রথো রাফি

রথো রাফি

রথো রাফির গদ্য ‘চিন্তাশোধনের চেয়ে অনেক বড় এ জীবন’

প্রকাশিত : মার্চ ২৩, ২০২২

উদ্বেগশূন্য এক জীবনের দেখা, আমিও ভাবি, কোথায় পেতে পারি। আমি শুধু এটুকুই জানি, জানি না। যেমন জানতাম না শৈশব বা কৈশোরে, জানি না তা আজও। ফলে সবটা জীবন এক সন্ধানির নীরস পরিক্রমায় পরিণত হতে চলেছে। এই কী জীবন, জীবনের উদযাপন!

এই যে তারুণ্য পেরিয়ে সূর্যটা ঢলে পড়ছে বিকেলের আকাশে, আর ক্রমে আলোর তেজ কেমন প্রশান্ত উজ্জ্বল ভঙ্গি নিয়ে মাঠে এসে পড়ছে। পড়ছে তো এসে আমার এই জানালার চৌকাঠেও। কিন্তু সে তাপ আর নেই আলোর গাজুড়ে। তবু সন্ধান থামে না।

এই পরাজিত জীবনের অপরাজেয় মনোভাবকে কিভাবে আমি উদযাপন করবো এরপর। এ কি ঠিক শরীরবিহীন এক আত্মার উপাসনার মতো নয়, যা কোনোদিন তার অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য পরনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারে না! কিংবা যার শরীরবিহীন কোনো অস্তিত্বই নেই!

উদ্বেগশূন্য জীবন হয়তো কোথাও নেই, যেমন শরীরবিহীন জীবন। আর এই অনুসন্ধানে রত কোনো কোনো জীবন কল্পনা করে, আদি বুনোজীবন হয়তো সুখে উপচানো ছিল। যদিও সেসময় অসুখ, উদ্বেগ আর লড়াই ছিল সুপ্রচুর, আরো অনেক বেশি প্রবল। আবার কেউ নিজের অতীতে আশ্রয় নেয়। ভুলে যেতে চায় শৈশবও আসলে একইরকম, এখানেও শিশুর বহির্জগতের সাথে একইরকম উদ্বেগ, বুঝে ওঠার রক্তিম লড়াই।

আবার কেউ ভাবে, যেটুকু জীবন বাকি আছে তার কোথাও কোনো ভবিষ্যৎবিন্দুতে তাকে পাওয়া যাবে। তখন হয়তো জীবনকে উদযাপন করা যাবে। সে কিন্তু ভুলতে চায় এক অবিস্মরণীয় শর্ত, ভবিষ্যৎ কোনোদিনই আমাদের ইচ্ছের রূপ ধরে আসে না! আবার কেউ কেউ, না আসলে কেউ কেউ না, অধিকাংশ মানুষই এ জীবনে সে বিন্দুটির দেখা পাওয়া যাবে বলে আশা করে না, করলেও তা খুব ক্ষীণ। তারা বরং ভাবে, জগৎ যেমন সে অনুসারে তার সমস্ত ক্লেশ স্বীকার করে তার বিরুদ্ধে এক শুদ্ধতর জীবন যাপন করে গেলে পরকালে সেই কাঙ্ক্ষিত বিন্দুটির দেখা পাওয়া যাবে। হায়, তারা এই বিন্দুটিকে বিদায় দিয়েই বসে থাকে নিজেদের অজ্ঞাতে, এমনকি নিজের জীবন থেকেই।

মানব ইতিহাসে যা নেই, ব্যাক্তির অতীতে এবং ভবিষ্যতেও যা নেই, তা কেন আমি সন্ধান করছি! একে কি অনুসন্ধান বলে, নাকি গোয়ার্তুমি! আমি হয়তো এক বোকাগোঁয়ার, যার হয়তো এ ক্ষেপামোতেই, এই অস্থির অধীর উদ্বেগের ভেতর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘামঝরানো বোকাচিন্তাতেই এক সমাধানহীন শান্তি! যে শান্তির স্বাদ নোনা ও তিক্ত। এবং মূর্খতাকে যুক্তির ব্যর্থতার ঊর্ধ্বে ধরে রাখার শিশুকালীন এক বদ-অভ্যাস।

এও তেমনি, সেই শিশুর চাওয়ার মতোই, যেমন মায়ের কাছে যার সব দাবিই যৌক্তিক হোক, না হলেও তার চাওয়া পূরণ হোক, যেমন একদিন হতো, এই শুধু চাওয়া, যখন কিনা তার একটু কেঁদে ওঠা ছাড়া আর কোনো অবলম্বন জানা ছিল না। কিংবা যেমন নৈঃশব্দ্যশাসিত গর্ভে একদিন সব চাওয়া পূরণ হতো, না চাইতেই, এমন কি যখন কেঁদে ওঠার অবলম্বন গ্রহণের প্রয়োজনও তার ছিল না। সেই বিস্মৃত অধ্যায় থেকেই হয়তো উঠে আসে এই প্রেরণা, এই গোয়ার্তুমি। এই বিকেল বয়েসে। কিংবা দাবি পূরণ না হলে যেমন শিশু তার মায়ের উপর চড়াও হয়, রেগে ওঠে বা কান্নাকটি করে করে ধূলোয় এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে এবং ঘুম থেকে উঠে আবার গলা চড়ায় একই দাবিতে, এও হয়তো বা তেমনি।

কোথায় পাব এক উদ্বেগহীন জীবন উদযাপনের সুযোগ? এই পিপাসা তবু বেঁচে থাকে আমার মাঝে অচেনা তবু চিরপরিচিত এক অযৌক্তিক উপায়ে! এও এক অভিজ্ঞতা, আর বিস্মরণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া অভিজ্ঞতাই অপরিশোধিত দর্শন। এই উদ্বেগ যা কখনোই গায়ের পোশাকের মতো খুলে ছোঁড়াও যায় না এই জীবন থেকে একটু দূরে! হায়!

লেখক: কবি ও গণমাধ্যমকর্মী