রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৬৮

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৬, ২০১৯

বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করে কারা? কোনো সরকারের আমলেই সরকারি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে বিদেশে কোনো সাহিত্যের অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়নি আমার। তাতে কোনো আক্ষেপ নেই। বরং এটাকেই স্বাভাবিক মনে করি আমি। কারণ গড্ডলিকার বাইরে থাকতে গেলে তার জন্য কিছু মূল্য তো চুকাতেই হবে। তুমি সরকার এবং সরকারি দলের অন্যায়গুলো নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হবে, আর সরকার তোমাকে কোলে কোলে রাখবে, এমন চিন্তা করাটাই বাতুলতা।

আমার কথা থাকুক। বরং একটু দেখা যাক, কারা যান? যাওয়ার সুযোগ পান? সুযোগ করে নিতে পারেন? নামগুলির দিকে তাকালেই বোঝা যায়, তারা সরকারি দলের ছত্রছায়ায় থাকেন। বিভিন্ন সাহিত্য ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে পদ ধারণ করেন, সরকারের ও সরকারপ্রধানের গুণগানে মত্ত থাকেন অহোরাত্র। কেউ কেউ গুণগান কম করেন, তবে তিনি পালন করেন বোবা ও কালার ভূমিকা। সরকার যা করে তা সহি না ভুল তা ভাবা বা বলার কথা কস্মিনকালেও ভাবেন না। বোবার শত্রু নেই।

তবে এটি ভাবার কারণ নেই যে, সরকারের গুণগানে মত্ত বলে তারা সবাই সমমনোভাবাপন্ন। বরং সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য একে অন্যকে ল্যাং মারতে তারা অতিশয় দক্ষ। সেই কাজটি নিরন্তর করেও চলেন তারা।

কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী বাংলা একাডেমির ডিজি হবার আগে কথাচ্ছলে বলেছিলেন, বিদেশের সাহিত্য অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় একাডেমি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে। অনুরোধ করা হয় অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে যোগ্য লেখক বা কবিকে পাঠানোর জন্য। প্রতিষ্ঠানের প্রধান অন্য কারো নাম না পাঠিয়ে নিজেরই নাম পাঠান, এবং নিজেই যান সেখানে। জানি না সিরাজী ভাই নিজে এখন কী করছেন।

বিদেশে বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতিনিধি কে হচ্ছেন তা নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর কথা নয়। কিন্তু ঘামাতে হয়। কারণ এর সাথে বাংলাদেশের সাহিত্যের সম্মানের প্রশ্ন জড়িত। যিনি বা যারা যাচ্ছেন, তারা কি সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য? তারা কি সেখানে গিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিতে পারেন অন্যদের? তাদের ভূমিকা কি বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ও আগ্রহী করে তুলতে পারে বিদেশিদের?

আবার একথাও সত্য যে, বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের বিদেশযাত্রা মূলত ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ প্রবাদের মতো প্রতিবেশী ভারতে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেবার সময় দুই-একজনকে সাথে নিয়ে যান। জাতিসংঘে যে কী ভূমিকা পালন করেন কবি-সাহিত্যিকরা, তা আল্লাই মালুম। জাতিসংঘে কি সাহিত্য নিয়ে কোনো অধিবেশন হয়? অন্য সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথেও কি সেই দেশের কবি-সাহিত্যিক আসেন? দেড় শতাধিক দেশের কবি-সাহিত্যিকরা কি একত্রে ভাব-বিনিময় করেন? কিছুই জানি না আমরা। এই নিউইয়র্কে নিয়ে যাওয়া কি হজ করতে পাঠানোর মতোই আনুগত্যের পুরস্কারমাত্র?

আর একধরনের বিদেশযাত্রা আছে। তা হচ্ছে, ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশি বাঙালিদের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হয়ে যাওয়া। সেই ব্যাপারটি আমন্ত্রণকারীদের ইচ্ছাধীন। তারা যাকে ইচ্ছা আমন্ত্রণ জানাবেন। তবে সেখানেও অনেকক্ষেত্রে লেনদেনের ব্যাপারটি থাকে। আয়োজকদের অনেকেই ভালো সাহিত্যিক নয়, সাহিত্যের ক্ষমতাবলয়ের সাহিত্যিককে চান, যাতে তিনি বিনিময়ে তার দ্বারা দেশে কিছু লাভবান হতে পারেন। সেটি হতে পারে পুরস্কার, হতে পারে গ্রন্থপ্রকাশ, হতে পারে প্রচারণা। এর ফলে সাহিত্যের যতখানি উপকার বা উদ্দীপনা তৈরি হবার কথা, তা ঘটতে পারে না।

বাংলাদেশের সাহিত্যের বিদেশযাত্রা মূলত ভারতযাত্রা, একথা আগেই বলেছি। ইউরোপ-আমেরিকা দূরের কথা, এশিয়ার দেশগুলোর সাহিত্যজগতেও বাংলাদেশের কোনো লেখক-কবির নামই জানা নেই। কোনোদিন কারো নাম আলোচিত হয়, এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এমনকী বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে কোনো আগ্রহও তাদের নেই। বাংলাদেশের একজনমাত্র লেখকের নাম বিদেশিরা জানে। তসলিমা নাসরিন। নির্বাসন এবং বিদেশি প্রচারমাধ্যমে হই চইয়ের কারণে তার নামটি বিদেশিদের গোচরে এসেছে। তারা তাকে কাছে টেনেছে। সহানুভূতি, সমর্থন এবং সম্মাননা দিয়েছে। কিন্তু তার রচনা পাঠ করে নিরতিশয় হতাশ হয়েছে। তারা যদি মনে করে, বাংলাদেশের সমগ্র সাহিত্যের মান এমনই, তাহলে তাদের বেশি দোষ তো দেওয়া যায় না।

এ তো গেল বিদেশের কথা। দেশে কী অবস্থা? দেশের কর্মকর্তারা প্রতিনিধিত্বশীল লেখক-কবি হিসাবে কাদের গণ্য করেন? অবশ্যই ক্ষমতাবলয়ের সাথে সংশ্লিষ্টদেরই। তারা জানেন সরকারের অন্ধ সমর্থক কারা। ভালো এবং সৎসাহসী লেখক-কবিদের খোঁজার মতো বোকামি তারা করতে যাবেন কোন দুঃখে? তাই পাঠ্যপুস্তকেও তাদের লেখাই সন্নিবেশিত হয়, বড় অনুষ্ঠানেও তারাই সামনের সারিতে জায়গা পান। মিডিয়াও তাদের ঢোল বাজাতে বাধ্য। সেই কারণে বিদেশি লেখক-কবিরা যখন বাংলাদেশে আসেন, তাদের সামনে শেয়ালের কুমিরছানা প্রদর্শনের মতো এই কয়েকজনকেই হাজির করা হয়। তখন বিদেশিদেরও ধারণা হয় বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতিনিধি এই মানুষগুলোই। এসবের ফলে লাভ কার হয় জানি না, তবে ক্ষতিটা হয় অনেক বড়। বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে ভুল এবং খণ্ডিত বার্তা পৌঁছে যায় বিদেশে।

পরিস্থিতি বোঝাতে নিতান্ত ব্যক্তিগত একটি বিষয় তুলে ধরছি। এটিকে ‘আঙুর ফল টক’ বলে ভাবাটা আমার প্রতি অবিচার হবে। রাজউকে প্লট পাওয়ার জন্য দেশের যে কোনো নাগরিক আবেদন জানাতে পারেন। লেখকদের জন্য কোটাও আছে বলে শুনেছি। আমি লেখক কোটায় আবেদন করেছিলাম। পাইনি। সেকথা শুনে অনেকেই বলেছিলেন, শুধু লেখার যোগ্যতা দিয়ে রাজউকের প্লট পাওয়া যায় না। আরো অনেক কিছু করতে হয়। সেই অনেক কিছু করার সামর্থ্য বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার নাই। তবে যারা লেখক কোটায় প্লট পেয়েছিলেন তাদের তালিকা দেখেছিলাম। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ছাড়া আর যারা প্লট পেয়েছিলেন তাদের কারো নামই আমি লেখক বা কবি হিসাবে কোনোদিন শুনিনি। অথচ রাজউকের কাছে তারাই বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতিনিধি।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে এখন লেখকদের একটিমাত্র সংগঠনই কাজ করছে বিশ্বজুড়ে। পি.ই.এন. (PEN) । একসময় মার্কিন মদদপুষ্ট সংগঠন বলে এদেশের প্রগতিশীলরা সেই সংগঠনকে এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু এখনকার বাস্তবতায় মৌলবাদবিরোধী এবং নির্যাতিত লেখক-কবিদের পাশে দাঁড়ানোর একমাত্র আন্তর্জাতিক সংগঠন এই পি.ই.এন। কিছুদিন আগে এই দেশের লেখক-কবিদের দুইটি গ্রুপ পি.ই.এন. নিয়ে মুখোমুখি প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। অবশেষে কিছুটা ইংরেজি জানা ধনশালী গ্রুপটি জয়ী হয়েছে। তারা বাংলাদেশের সাহিত্যকে সারা বিশ্বে পরিচিত করানোর জন্য কী কাজ করছেন জানা নেই। তবে মূল যে কাজ, নির্যাতিত লেখক-কবিদের পাশে দাঁড়ানো, সেই ক্ষেত্রে তারা খুব সাফল্যজনক নীরবতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। সারা দেশে লেখক-কবিরা ৫৭ ধারায় জেলে যাচ্ছেন, কেউ কেউ স্থানীয় প্রভাবশালীদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছেন, কিন্তু পি.ই.এন. এর পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি পর্যন্ত আমরা কোনোদিন দেখতে পাইনি।
অথচ আন্তর্জাতিক পি.ই.এন.-এর কাছে এরাই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল লেখক।

বড় বিপদে আছো হে বাংলাসাহিত্য!

লেখক: কথাসাহিত্যিক