রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি থেকে ৫টি কবিতা

প্রকাশিত : মে ০৮, ২০২০

ওগো আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা

ওগো আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা,
       মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা।
              সারা জনম তোমার লাগি
              প্রতিদিন যে আছি জাগি,
       তোমার তরে বহে বেড়াই
                    দুঃখসুখের ব্যথা।
       মরণ, আমার মরণ, তুমি
                  কও আমারে কথা।
 
       যা পেয়েছি, যা হয়েছি
                    যা-কিছু মোর আশা।
       না জেনে ধায় তোমার পানে
                    সকল ভালোবাসা।
              মিলন হবে তোমার সাথে,
              একটি শুভ দৃষ্টিপাতে,
       জীবনবধূ হবে তোমার
              নিত্য অনুগতা;
       মরণ, আমার মরণ, তুমি
             কও আমারে কথা।
 
                           বরণমালা গাঁথা আছে,
                                         আমার চিত্তমাঝে,
                           কবে নীরব হাস্যমুখে
                                         আসবে বরের সাজে।
                                সেদিন আমার রবে না ঘর,
                                কেই-বা আপন, কেই-বা অপর,
                           বিজন রাতে পতির সাথে
                                    মিলবে পতিব্রতা।
                           মরণ, আমার মরণ, তুমি
                                     কও আমারে কথা।

শিলাইদহ, ২৬ আষাঢ়, ১৩১৭

দিবস যদি সাঙ্গ হল, না যদি গাহে পাখি

দিবস যদি সাঙ্গ হল, না যদি গাহে পাখি,
            ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে—
      এবার তবে গভীর করে ফেলো গো মোরে ঢাকি
            অতি নিবিড় ঘন তিমিরতলে
             স্বপন দিয়ে গোপনে ধীরে ধীরে
             যেমন করে ঢেকেছ ধরণীরে,
      যেমন করে ঢেকেছ তুমি মুদিয়া-পড়া আঁখি,
             ঢেকেছ তুমি রাতের শতদলে।
 
      পাথেয় যার ফুরায়ে আসে পথের মাঝখানে,
             ক্ষতির রেখা উঠেছে যার ফুটে,
      বসনভূষা মলিন হল ধুলায় অপমানে
             শকতি যার পড়িতে চায় টুটে—
                    ঢাকিয়া দিক তাহার ক্ষতব্যথা
                    করুণাঘন গভীর গোপনতা,
      ঘুচায়ে লাজ ফুটাও তারে নবীন উষাপানে
             জুড়ায়ে তারে আঁধার সুধাজলে।

কলিকাতা, ২৯ শ্রাবণ, ১৩১৭

শেষের মধ্যে অশেষ আছে

শেষের মধ্যে অশেষ আছে,
     এই কথাটি মনে
আজকে আমার গানের শেষে
       জাগছে ক্ষণে ক্ষণে।
                           সুর গিয়েছে থেমে তবু
                           থামতে যেন চায় না কভু,
                           নীরবতায় বাজছে বীণা
                                  বিনা প্রয়োজনে।
 
তারে যখন আঘাত লাগে,
             বাজে যখন সুরে—
সবার চেয়ে বড়ো যে গান
             সে রয় বহুদূরে।
                           সকল আলাপ গেলে থেমে
                           শান্ত বীণায় আসে নেমে,
                           সন্ধ্যা যেমন দিনের শেষে
                                  বাজে গভীর স্বনে।

কলিকাতা, ২৬ শ্রাবণ, ১৩১৭

মনে করি এইখানে শেষ

মনে করি এইখানে শেষ
      কোথা বা হয় শেষ
আবার তোমার সভা থেকে
      আসে যে আদেশ।
                    নূতন গানে নূতন রাগে
                    নূতন করে হৃদয় জাগে,
                    সুরের পথে কোথা যে যাই
                           না পাই সে উদ্দেশ।
 
সন্ধ্যাবেলার সোনার আভায়
      মিলিয়ে নিয়ে তান
পূরবীতে শেষ করেছি
      যখন আমার গান—
                    নিশীথ রাতের গভীর সুরে
                    আবার জীবন উঠে পুরে,
                    তখন আমার নয়নে আর
                           রয় না নিদ্রালেশ।

রেলপথে, ২৫ শ্রাবণ, ১৩১৭

তোমার সাথে নিত্য বিরোধ

তোমার সাথে নিত্য বিরোধ
                           আর সহে না—
                    দিনে দিনে উঠছে জমে
                           কতই দেনা।
                                  সবাই তোমায় সভার বেশে
                                  প্রণাম করে গেল এসে,
                                  মলিন বাসে লুকিয়ে বেড়াই
                                                মান রহে না।
 
       কী জানাব চিত্তবেদন,
       বোবা হয়ে গেছে যে মন,
       তোমার কাছে কোনো কথাই
              আর কহে না।
                                  ফিরায়ো না এবার তারে
                                  লও গো অপমানের পারে,
                                  করো তোমার চরণতলে
                                                চির-কেনা।

বোলপুর, ২৫ শ্রাবণ, ১৩১৭