
তাজউদ্দীন আহমদ
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৫৫
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুলাই ১৭, ২০১৯
তাজউদ্দীন আহমদের ‘ডায়েরি ২য় খণ্ড’-র প্রকাশনা উৎসবে আলোচক হিসাবে আহ্বান জানানো হয়েছিল আমাকে। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। খান সারওয়ার মুরশিদ, ড. আনিসুজ্জামান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুল হকদের মতো হেভিওয়েটদের পাশাপাশি বঙ্গতাজ-কন্যা সিমিন হোসেন রিমি কেন যে আমাকে আলোচকদের সারিতে রেখেছিলেন, তা তিনিই জানেন।
এই বইয়ের আগে স্বাধীনতার পরবর্তীকালের ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন মন্ত্রী, নেতা, প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য, সেই সময়কার ঊর্ধ্বতন আমলা, সামরিক অফিসারদের মধ্য থেকে ২১৫ জনের লেখা নিয়ে রিমি আপা একটি সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। সেই বইতে সকলেই একটি কথা লিখেছেন যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বিচ্ছেদের কারণেই দেশে ১৫ আগস্ট এবং পরবর্তীকালের ৪ জাতীয় নেতা হত্যার মতো ঘটনা ঘটানোর বাড়তি সুযোগ পেয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। সোজা কথা তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে, বাকশাল থেকে, দল থেকে, ক্ষমতা থেকে সরিয়ে বঙ্গবন্ধু একটি মহাভুল করেছিলেন।
অনুষ্ঠানে উক্ত লেখকদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। আলোচনার শুরুতেই আমি বলেছিলাম, আপনারা সবাই লিখেছেন যে তাজউদ্দীন আহমদকে দূরে ঠেলে দেওয়ার কারণেই বঙ্গবন্ধুর জীবনে এবং আমাদের জাতীয় জীবনে এই রকম বিপর্যয় ঘটেছিল। অন্তত ঘটার বাড়তি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। এই কথাটা তখন কি আপনাদের কারো মনে আসেনি? নিশ্চয়ই এসেছিল। কিন্তু কেউ-ই তো শেখ মুজিবের কাছে গিয়ে অনুরোধ করেননি তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার।
সবাই মুখ কালো করেছিলেন আমার এই কথাটিতে। আমি কিন্তু তাদের লজ্জা দেবার জন্য কথাটা বলিনি। বলেছি এই দেশে এক ব্যক্তির হাতে সর্বময় ক্ষমতা থাকলে সবাই তার প্রশংসা কারে, তোষামোদ করে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করতে চায় না। তিনি যদি ভেবে নেন তার বুদ্ধিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হচ্ছে, তাহলেই সর্বনাশ। চাকরি থাকবে না। তা সে যত বড় পদের অধিকারীই হোক না কেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তটি থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে এক ব্যক্তির শাসনে। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একজনই। শেখ মুজিব, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া এবং এখন শেখ হাসিনা।
তাজউদ্দীন আহমদ যে আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দল, ক্ষমতার জন্য কনুই মারামারির সংস্কৃতির সাথে অপরিচিত ছিলেন তা নয়। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পর থেকে এইসব কোন্দল প্রতিহত করেই তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। তখন তিনি এইসব করেছেন একটিমাত্র উদ্দেশ্যে। তা হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সফল করতে হবে। দেশকে স্বাধীন করতে হবে। দেশ স্বাধীন হবার পরে তিনি তার দায়িত্ব পালন করা হয়ে গেছে বলে মনে করেছেন। তার নেতার হাতে সব ভার অর্পণ করে পাশে থেকে দেশের জন্য কাজ করে যেতে চেয়েছেন। উপদলীয় চক্রান্তের ধার ধারেননি। কারণ তার সাংস্কৃতিক মান এবং যোগ্যতার সাথে পদের জন্য লালায়িত হবার বিষয়টি যায় না। তাই নীরবে সরে গেছেন।
পঁচিশে মার্চের পরে যত দ্রুত সম্ভব, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। একা যাননি। তখন পর্যন্ত যে কয়জন নেতা, যুবনেতা, ছাত্রনেতা ভারতে পৌঁছুতে পেরেছিলেন, তাদের সঙ্গে নিয়েই গিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী জিগ্যেস করেছিলেন, মুজিবের অনুপস্থিতিতে কে তার প্রতিনিধিত্ব করবেন? তাজউদ্দীন তখন বঙ্গবন্ধুর লেখা একটি চিঠি দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধীকে। কিন্তু উপস্থিত অন্যরা তারস্বরে চ্যাঁচামেচি শুরু করেছিলেন এই বলে যে, এমন কোনো চিঠির কথা তারা জানেন না। উক্ত চিঠি নিশ্চিতই শেখ মুজিবের লিখিত নয়। তাজউদ্দীন সেটি জাল করেছেন। সবচেয়ে বেশি হৈ চৈ করেছিলেন শেখ মনি। বিরক্ত ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, আপনাদের গোলমাল আমি মেটাতে যাব না। যান। নিজেরা গিয়ে আগে ঠিক করে আসুন। তারপর আমাকে জানান যে আপনাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য আমি কী করতে পারি।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই নেতৃত্ব নিয়ে এমন বিপাকে পড়তে হয়েছিল তাজউদ্দীন আহমদকে। তারপরে শিলিগুড়িতে আওয়ামী লীগের এমপি-এমএনএ দের সভায় তাকে কুৎসিতভাবে আক্রমণ করা হয়েছিল। তাজউদ্দীন স্বভাবসুলভ শান্ত ভঙ্গিতে তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ খণ্ডন করেছিলেন। তার নেতৃত্ব আরো সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেটাই শেষ নয়। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি আওয়ামী লীগ আর যুবলীগের নেতারা। ভাড়াটে ঘাতক পাঠিয়েছিল অন্তত দুইবার তাকে হত্যা করার জন্য।
এতকিছু সহ্য করে এবং প্রতিহত করে তাজউদ্দীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদটি রক্ষা করেছেন। মনে হতেই পারে যে, তিনি ক্ষমতার লোভি। কিন্তু বাস্তব ঘটনা অন্য রকম। তাজউদ্দীন যেহেতু সবাইকে চিনতেন, তাই জানতেন, অন্য আওয়ামী লীগের অন্য কেউ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। জাতি এবং ইতিহাস তার কাঁধে যে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে, সেটি তিনি অবশ্যই পালন করবেন। দেশের স্বাধীনতা অর্জন করা পর্যন্ত অটল অটুট থাকবেন। অন্যদের কমিটমেন্ট নিয়ে বাঁকা কথা অনেকই বলা যায়। যেমন, মুজিবনগর সরকার গঠিত হবার পরে সেই সরকারের সবাই শপথ নিয়েছিলেন যে বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তারা নিজেদের পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থাকবেন। যাতে তাদের পুরো মনোযোগ, শক্তি, চিন্তা কেন্দ্রিভূত করতে পারেন মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু এক তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া সকলেই কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে গিয়েছিলেন নিজ নিজ পরিবারের কাছে। শপথটা ছিল তাদের কাছে কেবলমাত্র ফটোসেশন।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাজউদ্দীন আহমদ সেই গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলে তার হাতে সব ভার তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। অন্যরা যখন বঙ্গবন্ধু এবং নিকটজনদের কাছে ধর্না দিচ্ছেন মন্ত্রীত্বের জন্য, পদের জন্য, তাজউদ্দীন নির্বিকার। কারণ তার আত্মবিশ্বাস ছিল। নিজের যোগ্যতার প্রতি আস্থা ছিল। ড. কামাল হোসেন ছাড়া তিনিই ছিলেন আওয়ামী লীগের সবচাইতে শিক্ষিত ও মেধাবী নেতা। এম.ই. স্কলারশিপে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। ম্যাট্রিকে দ্বাদশ। উচ্চ মাধ্যমিকে পূর্ব পাকিস্তানে চতুর্থ। বিশ্বদ্যিালয়ে এম.এ. ডিগ্রি করার পরেও আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন কাপাসিয়া থেকে মুসলীম লীগের ফকির আব্দুল মান্নানকে হারিয়ে। তারপরেও নিয়মিত ক্লাস করতে যেতেন আইন বিভাগে। সেইসাথে ছিলেন কোরআনে হাফেজ। কাজেই যোগ্যতা, সততা, দেশপ্রেম এবং অতীতের অসাধারণ রেকর্ডের জন্যই তিনি থাকবেন দেশের পরিচালকদের একজন হিসাবে। তাই তদবির বা উপদল করার প্রশ্নই আসে না।
কিন্তু তার প্রিয় মুজিব ভাই যখন তাকে সরিয়ে দিলেন সকল পদ থেকে, তিনি কোনো প্রশ্ন না তুলে, কোনো অভিমান প্রকাশ না করে সরে গেলেন। জাসদ তাকে সভাপতি করতে চেয়েছিল। তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৫ আগস্টের পরে তাকে মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদ গ্রহণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ঘৃণাভরে। বিনিময়ে বেছে নিয়েছিলেন নির্মম মৃত্যু। তাজউদ্দীন আহমদকে আমি আমার মতো করে অনুভব করতে পারি। তিনি কঠিন সময়ে হাল ধরেন। তারপর সুসময় উপস্থিত হলে বাদ পড়ে যান। নিরবে সরে যান।
আরেকটি জিনিস প্রমাণিত হয়েছে তাজউদ্দীন আহমদের জীবন থেকে। একক নেতৃত্বের দলে ও সরকারে কোনো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ টিকতে পারেন না। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক