রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘জুলাই আন্দোলনের সঙ্কট আস‌লে কোথায়’

পর্ব ২

প্রকাশিত : আগস্ট ০৪, ২০২৫

বাংলা‌দে‌শে বাস ক‌রে নতুন চিন্তা কথাটা বল‌তে চাই না। বল‌তে চাই না একার‌ণেই যে, এদে‌শের নতুন চিন্তা মা‌নে কী? বি‌শ্বের পুরা‌নো বহু উন্নত চিন্তার স‌ঙ্গেই তো আমরা পরি‌চিত নই। প্রাচীন গ্রীস ও রো‌মের পুরা‌নো চিন্তাগু‌লোর মতনই হোক না আগে আমা‌দের চিন্তা। সেখা‌নে ধর্ম পাল‌নের স্বাধীনতা ছিল, ধর্ম না পালন করার স্বাধীনতা ছিল। মত প্রকাশ করার স্বাধীনতা ছিল। যু‌ক্তি তর্ক ছিল, মুখস্থ বিদ‌্যা ছিল না।

বাংলা‌দে‌শে কি এই যু‌গেও সেই দুই হাজার বছর আগের গ্রিক রোমান‌দের সভ‌্য সমাজের মতন একটা সমাজের দেখা পাওয়া যা‌চ্ছে? বাংলা‌দে‌শে নতুন চিন্তা মা‌নে কী? নিশ্চয় তা ইউরো‌পের রে‌নেসাঁ থে‌কে আধু‌নিক ইউরো‌পের নতুন রাষ্ট্রচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতার চে‌য়ে পেছ‌নের চিন্তা। বাংলা‌দেশ চিন্তার জগ‌তে সাম‌গ্রিকভা‌বে এতটাই পি‌ছি‌য়ে আছে যে, দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে ইউরোপ যা ভাব‌তে পার‌তো, আমরা তাও ভাব‌তে পা‌রি না।

স্মরণ রাখ‌তে হ‌বে, ইউরোপ ষষ্ঠ শতক থে‌কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ডু‌বে গি‌য়ে‌ছিল। ধর্ম পালন ছাড়া আর কিছুই সেখা‌নে পালন করা যে‌তো না। সম্ভবত বহু বছর ধ‌রে বাংলা‌দেশ সেই প‌থেই যাত্রা ক‌রে‌ছে। সেই অন্ধকার থে‌কে মুক্ত হবার সম্ভাবনা এদে‌শে এখ‌নো চো‌খে পড়‌ছে না। ইউরোপ ষষ্ঠ শত‌ক থে‌কে স‌ত্যিই অন্ধকা‌রে ডুব‌তে শুরু ক‌রে, নতুন ক‌রে আবার জে‌গে উঠে‌ছিল দ্বাদশ শত‌কে। ইউরো‌পের দ্বাদশ শত‌কের প‌রের প্রতি‌টি স্তরই হ‌লো, এক এক‌টি বিপ্লবের স্তর। ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তা চ‌লে‌ছিল নানাভা‌বে। কারণ তারা আর কখ‌নো অন্ধকা‌রে থাক‌তে চায়‌নি।

যিশু খ্রিস্টের জ‌ন্মের বহু আগেই প্রাচীন রোম নতুন শ‌ক্তি‌তে বলীয়ান হ‌য়ে প্রাচীন গ্রীস‌কে দখল ক‌রে বিরাট সাম্রাজ‌্য গ‌ড়ে তো‌লে ইউরোপে। প‌রে দখল ক‌রে ফি‌লি‌স্তিন, ভূমধ‌্যসাগর অঞ্চল ও আফ্রিকার বহু এলাকা। সেই সম‌য়ে প্রাচীন গ্রী‌সের চিন্তার প্রভা‌বেই বিরাট এক চিন্তার জগত গ‌ড়ে উঠে‌ছিল রোম সাম্রা‌জ্যে। কত দার্শ‌নিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান‌ী, ইতিহাস‌বিদ, জ্যো‌তির্বিজ্ঞানী, নাট‌্যকার, ক‌বির দেখা পাওয়া গি‌য়েছিল সেখা‌নে। কিন্তু চতুর্থ শ‌ত‌কে এই সভ‌্যতার পতন আরম্ভ হ‌লো যখন পৌত্ত‌লিক ধর্ম বাদ দিয়ে খ্রিস্টধর্ম‌কে সাম্রা‌জ্যের সরকারী ধর্ম হি‌সে‌বে গ্রহণ ক‌রেন সম্রাট কনস্টানটাইন।

পঞ্চম শত‌কে দাস বি‌দ্রো‌হের ফ‌লে প‌শ্চিম রোম সাম্রাজ‌্য আক্রান্ত হ‌লে, ষষ্ট শত‌কে ভয়াবহ ক্ষমতাশীল হ‌য়ে ওঠে খ্রিস্টান‌দের প্রতিষ্ঠান চার্চ আর পু‌রো‌হিতরা। প্রাচীন যু‌গের পৌত্ত‌লিক পূজা আগেই নি‌ষিদ্ধ করা হ‌য়ে‌ছিল, এইবার নি‌ষিদ্ধ করা হ‌লো বাইবে‌লের বিশ্বা‌সের বাইরে সবরকম জ্ঞানচর্চা। যা কিছু বাইবে‌লের বিশ্বা‌সের স‌ঙ্গে সাংঘর্ষিক তাই নি‌ষিদ্ধ হ‌য়ে গেল সারা ইউরোপ জু‌ড়ে। একমাত্র সত‌্য হ‌লো বাইবেল, এর বাইরে যাওয়া অপরাধ হি‌সে‌বে গণ‌্য হ‌য়ে‌ছিল।

বিজ্ঞান, কাব‌্য, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সা‌হিত‌্য, নাট‌্যচর্চা নি‌ষিদ্ধ হ‌য়ে গেল। বহু গ্রন্থাগার, বইপত্র পু‌ড়ি‌য়ে দেওয়া হ‌তে থাক‌লো। রাষ্ট্র ব‌লে আস‌লে কিছু থাক‌লো না প‌বিত্র রোম সাম্রা‌জ্যে, সব‌কিছু চ‌লে গেল চা‌র্চের নিয়ন্ত্রণে। রাজা বা সম্রাট সবার উপ‌রে পো‌পের নিয়ন্ত্রণ। ঠিক এই ষষ্ঠ শত‌কে আরবে জন্মগ্রহণ ক‌রেন ইসলা‌মের নবি, তি‌নি প‌রে সপ্তম শত‌কের শুরু‌তে ইসলাম ধর্মের প্রচার আরম্ভ ক‌রেন।

নবির মৃত‌্যুর পর মুসলমানরা বি‌ভিন্ন দেশ জয় কর‌তে থা‌কে। গ্রীস ও রো‌মের মনীষীরা যারা চা‌র্চের ভ‌য়ে দেশ ছে‌ড়ে ছিল সবাই তারা সসম্মা‌নে আশ্রয় লাভ ক‌রেন নতুন আরব সাম্রা‌জ্যে। গ্রীস ও রো‌মের জ্ঞানভাণ্ডার‌কে যতটা সম্ভব রক্ষা ক‌রে তখনকার মুস‌লিম শাসকরা। গ্রীস রো‌মের মনীষী‌দের প্রথম আশ্রয় দেন জ্ঞানচর্চায় আগ্রহী মুস‌লিম শাসক ইয়া‌জিদ। সব মুসলমান শাসকরাই প‌রে গ্রী‌সের জ্ঞানভাণ্ডার থে‌কে যতটা সম্ভব রসদ সংগ্রহ ক‌রেছি‌লেন। বি‌শেষ ক‌রে অ‌্যা‌রিস্টটলের রচনা সব‌চে‌য়ে বে‌শি মুগ্ধ ক‌রে‌ছিল আরব প‌ণ্ডিত‌দেরকে।

যতদূর সম্ভব আরব‌দের দ্বারা গ্রিক ও লা‌তিন রচনাগু‌লি‌কে আরবী ভাষায় অনুবাদ ক‌রে নেওয়া হ‌লো। গ্রিক-লা‌তিন জ্ঞান দ্বারা প্রভা‌বিত সেই সম‌য়ের মুসলমান প‌ণ্ডিত‌দের ম‌ধ্যে সব‌চে‌য়ে আলো‌চিত ছি‌লেন,  ইব‌নে সিনা এবং আবু রুশদ। ইউরো‌পের প্রথম দি‌কে প্রতি‌ষ্ঠিত বিশ্ব‌বিদ‌্যালয়গুলি‌তে দুজ‌নের রচনা ছিল বিপুলভা‌বে পাঠ‌্য। বা‌কি মুসলমানদের রচিত গ্রন্থ আরবী থে‌কে লা‌তি‌নে অনুবাদ ক‌রে পড়া‌নো হ‌তো। কারণ, সমগ্র ইউরোপ তখন স‌বেমাত্র ক‌য়েক‌শো বছ‌রের অন্ধকার থে‌কে জে‌গে উঠ‌ছে।

আরব প‌ণ্ডিতরা তখন তা‌দের পথপ্রদর্শক হিসে‌বে কাজ ক‌রেন। স্মরণ রাখ‌তে হ‌বে, একদা গ্রিক লা‌তিন জ্ঞানভাণ্ডার থে‌কে গ্রহণ ক‌রে‌ছিল আরবরা। ঠিক দ্বাদশ শত‌কে ঘ‌টে ভিন্ন ঘটনা। ইউরোপ এবার ধার কর‌তে থা‌কে আরব প‌ণ্ডিত‌দের কাছ থে‌কে। এই সম‌য়ে প্লা‌টো অ‌্যা‌রিস্টট‌লের স‌ঙ্গে ইউরোপকে প‌রিচয় ক‌রি‌য়ে দেয় আরব মনীষ‌ীরাই। এর আগে আরবরা গ্রন্থের পর গ্রন্থ লা‌তিন বা গ্রিক থে‌কে অনুবাদ ক‌রে‌ছিল আরবী‌তে। এইবার ইউরোপ হাজার হাজার পৃষ্ঠা লা‌তি‌ন ভাষায় অনুবাদ কর‌তে থা‌কে আরবী রচনা থে‌কে। ঘটনাটা কীভা‌বে ঘট‌লো?

ক্রুসেড বা ধর্মযু‌দ্ধের ভূ‌মিকা ছিল এর পেছ‌নে। সম্পূর্ণ অন্ধকা‌রে বাইবে‌লের বিশ্বা‌সে ডু‌বে থাকা ইউরো‌পের মানুষ ক্রুসেডের মাধ‌্যমে মুসলাম বা আরব সংস্কৃ‌তির সংস্প‌র্শে আসে। আরব‌দের মাধ‌্যমে জ্ঞানসাধনার প্রতি আগ্রহী হতে আরম্ভ ক‌রে ইউরো‌পের মানুষ দশম-এগা‌রো শত‌কে। আরব‌দের কাছ থে‌কেই জান‌তে পা‌রে প্রাচীন গ্রীস ও রো‌মের বিপুল জ্ঞানভাণ্ডা‌রের কথা। কিছুটা জান‌তে পা‌রে পূর্ব রোমান সাম্রাজ‌্য বাইজানটিয়ান থে‌কে। ফ‌লে ইউরো‌পে দ্বাদশ শত‌কে গ‌ড়ে উঠ‌তে আরম্ভ ক‌রে বিশ্ব‌বিদ‌্যালয়। প্রথম ইতালী‌তে, প‌রে ফ্রা‌ন্সে।

ম‌নে রাখ‌তে হ‌বে, ইতালীর সি‌সি‌লি ও গ্রীস ছিল আরব‌ উপ‌নিবেশ। দশম-এগা‌রো-দ্বাদশ শত‌কে আরব‌দের স‌ঙ্গে এভা‌বে নতুন ইউরো‌পের জ্ঞা‌নের আদানপ্রদান চালু হ‌লো। দ্বাদশ শত‌কে ভা‌র্জি‌লের ঈনিড পাঠ ক‌রে দা‌ন্তে লিখ‌লেন তার বিখ‌্যাত গ্রন্থ ‌‘ডিভাইন ক‌মে‌ডি’, যার লক্ষ লক্ষ ক‌পি বি‌ক্রি হ‌য়ে‌ছিল সারা ইউরো‌পে। সেটাই ছিল তখন সব‌চে‌য়ে জন‌প্রিয় ও আলে‌চিত গ্রন্থ। আরব‌দের কার‌ণে অ‌্যা‌রিস্টটল হ‌য়ে উঠ‌লেন ইউরো‌পের শিক্ষাজগ‌তে সব‌চে‌য়ে আলো‌চিত ব‌্যক্তি। এই যে এভা‌বে ক‌রে আরব‌দের হাত ধ‌রে প্রাচীন গ্রীস ও রো‌মের জ্ঞানভাণ্ডার ফি‌রে এলো ইউরো‌পে, সেই প্রভা‌বে ইতালী‌তে নতুনভা‌বে ‌শিল্পকলা-সা‌হিত‌্য সৃ‌ষ্টি হ‌লো। এটা‌কেই বলা হয় পুনর্জন্ম বা পুনর্জাগৃ‌তি বা রে‌নেসাঁস।

স্মরণ রাখ‌তে হ‌বে, জ্ঞা‌নের জগ‌তে আরবরা দশম থে‌কে ত্রয়োদশ শতকে ইউরোপ‌কে সমৃদ্ধ ক‌রে‌ছিল। দুর্ভাগ‌্য যে, সেই আরবরাই আবার তখন থে‌কেই অন্ধকা‌রে ডুব‌তে আরম্ভ ক‌রে‌ছিল কট্টরপন্থী রক্ষণশীল মুসলমান‌দের জন‌্য। জ্ঞান‌বিজ্ঞান চর্চায় মুসলম‌ান‌দের সেই অন্ধকার পর্ব এখ‌নো চল‌ছে, প্রায় এক হাজার বছর হ‌তে চল‌লো। য‌দি প্রশ্ন করা হয়, সপ্তম শতক থে‌কে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত পাঁচ‌শো বছর ধ‌রে আরবরা মৌ‌লিকভা‌বে যে জ্ঞা‌নের ভাণ্ডার সৃ‌ষ্টি কর‌তে পার‌ছিল, সারা বি‌শ্বের জ্ঞা‌নের ইতিহা‌সে যা আজও আলে‌চিত, বর্তমান বাংলা‌দে‌শের শিক্ষাজগত কি সেইটুকু জ্ঞান বিতরণ কর‌তে পার‌ছে? জবাব হ‌চ্ছে, না।

স‌ত্যিই মৌ‌লিকভা‌বে তা পার‌ছে না। যা কিছু ক‌র‌ছে তা হ‌লো, প‌রের দে‌শের মুখস্থ বিদ‌্যার আমদানী। সেই কারণেই সৃ‌ষ্টিশীলতা নেই এখানকার শিক্ষাধারায়, বিজ্ঞা‌নে মৌ‌লিক কো‌নো অ‌র্জন নেই বাংলা‌দে‌শের। সপ্তম শত‌ক-দ্বাদশ শতক পর্যন্ত আরবরা যে সৃজনশীলতার প্রমাণ রাখ‌তে পে‌রে‌ছিলেন, বিশ্ব‌কে পাঁচ‌শো বছর যতটুকু আলো‌কিত করতে পে‌রে‌ছি‌লেন; বাংলা‌দেশ ভূখণ্ড কখ‌নো তা পা‌রে‌নি। জ্ঞা‌নের রা‌জ্যে খুবই পি‌ছি‌য়ে বাংলা‌দেশ। কলকাতা‌কে ঘি‌রে ঊনিশ শত‌কে যে জ্ঞানচর্চার ধারা আরম্ভ হ‌য়ে‌ছিল তা কখ‌নো এই ভূখ‌ণ্ডে সেভা‌বে বিচ্ছু‌রিত হয়‌নি। এই ভূখণ্ড বারবার ‌নিষ্ফল বি‌দ্রোহ ক‌রে‌ছে শাসক‌দের বিরু‌দ্ধে। কারণ জ্ঞানরা‌জ্যে দু’একটা ব‌্যতিক্রম ছাড়া তেমন শস‌্য ফ‌লে‌নি, যা বিশ্বমা‌পের।

এই শিক্ষা নি‌য়ে কি আস‌লে বর্তমান বি‌শ্বের প্রেক্ষাপ‌টে খুব বে‌শি দূর এগি‌য়ে যাওয়া সম্ভব? না জানাটা ততটা বড় বাধা নয়। কিন্তু জান‌তে চাইছে না কেউ। ব‌্যতিক্রম বাদ দি‌লে, বিরাট অং‌শের কা‌রো আগ্রহ নেই জানার। না জান‌তে চাওয়াটাই তাই আম‌া‌দের সব‌চে‌য়ে বড় বাধা। বাংলা‌দে‌শের বিশ্ব‌বিদ‌্যালয়গু‌লির অবস্থান কত নিম্নে বহুবার পত্রিকায় তার খবর পাওয়া গে‌ছে। শিক্ষার্থীর‌দের স‌ঙ্গে কথা বল‌লে আরো টের পাওয়া যা‌বে। দায়টা কি শিক্ষার্থী‌দের, না‌কি শিক্ষা প‌রিক্রল্পনার? নিশ্চয় দায়টা কার, সেটা নি‌য়ে গভীরভা‌বে আলোচনা হওয়া দরকার। চলবে

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ