
রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘জুলাই আন্দোলনের সঙ্কট আসলে কোথায়’
পর্ব ৩
প্রকাশিত : আগস্ট ০৬, ২০২৫
দ্বাদশ শতক পর্যন্ত অন্ধকারে থাকার পর ইউরোপ কীভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় এগিয়ে গিয়েছিল, চিন্তা করতে গেলে বিস্মিত হতে হবে। শুধুমাত্র একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। তখন ইউরোপের লোক সংখ্যা খুবই কম, মাত্র ৬ কোটি। মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা আবিষ্কার হয়েছে কিছুদিন আগে, মাত্র পনেরো শতকের শেষদিকে। কিন্তু পনেরোশো খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন ইউরোপের ছাপাখানা থেকে ষাট লক্ষাধিক পুস্তকের চল্লিশ হাজার সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল।
ভাবতে পারা যায়, তার পাঠকের সংখ্যা কতটা ছিল! ভারতে তখন ছাপাখানা বসেনি, ভারতে ছাপাখানা এসেছে তার প্রায় তিনশো বছর পরে। ইউরোপ তার পরের চারশো বছরে বৈজ্ঞানিক চিন্তার ক্ষেত্রে প্রথম একের পর এক নতুন কথা বলে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। ইউরোপ গুরু মারা শিষ্য হয়েছিল। যার বা যাদের কাছ থেকে শিখতে আরম্ভ করেছিল, ত্রুটি বের করলো তাঁদের চিন্তার। হাজার বছর ধরে যাদের জ্ঞান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি, সেই প্লাটো, অ্যারিস্টটল ও টলেমির চিন্তা বাতিল করে দিয়েছিল তারা। ঠিক এটাকেই বলে শিক্ষার অগ্রগতি।
পুরানো সকল চিন্তাকে ছাড়িয়ে যায় নতুন জ্ঞান। জ্ঞানের অগ্রগতির এটাই মাপকাঠি। যারা পুরানো জ্ঞান নিয়ে গর্ব করে এবং সারাজীবন পড়ে থাকতে চায় তারাই কূপমণ্ডুক। সন্দেহ নেই যে, জ্ঞানচর্চা, মানুষের বই পড়ার অভ্যাস ইউরোপকে এগিয়ে দিয়েছে। স্মরণ রাখতে হবে, ষোলশো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত জ্ঞানচর্চার প্রতি চার্চের বিরুদ্ধতা ছিল। তখনো বিজ্ঞানচর্চার জন্য পুড়িয়ে মারা হচ্ছে গবেষকদের বা গ্যালিলিওকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।
রেনেসাঁর পর তাই প্রথম মানুষ বিদ্রোহ করলো চার্চের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলো, চার্চের সকল রকম অন্যায়, দুর্নীতি, কর্তৃত্ব ও ধর্মের নামে মানুষকে অন্ধ করে রাখা, মানুষের জ্ঞানচর্চায় বাধাদান; এসবের বিরুদ্ধে প্রথম বহু পাদ্রী, বিশপরা বিদ্রোহ করেছিল। বিদ্রোহ করলেন কেন? কারণ রেনেসাঁর ধাক্কায় পাদ্রীরা পর্যন্ত পড়াশোনা করতেন, বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতেন। জ্ঞানরাজ্যে পরিণত হয়েছিল ইউরোপ। জ্ঞান ছাড়া সেই সমাজে পাত্তা ছিল না কারো। রাজা রানী রাজপুত্র রাজকন্যারা অধ্যয়ন করতেন নানা বিষয়ে।
ইউরোপ এমনিতেই এতদূর আসেনি। পিছনে বড় অবদান গ্রন্থ আর অধ্যয়নের। ষোল-সতেরো শতকের ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন বা চার্চের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ফলে ঠিক হলো, চার্চ কেবল আধ্যাত্মিক ব্যাপার নিয়ে থাকবে। রাষ্ট্র শাসনে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলি ও জ্ঞানচর্চায় চার্চ আর নাক গলাবে না। ধর্ম থাকবে ধর্মের জায়গায়, রাষ্ট্র শাসনের ক্ষমতা থাকবে শাসকদের হাতে। শাসককে হতে হবে আলোকিত মানুষ। বিজ্ঞান চর্চা করেছেন তখন যারা, নিউটনসহ বেশির ভাগ বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ছিলেন ঈশ্বরে বিশ্বাসী। কিন্তু চার্চের কর্তৃত্ব পছন্দ করেননি।
মানুষের জ্ঞানচর্চায় চার্চের বিরুদ্ধে কঠোর ছিলেন তারা। সকলেই মনে করতেন, ঈশ্বর মানুষকে বিবেক দিয়েছেন জ্ঞানচর্চার জন্য, চার্চের মাতব্বরি এখানে চলবে না। ইশ্বরের সৃষ্ট মানুষের পাপ-পুণ্যের বিচার করার অধিকার পাদ্রী বা চার্চের নেই। বিজ্ঞানের সত্য উচ্চারণের জন্য তাদেরকে পুড়িয়ে মারার অধিকার নেই চার্চের বা পোপের। পাপ-পুণ্যের বিচার করবেন শেষবিচারের দিনে ঈশ্বর স্বয়ং। ফলে জ্ঞানচর্চা ইউরোপে স্বাধীনতা পেল। ঠিক তার ভিত্তিতে ইউরোপ শিক্ষা, রাষ্ট্রচিন্তা, শিল্প-সাহিত্য চর্চা, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সর্ববিষয়ে সারা বিশ্বকে চমক লাগিয়ে দিল। কিন্তু মানুষের এই অগ্রযাত্রা কোথাও একজায়গায় থেমে থাকে না। নিশ্চয় তা আরও এগিয়ে যেতে চায়।
ইউরোপে চার্চের নিয়ন্ত্রণ কমে গেল ঠিকই তবুও সম্পূর্ণ বন্ধ হলো না। ভিন্ন দিকে রাজতন্ত্র রয়ে গেল। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা পেলেও, নাগরিকরা সম্পূর্ণ বাক-স্বাধীনতা পেল না। রাজার কথায় চলছে শাসন। বৃটেনে একধরনের গণতন্ত্র বা সংসদের শাসন আরম্ভ হলো শিল্প বিপ্লবকে ঘিরে। বাকি রাষ্ট্রগুলোতে তা ছিল না। দার্শনিকরা তাঁদের লেখায় সাম্য, মানবাধিকার আর বাক-স্বাধীনতার কথা বলতে থাকলেন। গণতন্ত্রের পাশাপাশি সাম্য ঢুকে পড়লো দার্শনিকদের চিন্তায়।
সত্যি বলতে এসব ধারণা তখনো ছিল সমাজের ধনী আর সুবিধাভোগীদের মধ্যে। ধনীদের চাওয়া আর বঞ্চিত মানুষের চাওয়া পাওয়া মিলে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফরাসী বিপ্লব হলো ১৭৮৯ সালে। বাংলা তখন ইংরেজ শাসকদের দখলে গিয়েছে বত্রিশ বছর হলো। ফরাসী বিপ্লব সারা ইউরোপে তো বটেই সারা বিশ্বের এক আলোচিত ঘটনা। এই বিপ্লবে রাজতন্ত্রের উৎখাত এবং সংসদীয় শাসনের জন্য যুক্ত হয়েছিল বহু মতের মানুষ। প্রত্যেকের তাদের আলাদা আলাদা স্বার্থ ছিল।
বিভিন্ন রকম সুযোগ সুবিধা নেয়ার কথা ভেবেও যুক্ত হয়েছিল বহু মানুষ এবং দল। বিপ্লবের পর সকল পক্ষই নিজেদের স্বার্থটাকেই গুরুত্ব দিয়েছিল বিপ্লবের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে। জ্যাকোবিন আর রোবসপিয়ার তখনো বিপ্লবের পথ আঁকড়ে রইলেন। বিপ্লবের মূল শক্তি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি জ্যাকোবিনরা বা তাদের নেতা রোবসপিয়ার, দাঁতোরা বুঝলেন, কঠোর না হলে বিপ্লব ভণ্ডুল হয়ে যাবে বিভিন্ন জনের লোভের কাছে।
ভিন্ন দিকে প্রুশিয়া অষ্ট্রিয়া সহ বিভিন্ন দেশের রাজারা বিপ্লব দেখে ভয় পেল। তা ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লাগল। ফ্রান্সের বিপ্লব বিরোধী আমলা, বড় বড় সামরিক কর্মকর্তারা বিদেশে পালিয়ে গেল বিপ্লব নস্যাৎ করার জন্য। বিপ্লব বিরোধী ফরাসী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আর বিদেশীরা একজোট হলো বিপ্লবকে ধ্বংস করতে। ভিন্নদিকে বিপ্লবীরা নিজেরা নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লো। বিপ্লবের পর কেউ হলেন অভিজাততন্ত্রের লোক, কেউ বিপ্লব চাইলেও রয়ে গেলেন চার্চপন্থী। বিপ্লবের মূল বাণীই উল্টে দিতে চাইলেন এঁরা।
বিপ্লবী রোবসপিয়েরের মতন কিছু জ্যাকোবিনরা ছাড়া সবাই নিজ স্বার্থ খুঁজতে লাগলেন। ব্যবসায়ীরা দেখলেন কেবল নিজের স্বার্থ। বিপ্লবের আগে বহু নারী এতে অংশ নেয়, কিন্তু রোবসপিয়ের ছাড়া বাকিরা নারীদের সামান্য অধিকার স্বীকার করতে চায় না। বিশেষ করে অভিজাত, সম্ভ্রান্ত ও চার্চপন্থীরা নারীর অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। নানামুখি দ্বন্দ্বে বিপ্লবীরা খুব দ্রুত নিজেরাই একটি দুর্বল শক্তি হয়ে পড়ে। জ্যাকোবিনদের হাতে তখনো ক্ষমতা ছিল, অন্যরাও ক্ষমতায় ছিল।
কার যে গোপন লক্ষ্য কী তখন বোঝা দায়। রাজা এই দ্বন্দ্বে খুশিই হলেন। শত্রুপক্ষ এই দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে তুলতে লাগল। বিপ্লবীরা কেউ কেউ নিজস্বার্থে বিপ্লবের শত্রুদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন। এক অরাজক অবস্থা তৈরি হলো। বিপ্লবের মূল লক্ষ্য যেন কতিপয় জ্যাকোবিনরা ছাড়া সবাই ভুলে গেল। কিন্তু জ্যাকোবিনদের মধ্যেও নানান অন্তর্বিরোধ ছিল।
বিপ্লবীরা ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুইকে ক্ষমতায় রাখার চেষ্টাই করেন। বিপ্লবীরা মনে করেন রাজা থাকবেন, তার অধীনে একটি জাতীয় সংসদ সব সিদ্ধান্ত নেবে। এক ব্যক্তির ইচ্ছায় আর দেশ চলবে না। কিন্তু বিপ্লব বিরোধীরা, সেই সঙ্গে রাজার অনুগত সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থরা, সরকারি আমলারা প্রুশিয়া বা অস্ট্রিয়া পালিয়ে গিয়ে বিপ্লবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে গেল। বিদেশি রাষ্ট্রের সাহায্যে ফ্রান্স আক্রমণ করে বিপ্লব ধ্বংস করতে চাইলো।
ফ্রান্সের জাতীয় বেঈমানরা তাতে যোগ দেয় এবং ইন্ধন জোগায়। ফরাসী বিপ্লব ছিল আসলে রক্তপাতহীন বিপ্লব, সাংবিধানিক সংস্কারের বিপ্লব। রাজা বা কারো উপরেই তাই বিপ্লবীরা আঘাত করতে চায়নি। চেয়েছিল শান্তিপূর্ণ সামাজিক পরিবর্তন। কিন্তু শত্রুরা বিদেশী সামরিক বাহিনীর সাহায্যে ফরাসী দেশ দখল করতে চাইলো। সামরিক বাহিনীর প্রধান প্রধান কর্মকর্তারা তখন বিদেশে পলাতক, তাই জনগণকে নিয়ে একটি বাহিনী গড়া হলো। সেই বাহিনী কিন্তু ঠিকই সীমান্তে বিদেশী আক্রমণ ঠেকিয়ে দিয়েছিল।
ভিন্ন দিকে রাজা ষোড়শ লুই বিপ্লবীদের কাছে সম্মান লাভ করেও, বিপ্লব ধ্বংস করতে বিদেশী রাষ্ট্রে পালাতে গিয়ে জনগণের হাতে ধরা পড়ে। ফলে এইবার বিশ্বাসঘাতক রাজাকে গিলোটিনে পাঠানো হয়। বিদেশীদের ষড়যন্ত্রে এবং জাতীয় বেঈমানদের ভয়ে বিপ্লব তখন থেকে হয়ে ওঠে রক্তাক্ত। চলবে
লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ