মাজার বানায়। সেই মাজারের মূল খদ্দের অন্ধভক্তরা। তারা হয়তো নিজেদের মা-বাপ-পূর্বপুরুষের কবর জিয়ারত করতে যায় না কোনোদিনই। কিন্তু নেতা-পীর-গুরুর কবরে-সমাধিতে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ অন্ধভক্ত জড়ো হয় জন্মদিনে মৃত্যুদিনে। অন্ধভক্ত সাজা বা অতিভক্ত সাজা আমার দ্বারা হবে না। কোনো সত্যিকারের লেখক-কবিকে দিয়েই হবে না। কারণ অন্ধ মানে তো অন্ধই। পুরোটা না হলেও অনেকটাই তো সে কম দেখবেই। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক