অলঙ্করণ: রিফাত বিন সালাম

অলঙ্করণ: রিফাত বিন সালাম

রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৬৫

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৯

আমরা কি আমাদের বাপ-পিতামহদের চিনি? আমরা কি জানি বাংলাদেশে আমরা কাদের তৈরি করে দেওয়া সাহিত্যভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছি? নামগুলি উল্লেখ করার সময় আমি তাদের রাজনৈতিক পরিচয় মাথায় রাখছি না। আমার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকেও দূরে সরিয়ে রাখছি।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, আবুল মনসুর আহমদ, মুহম্মদ এনামুল হক, প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁ, ফররুখ আহমদ, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, সোমেন চন্দ, বরকতউল্লাহ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, জসীম উদ-দীন, আব্দুল কাদির, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, হাসান হাফিজুর রহমান, আরজ আলী মাতুব্বর, সরদার ফজলুল করিম, শহীদুল্লাহ কায়সার, শওকত ওসমান, আবু ইসহাক, শাহেদ আলী, সৈয়দ আলী আহসান, সিকান্দার আবু জাফর, কবীর চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, আহমদ শরীফ, কুদরত-ই-খুদা, আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন, রাজিয়া খান...।

আরো অনেক নাম এই মুহূর্তে স্মরণে আসছে না। উপরোক্ত লেখক-কবি-চিন্তাবিদগণ এই বাংলার সাহিত্য এবং চিন্তার ভিত গড়ে দিয়ে গেছেন। তারা জানতেন, একটি জাতির জন্য উন্নত সাহিত্য কতখানি দরকার। তারা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, কেউবা সাহিত্যিকদের সৃজনীতে প্রেরণা জুগিয়েছেন।

তাদের সাথে এই যুগের লেখকদের পার্থক্য অনেক বেশি। অনেক দিকে। প্রথম কথা, ইনারা ছিলেন সাধক। জীবনের প্রধান কর্ম হিসাবে এবং একই সাথে দেশসেবার মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন সাহিত্যকে। তারা শুধু লেখালেখি নিয়েই মগ্ন ছিলেন না, একই সাথে নানা ধরনের কাজ করেছেন। সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজ, সাংবাদিকতা, পত্রিকা প্রকাশ, তৎকালীন সরকারের কাজের সমালোচনা, প্রয়োজনে রাজপথে নামা, প্রয়োজনে সরাসরি রাজনীতিতে নামা— সবই করেছেন তারা। কারণ? সাহিত্য নির্মাণের পাশাপাশি একটি নতুন দেশের মানুষের মননশীলতা, রুচি নির্মাণের কাজটিকেও গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছিলেন তারা। সেইসাথে সামাজিক মূল্যবোধ নির্মাণের দিকেও সচেষ্ট ছিলেন সবাই। রাজনৈতিক পথ নিয়ে ভিন্নতা ছিল। কিন্তু শুভ ও কল্যাণবোধের ধারণায় তারা ছিলেন একই কাতারের মানুষ।

বর্তমানের লেখক-কবিদের অধিকাংশই তাদের রচনা এবং কর্মকাণ্ডের সাথে পরিচিত নন। ফেসবুক প্রজন্মের তো প্রশ্নই ওঠে না। এখনকার লেখক-কবিরা মূল্যবোধ, শুভবোধ, দেশপ্রেম, সামাজিক রুচি— ইত্যাদি শব্দগুলোকে খুবই ব্যাকডেটেড এবং অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। তাদের কাছে লেখা হচ্ছে লেখা। তার সাথে দায়বদ্ধতা, মূল্যবোধ অপ্রয়োজনীয় বিষয়। ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নামে তারা নিজেরা যে ব্যক্তিসর্বস্বতার রোগে আক্রান্ত, তা বুঝতে অক্ষম নিজেরা। মানসিক এবং সামাজিকভাবে অসুস্থ রোগীর কাছ থেকে উন্নত সাহিত্য কীভাবে আসবে? তাদের কাছে উল্লিখিত নামগুলো কোনো গুরুত্ব বহন করে না। তবে একটা কথা বলে রাখি। যাদের নাম আমরা স্মরণ করছি, তাদের এক বা একাধিক রচনা বা গ্রন্থ তাদের সময়ের হিসাবে তো বটেই, এখনকার সময়ের মূল্যায়নেও অত্যুৎকৃষ্ট। তাদের সমমানের রচনা বর্তমানের লেখক-কবিদের হাত দিয়ে সৃষ্টি হয়নি।

এখন কেবলমাত্র ঝিলিক-সর্বস্ব লেখার কাল। এনজিওরা যেমন দেশের যে কোনো একটা দিককেই কেন্দ্র করে কাজ চালায়, সার্বিক জাতীয় সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামায় না, বর্তমানের লেখকরাও জীবনের সামগ্রিকতাকে চেনার প্রয়োজন মনে করে না। তাই এনজিওদের ঢক্কানিনাদ যেমন বিদেশি ফান্ড শেষ হবার সাথে সাথে মিইয়ে যায়, এই খণ্ডদৃষ্টির খণ্ডকালীন লেখক-কবিদের রচনাও ফেসবুকের স্ক্রলের তলায় হারিয়ে যায়।

একটি জাতির সবচেয়ে বড় দারিদ্র্য হচ্ছে, চিন্তার দারিদ্র্য। তার সাথে আছে রুচির দারিদ্র্য। বুদ্ধিজীবী বা সাংবাদিক নয়, চিন্তার গভীরতার প্রধান সাধক লেখক-কবিরা। কারণ সত্যিকারের লেখক-কবি মানেই হচ্ছে কোনো-না-কোনো মাপের দার্শনিক, সবচেয়ে সক্রিয় সমাজ-বিশ্লেষক, এমনকী ইতিহাসের নতুন ভাষ্যকারও তারাই। সেই লেখক-কবিরাই যদি সামগ্রিকভাবে দেখতে ভুলে যান, (বর্তমানে আদতে শেখেনই না), তখন অন্যরা তো আরো পিছিয়ে পড়বেই। খণ্ড খণ্ড দেখার উদাহরণ নানা নামের সাহিত্য। নারীবাদী সাহিত্য, ইসলামি সাহিত্য, হিন্দু সাহিত্য, বামসাহিত্য, উত্তরাধুনিক সাহিত্য, দশকওয়ারী সাহিত্য। এই রকম ছোট ছোট বলয় নির্ধারণ করে সাহিত্য করতে গেলে সাহিত্য হয় না, হয় বর্জ্য উৎপাদন। বইমেলায় প্রকাশিত সাড়ে চার হাজার বইয়ের মধ্যে এই রকম বর্জ্য চার হাজার চারশো পঞ্চাশটি। আর ফেসবুক তো বর্জ্যেরই হাট-বাজার। রাস্তাঘাটে চলতে গেলে চারজনের সাথে দেখা হলে তাদের মধ্যে অন্তত একজন পাবেন সাংবাদিক। যোগ্য সাংবাদিক মানেই একজন যোগ্য চিন্তাবিদ। কিন্তু টকশোগুলোতে তাদের চিন্তার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাদের লিখিত কলামগুলির যা ছিরি, তাতে আর যা-ই হোক, চিন্তার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না।

আব্দুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরী, মানিক মিয়া, সিরাজউদ্দীন হোসেন, ওয়াহিদুল হক দূরস্থান, আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মানের একজন কলাম লেখকও জন্মায়নি এই মিডিয়া বুমের যুগে। ফলে জাতির চিন্তার দারিদ্র্য আরো বেড়েই চলেছে। এই চিন্তার দারিদ্র্যের কারণেই রাজনীতিবিদ এবং আমলাতন্ত্র সুযোগ পাচ্ছে জাতিকে অধঃপাতে টেনে নিয়ে যাওয়ার। আর ডিগ্রিধারী-ডক্টরেটধারী মূর্খ মধ্যবিত্ত কেবল ব্যস্ত হয়ে থাকছে ধান্ধাবাজিতে। তারা বই পড়ে না, নাটক দেখে না, সভা-সেমিনারে যায় না, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত হয় না। চিন্তার দারিদ্র্যের কারণেই মানুষের আত্মসমর্পণ। ভোগবাদের কাছে, সুবিধাপ্রাপ্তির কাছে, সমস্ত ধরনের ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছে।

যিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তার জায়গা পূরণের মতো কেউ আসছে না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, শিকদার আমিনুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিম আল দীন, দ্বীজেন শর্মা, রিজিয়া রহমান... । এই নামগুলির পাশে নিজেকে মিলিয়ে দেখুন তো, এদের রচনার তুল্য কিছু লিখতে পেরেছি আমরা? হাঁটুজলে সাঁতার কেটে ভাব নিচ্ছি যেন সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ফেলেছি।

লিখতে লিখতে কোনো শব্দে, ব্যাকরণে, অনুষঙ্গে আটকে গেলে, বা লেখার সময় চিন্তার অস্পষ্টতায় আক্রান্ত হলে আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন এমন যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ তো এখন হাতে গোনা যায়। পাণ্ডিত্য বলতে যা বোঝায় তা এখনো ধারণ করেন বদরুদ্দিন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যতীন সরকার, আনিসুজ্জামান, হাসান আজিজুল হক, হায়াৎ মামুদ, মোহাম্মদ রফিক, আবুল কাশেম ফজলুল হক, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, শামসুজ্জামান খান। ইনাদের সকলেরই বয়স আশি বছরের এদিক-ওদিক।

নিজেরা তো তৈরি হইনি। এই কয়েকজন মানুষের পরে কার কাছে যাব আমরা? চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক