
রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘জুলাই আন্দোলনের সঙ্কট আসলে কোথায়’
পর্ব ১
প্রকাশিত : আগস্ট ০৩, ২০২৫
জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে কয়েকটা কথা না বললেই নয়। ইতিহাসবোধ ছাড়া এই অভ্যুত্থানকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। নানান কথার ফানুস উড়তে থাকবে, আসল কাজের কাজ কিছু হবে না। জুলাই আন্দোলনকে পরিপূর্ণভাবে আস্থায় নিতে হলে চোখ রাখতেই হবে ইউরোপের ইতিহাসের দিকে। মাথার মধ্যে প্রথম বসিয়ে ফেলতে হবে বিজ্ঞানমনস্ক পথে পুরো জাতির প্রচুর অধ্যয়ন করা ছাড়া, এই জাতির মুক্তি নেই। কিছু জানার চেষ্টা করবো না, মূর্খ থাকবো, নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানবো না, পুরানো অন্ধ কুসংস্কারের বলি হবো, আর মনে মনে ভাববো কেন আমরা ব্যর্থ হচ্ছি; এটা কি খুব কার্যকর পদ্ধতি? প্রথমে খুব ভালো করে নিজেদের চিনতে হবে। বুঝতেই হবে, সমগ্র বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার ও চিন্তা-চেতনার যে মান তার তুলনায় নিজেরা আমরা কোথায় পড়ে আছি।
প্রাচীন বিশ্বের ইতিহাসের দুই বিস্ময়কর সভ্যতা হলো প্রাচীন গ্রীস ও প্রাচীন রোমের সভ্যতা। প্রাচীন মিশর ও প্রাচীন ব্যবিলন নিঃসন্দেহে প্রাচীন গ্রীস সভ্যতায় কিছুটা অবদান রেখেছে। প্রাচীন গ্রীস আর রোমের ধর্ম তখন পৌত্তলিক ধর্ম। কত শত দেব-দেবতা তাদের। ঠিক তার মধ্য দিয়ে যিশুর জন্মের চার-পাঁচশো বছর আগে বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, শিক্ষা ও রাষ্ট্রচিন্তার বিস্ময়কর বিকাশ ঘটেছিল সেখানে। বিশ্বে বর্তমানকালেও প্রাচীন গ্রীস আর রোমের মনীষীরা নানাভাবে নিত্যদিন আলোচিত। গ্রীস রোমের ধ্রুপদী সাহিত্য আর নাটকগুলো বর্তমানকালে মানুষকে নতুন চিন্তার খোরাক জোগায়। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে শত শত দেবদেবতা থাকলেও, ধর্ম না পালনের স্বাধীনতা ছিল সকলের। ধর্ম পালন করার ব্যাপারে বাধাও ছিল না। ধর্ম ছিল প্রধানত একটা উৎসব আর মিলন মেলা।
নিশ্চয়ই ধার্মিকদের মনে এই বিশ্বাস ছিল, বিভিন্ন দেবতারা মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। প্রাচীন গ্রীস ও রোম দুটো অঞ্চলেই দেবদেবতার সংখ্যা ছিল এত যে, সবাই সব দেবতার নাম জানতেন না। প্রধান দেবতা জিউস বা জুপিটারসহ যুদ্ধের দেবতা মার্স আর প্রেমের দেবতা এথেনা কিংবা এইরকম কিছু দেবদেবীর নাম সকলেই জানতেন। বহু মানুষ ছিলেন ধর্মে বিশ্বাস করতেন না। প্রাচীন রোমে সম্রাট টাইবেরিয়াসের আমলের একটা মজার ঘটনা আছে। একবার এক লোক নালিশ করলেন সম্রাটের কাছে। বললেন, `সম্রাট, রাষ্ট্রের অমুক নাগরিক অমুক দেবীকে অসম্মান করে কথা বলেছেন। আপনি এর বিচার করেন।` সম্রাট দরবারে বসেই বললেন, `ক্ষমতাবান দেবী যদি ঐ ব্যক্তির উপর প্রতিশোধ না নেন, তাহলে আমি প্রতিশোধ নেবার কে?` ব্যক্তিটি তখন বললেন, `এতে আমাদের দেবী অপমানিত হয়েছেন।` সম্রাট বললেন, `ক্ষমতাবান দেবী যদি নিজেকে অপমানিত হতেই দেন, তাহলে আমার আর কী করণীয়? দেবী নিজে কি এর জন্য আমার কাছে কোনো বিচার দিয়েছেন?` দরবারের সবাই সম্রাটের কথায় সায় দিয়ে হেসে দিলেন।
নাট্যকার সেনেকা সেই যুগে বসে যুক্তি দিয়েছিলেন, মানুষের সকল দুর্ভোগের কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তি। সম্রাট টাইবেরিয়াস ও নাট্যকার সেনেকার এইসব বক্তব্য আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, সেই সমাজে বাক-স্বাধীনতাসহ মানুষের ভাবনাচিন্তা কত উপরের স্তরে ছিল। বাংলাদেশের মানুষের চিন্তাচেতনার জগৎ তার দু’তিন হাজার বছরে পরেও কি সেই স্তরে পৌঁছাতে পেরেছে? বাংলাদেশের মানুষরা কি প্লাটোর মতন, অ্যারিস্টল, সিসেরো কিংবা জুলিয়াস সিজারের মতন চিন্তা করবার ক্ষমতা রাখেন? প্রাচীন গ্রীস-রোমের রচিত মহাকাব্য বা নাটকগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ কি প্রতিযোগিতা করবার সামান্য সাহস দেখাবে? বাক-স্বাধীনতা কি আছে বাংলাদেশে সেই যুগের মতন? সকলের ধর্মীয় স্বাধীনতা বা ধর্ম পালন না করার স্বাধীনতা কি রয়েছে? চিন্তার জগতেই বা কী আছে বাংলাদেশের অবদান, যা নিয়ে বিশ্বসভায় আমরা গর্ব করতে পারি?
সিজার যখন ক্ষমতার উচ্চশিখরে, তিনি একদিন বন্ধুদের আমন্ত্রণ করেছেন নিজের প্রাসাদে। হঠাৎ যা ঘটলো, বাবুর্চি মূল খাবারটা রান্না করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে আর ভয়ে কাঁপছে। খাবার আসছে না দেখে সিজার জানতে চাইলেন, `কী ব্যাপার অতিথিরা বসে আছেন খাবার দেওয়া হচ্ছে না কেন?` বালিকা চাকরাণী এই প্রভু সম্পর্কে সামান্য ধারণা রাখতেন। বললেন, `প্রভু খাবার পুড়িয়ে বাবুর্চি ভয়ে কাঁপছে।` সিজার সামান্য উত্তেজিত না হয়ে হেসে বললেন, `বাকি যা আছে তাই দাও। না হলে আপাতত কিছু খেজুর দাও। ততক্ষণে পুনরায় রান্না শেষ হয়ে যাবে।` ঠাণ্ডা মাথায় সেইরকম গঠনমূলক চিন্তা করার মতন শাসক কি কখনো দেখেছি আমরা? সিজার আর ক্লিওপেট্রা শখের বসে প্রাসাদের ভিতরে দুজনে আন্তিগোনে বা অন্যান্য গ্রিক নাটক থেকে অভিনয় করতেন। সিজার হতেন রাজা ক্রেয়ন আর ক্লিওপেট্রা সাজতেন আন্তিগোনে। সিজারের গ্রিক ধ্রুপদী নাটকগুলোর সংলাপ কণ্ঠস্থ ছিল। সিজারের মতনই ক্লিওপেট্রার পড়াশোনা ছিল বিস্ময় তৈরি করার মতন। বহুজন বিশ্বাস করতে পারবে না, তৎকালে জ্ঞানচর্চা মানে বহু জনের পুরো ইলিয়ড ওডিসি মহাকাব্য মুখস্থ থাকতো। বিখ্যাত কবি ক্যাটুলাস ছিলেন সিজারের প্রতি ক্ষুব্ধ। প্রায় সিজার সম্পর্কে সমালোচনা করতেন তিনি। ভিন্ন দিকে সিজার বন্ধুদের বলতেন, `ক্লডিয়ার প্রেম না পেয়ে ওর মন ক্ষত-বিক্ষত। প্রতিভাবান এই কবির প্রতি নজর রেখো। আমি তার রচনার খুবই ভক্ত।` সম্রাট টাইবেরিয়াস বা জুলিয়াস সীজারের সমপর্যায়ে যুক্তিবাদী বিবেচনা রাখেন, সেইরকম শাসকের দেখা কি মিলেছে এ দেশে কখনো?
জ্ঞান অন্বেষণে তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে এমন একজন শাসকদের দেখা পেয়েছিল ভারত। তিনি হলেন জওহরলাল নেহরু। মনে করা যাক এমনকি রাষ্ট্রপতি আবুল পাকির আবদুল কালামের কথা। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে ততটুকুই কি কখনো ঘটেছে? সারাবিশ্বের ইতিহাস ছিল নেহরুর নখদর্পনে। কারাগারে দিনরাত বই পড়তেন আর কন্যা ইন্দিরাকে চিঠি লিখতেন। ইন্দিরাকে লেখা সেই চিঠিগুলো সংগ্রহ করে পরবর্তীকালে একটা বই প্রকাশিত হয়। বইটির নাম ‘বিশ্ব-ইতিহাস প্রসঙ্গ’। বইটি আসলে ইন্দিরাকে লেখা সেই চিঠিগুলোর সমাহার। মূলত আসলে একটা ইতিহাস গ্রন্থ। `বিশ্ব ইতিহাস জানার জন্য` এমন বই দ্বিতীয়টি নেই। বলতে গেলে ভারত উপমহাদেশ তো দূরের কথা, বিশ্বেই তেমন বই আর আছে কিনা সন্দেহ। বুঝতে হবে, রাস্তায় শ্লোগান দিয়ে সরকারের পতন ঘটিয়ে সরকার পাল্টানো যায়, সমাজকে চূড়ান্তভাবে পাল্টানো যাবে না যদি না জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সম্পর্ক থাকে। কথাটা কার্ল মার্কস, লেনিন, মাও সে তুং প্রমুখের। মার্কস গ্রিক ধ্রুপদী নাটকগুলো পাঠ করেছিলেন গ্রিক ভাষায়। নাটকগুলো পাঠ করবার জন্যই কেবল গ্রিক ভাষা শিখেছিলেন। শেক্সপিয়ারের নাটকের সংলাপ তার পরিবারের সদস্যদের সকলের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কণ্ঠস্থ ছিল। গ্যাটে, শিলার, বালজাক পড়েছেন মার্কস নিবিষ্ট মনে। বলে গেছেন, ইতিহাসের চেয়ে সাহিত্য পাঠ থেকে ইতিহাসকে অনেক বেশি উপলব্ধি করা যায়। তিনি অবশ্য সেই সব সাহিত্যের কথাই বলেছিলেন, যা মানসম্পন্ন। মার্কস তৎকালের প্রতিটি বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তিনি এমনকি বিজ্ঞানচর্চার ত্রুটি নিয়ে যা লিখে রেখে গেছেন, তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে বিশ শতকে এসে।
বুঝতে হবে কারা রাজনীতি করেছিলেন তখন, কারা ছিলেন পথপ্রদর্শক। ভ্লাদিমির লেনিনের তার কালের সমস্ত প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্পর্কে পড়াশুনা ছিল। তিনি কেবল মার্কসের বইই পড়েননি, সমকালের রাজনীতি বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সমস্ত চিন্তার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তৎকালের রুশ সাহিত্যসহ সারা বিশ্বের ধ্রুপদী সাহিত্য পাঠ করেছেন। বাংলাদেশের ডানপন্থীদের কথা বাদ দিলাম, বাম রাজনীতিক নেতাদের পড়াশোনার মান কী? বিশ্বের সব ধ্রুপদী সাহিত্যের কথা বাদ দিলাম, ভারতের উনিশ বিশ শতকের প্রধান সাহিত্য কজনের পাঠ করা আছে? মধুসূদন পড়েছেন বা স্পর্শ করেছেন কজন? বিশ শতকে কিংবা ঊনিশ শতকে রচিত তৎকালীন ইতিহাস, বা খণ্ডিত জাতীয়তাবাদের উপর পড়াশোনা আছে কজনের? সবাই কেবল শোনা কথা অন্যদের শোনাচ্ছেন। নিজেরাই স্পষ্ট জানেন না, ঠিক না ভুল বলছেন জনগণকে। মার্কসই বা তাঁদের মধ্যে পড়ে দেখেছেন কজন? পৃথিবীতে জ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে যে বিপ্লব হয় না; সেটা মার্কস, লেলিন, স্তালিন, মাও সেতুংয়ের কথা। শ্রমিক শ্রেণিকেও বিপ্লবী হবার জন্য সচেতন হবার কথা বলেছেন মার্কস। সচেতন হওয়া মানে রাস্তায় নেমে মারামারি লাগানো নয়।
বামপন্থীরা মনে করেন, মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের মতো নেতাদের এসব কথাকে পাত্তা না দিয়েই বিপ্লব করা সম্ভব! বক্তৃতাবাজিতে পারঙ্গমরা প্রতিদিন কয় ঘণ্টা অধ্যায়ন করেন? নিজেরা এবং তাঁদের কর্মীরা কি অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন? কথা হলো এসব বুঝতে না চাইলে জুলাই আন্দোলনের ত্রুটিকে সম্যক উপলব্ধি করা যাবে না। চিৎকার করে যতই সমাবেশ মাত করা যাক, সত্যিকারের বিপ্লব ঘটবে না। বিপ্লব মানেই শাণিত চিন্তা। চলবে