রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’

পর্ব ১

প্রকাশিত : জুলাই ১৮, ২০২১

বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

নাটকের চরিত্ররা
কায়াস হলোফারনেস: গ্রিকরাষ্ট্র থিউসের রাজা। ভূতপূর্ব রাজা ফিলাটোসকে হত্যা করার পর সামরিক শক্তির বলে যিনি রাজা হয়েছেন।
ক্রোনাস:  থিউসের একজন অভিজাত। বর্তমানে প্রধান বিচারপতির আসনে আসীন, তবে রাজার অধীন।
নেস্টর: থিউসের একজন অভিজাত, একজন অমাত্য ও রাজার প্রধান উপদেষ্টা
জেকোনত্তা: মূলত রোমের নাগরিক। খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে যার থিউসে আগমন। বর্তমানে থিউস রাষ্ট্রে বন্দী।
ব্র্যাসিডাস: থিউসের প্রধান সেনাধ্যক্ষ।
ফেরেস: জেকোনেত্তার জ্যেষ্ঠপুত্র ও নগরপাল ক্যাফিসের হত্যাকারী।
জোকাস্তা: থিউসের বাক্কাস মন্দিরের প্রধান অভিনেত্রী, ক্রোনাসের ভগ্নি ও নিহত ক্যাফিসের স্ত্রী।
ক্রানমার: থিউসের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। থিউসের রাজনীতিকেও যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন।
দ্রিমাস: একজন কাচ কারিগরের পুত্র ও নতুন ধরনের কাচপাত্রের আবিষ্কারক।
সস্ত্রাতাস: প্রায়ামের একজন তরুণ কবি, নাট্যকার ও অভিনেতা।
হিস্টাফাস: জেকোনেত্তার কনিষ্ঠপুত্র।
সাধারণ কয়েকজন সৈন্য, ক্রানমারের একজন ভৃত্য, জেকোনেত্তার বালকভৃত্য,  রাজার ভৃত্য ও দেহরক্ষীরা।

প্রথম দৃশ্য
দ্বিপ্রহরের পূর্বভাগ। থিউসের রাজা কায়াস হলোফারনেসের দরবার কক্ষ। সিংহাসনে হলোফারনেস উপবিষ্ট। রাজার দুদিকে আছেন মান্যবর ক্রোনাস, প্রিয় নেস্টর ও গণ্যমান্য অমাত্যরা। বিচারের কাঠগড়ায় আসীন খ্রিষ্টধর্মের প্রচারক মহীয়সী জেকোনেত্তা।

ক্রোনাস: মহামান্য রাজা, মাত্র কয়েক বছর আগে আমরা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। মহীয়সী জেকোনেত্তা তার বিরুদ্ধেই আবার চক্রান্ত শুরু করেছেন। খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের নামে সারা দেশের জনগণের মধ্যে তিনি এক অনৈক্যের বীজ বপন করে চলেছেন। জনগণকে তিনি বোঝাতে চাইছেন, খ্রিষ্টধর্মই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম। গ্রিসের দেবদেবীদের লোকগাথা সম্পর্কে নানারকম ভুল মন্তব্য করে গ্রিসের প্রাচীন সংস্কৃতিকে তিনি ধ্বংস করবার মতলব ফেঁদেছেন। বাক্কাসের ধর্মের বিরুদ্ধে তিনি জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলছেন। এটা এখন স্পষ্ট যে, খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই তিনি এখানে এসেছিলেন। রোমের শাসকদের মদতপুষ্ট জেকোনেত্তা বাক্কাসের ধর্মের বিরুদ্ধে যেভাবে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলছেন এবং যেভাবে খ্রিষ্টধর্মের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন, দেশের ভেতর তা এক চরম দুরবস্থা বয়ে আনতে পারে।

নেস্টর: দেবতা প্রমিথিউসের নামে আমরা আমাদের স্বাধীন এই গ্রিক রাষ্ট্রের নাম রেখেছি থিউস। তিনি আমাদের এই রাষ্ট্রের নামকরণেরও সমলোচনা করছেন।

ক্রোনাস: ধর্মের নামে এরা অতীতে নানারকম হত্যা এবং সন্ত্রাসে লিপ্ত ছিল। মহীয়সী জেকোনেত্তার ভ্রাতা খ্রিষ্টধর্মের প্রধান পুরোহিত হিসাবে রোমে বহু লোককে পুড়িয়ে মেরেছিল। এরা হচ্ছে সেই সম্প্রদায়ের লোক যারা ধর্মের নামে বহু যুবককে, বহু জ্ঞানী ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। সম্রাট কন্স্টানটাইনের শাসনামলে বিদুষী ইমতিয়াকে প্রকাশ্য দিবলোকে আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়। জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা যাতে না হতে পারে সেজন্য বহু পাঠাগার, বহু গবষেণা কেন্দ্র এরা পুড়িয়ে দিয়েছিল। দেবরাজ জিউসের সম্মানে প্রবর্তিত অলিম্পিয়ার ক্রীড়া অনুষ্ঠান পর্যন্ত এদের চক্রান্তে বন্ধ হয়ে যায়। বহুদিনের গ্রীসের নাট্য ঐতিহ্য পর্যন্ত এরা সম্পূর্ণভাবে পালন করা নিষিদ্ধ করেছে।

হলোফার: মান্যবর ক্রোনাসের বক্তব্য আমরা শুনলাম। মহীয়সী জেকোনেত্তার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে আমি বিভিন্নভাবে আগেও অবগত ছিলাম। তবুও বিচার কার্যের নিয়ম অনুযায়ী আমি এবার অভিযুক্ত জেকোনেত্তার বক্তব্য শুনতে চাই।

জেকোনেত্তা: যদিও আমার মাথার ওপরে বিধি নিষেধের খড়গ ঝুলছে, তবুও আমি সত্য কথাই বলব। হ্যাঁ, খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই আমি এখানে এসেছিলাম। থিউসের স্বাধীনতার পর থেকে জেসাস খ্রিষ্টের ধর্মের প্রতি এ রাজ্যে কোনো রকম সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে না। রাজা হলোফারনেস স্বয়ং খ্রিষ্টধর্মের বিরুদ্ধে মদদ যোগাচ্ছেন।

নেস্টর:  রাজা হালাফোরনেস সম্পর্কে আপনার এ ধরনের অভিযোগের কারণ কী? মহীয়সী জেকোনেত্তা, আপনি ভালো করেই জানেন যে, উত্তরাধিকার সূত্রে আমাদের রাজা হলোফারনেস নিজেও একজন খ্রিষ্টান।

জেকোনেত্তা: উত্তরাধিকার সূত্রে। কথাটা ঠিকই বলেছেন। হ্যাঁ উত্তরাধিকার সূত্রেই তিনি একজন খ্রিষ্টান। কিন্তু মনে প্রাণে তিনি খ্রিষ্ট কিংবা কোনো ধর্মের প্রতি কোনো রকম শ্রদ্ধা পোষণ করেন বলে আমি মনে করি না।

হলোফার: মহীয়সী জেকোনেত্তা, রাজা হলাফোরনেস কোনো ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করেন কি করেন না, সেটা এখানে আলাচ্যে বিষয় নয়। প্রশ্ন হচ্ছে জেসাস ক্রাইস্টের ধর্মের বিরুদ্ধে এখানে কোনো নিপীড়ন চলছে কি না?

জেকোনেত্তা: অবশ্যই নিপীড়ন চলছে। নইলে যে দেশের ভেতরে প্রচুর খ্রিষ্টানের বাস সেখানে খ্রিষ্টের গীর্জা ভাঙা হয় কোন সাহসে। যারা গীর্জা ভাঙে কে তাদের সহায়তা দেয়?

ক্রোনাস:  জেকোনেত্তা, আপনি ভুল করছেন। যারা গীর্জা ভেঙেছে তারা কোনো অন্যায় করেনি। অন্যায় তারাই করেছিল, যারা একদিন বাক্কাসের মন্দির ভেঙে সেখানে গীর্জা স্থাপন করে। মহীয়সী জেকোনেত্তা, যে গীর্জাগুলো ভাঙা হয়েছে একদা তা ছিল দেবতা দিউনাসাসের মন্দির। সম্রাট কন্স্টানটাইনের শাসনামলে খ্রিষ্টানরা জোর করে ঐ মন্দিরগুলো দখল করে নিয়ে সেখানে গীর্জা নির্মাণ করে।

জেকোনেত্তা: বাক্কাসের মন্দির মূর্খ কৃষকদের পূজার জায়গা। যেখানে ধর্মের নামে মদ খেয়ে রাতভর হৈ হুল্লোড় চলে। একজন খ্রিষ্টান হিসাবে রাজা হলোফারনেস আপনি নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে জেসাস ক্রাইস্টের ধর্মই হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র সত্য ধর্ম। আর সে কারণেই বাক্কাসের মন্দির ভেঙে সেখানে গীর্জা নির্মাণ ছিল একটি পবিত্র কাজ।

হলোফার: জেকোনেত্তা, যে কাজটি শুধু আপনার পছন্দ, সেটা করা হলেই যে ন্যায় করা হবে এমন ভাবনা কি ঠিক? গ্রাম্য কৃষকরা সারাদিনের কাজের শেষে যে মন্দিরে মিলিত হয় এবং প্রাণ খুলে ফুর্তি করতে পারে সে মন্দিরের মূল্যও কম নয়। কারণ সেটা হচ্ছে শ্রমক্লান্ত মানুষের মিলনকেন্দ্র।

ক্রোনাস: খ্রিষ্টধর্ম হচ্ছে একজন মানুষের প্রচার করা ধর্ম। কিন্তু বাক্কাসের ধর্মের যে লোকাচার, এমনকি এ ধর্মের সমস্ত কিছুই সমগ্র জনগণ যুগযুগ ধরে মিলেমিশে সৃষ্টি করেছে।

হলোফার: বাক্কাসের ধর্ম শুধুমাত্র ধর্ম নয়। এটা এক লোক উৎসব। যেখানে মানুষ নিজেকে নতুন করে খুঁজে

নেস্টর: যেহেতু থিউসের সকলেই খ্রিষ্টান নয়, কিংবা বাক্কাসের ধর্মের অনুসারীও নয়, সে জন্য রাজার দায়িত্ব হচ্ছে সকলে যাতে নিজ নিজ ধর্ম সুবিধা মতো পালন করতে পারে সেদিকে নজর রাখা।

ক্রোনাস: বিগত বহু বছর যাবৎ এখানে ধর্মীয় ব্যাপারগুলো ভালাভোবেই চলছিল এবং প্রজারা নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পেরে সুখেই ছিল। কিন্তু জেকোনেত্তা, আপনি খ্রিষ্টধর্মকে কেন্দ্র করে এখানকার জনগণের মধ্যে নতুন এক ধর্মীয় উন্মাদনা জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করছেন।

নেস্টর: হ্যাঁ মহীয়সী জেকোনেত্তা, ধর্মের নামে আপনি দেশের জনগণকে দুটো ভাগে বিভক্ত করে ফেলছেন। একটি দেশের জন্য এর পরিণতি কত মারাত্মক হতে পারে তাও আপনি ভালো করে জানেন। এবং জেনেশুনেই আপনি তা করছেন।

ক্রোনাস: ভিন্ন রাজ্যের নাগরিক হিসাবে এ দেশের ধর্ম নিয়ে আপনার মাথাব্যথা দেখাবার কোনো যুক্তি নেই। ভ্রমণ উপলক্ষে আপনি এখানে এসেছেন ভ্রমণ সেরে আপনার এখান থেকে চলে যাওয়াই শ্রেয়। কিন্তু সেটা না করে আপনি ক্রমশই এখানকার ধর্ম নিয়ে নানা রকম খেলায় মেতে উঠেছেন। গত যুদ্ধে আপনাদের কুকীর্তির কথা আপনারা এত সহজে ভুলে গেছেন!

নেস্টর: যখন রোমান সাম্রাজ্যের বন্ধন থেকে মুক্ত হবার জন্য থিউসের জনগণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলো, সে সময় খ্রিষ্টধর্মের নামে আপনারা সে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। স্বাধীনতাকামী মানুষদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলেন।

ক্রোনাস: স্বাধীনতার প্রশ্নে গ্রিক হয়েও গ্রিক জাতির সাথেই আপনারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। নিজেকে আপনি আজ রোমান বলে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করেন।

জেকোনেত্তা: মান্যবর ক্রোনাস, এখানেই আপনারা ভুল করছেন। গ্রিকরা গ্রিকদের যতবড় বন্ধু হোক না কেন, ধর্ম তারও উর্ধ্বে। গ্রিক রাষ্ট্রকে সমর্থন করতে গিয়ে একজন খ্রিষ্টানের পক্ষে কোনো দিন খ্রিষ্টধর্মের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা কর সম্ভব নয়।

নেস্টর: ধর্মের নামে সেই জন্য নিজের দেশের বিরুদ্ধেই শত্রুকে সহযোগিতা করেছিলেন? তাদের হত্যা-লুট-নারীধর্ষণকে সমর্থন যুগিয়েছিলেন?

জেকোনেত্তা: মান্যবর নেস্টর, রোমের বিরোধিতা করা মানেই সেটা হতো খ্রিষ্টধর্মের বিরোধিতা করা। বিশেষ করে যখন আপনারা রোমানদের বিরোধিতা করতে গিয়ে, বিধর্মী বর্বর গথদের সাহায্য নিয়েছিলেন।

ক্রোনাস: রাজা হলোফারনেস সহ থিউসের প্রায় সকল খ্রিষ্টান রোমের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কারণ তাদের কাছে এটা ছিল স্বাধীনতা লাভের যুদ্ধ। রোমের শোষণ নিপীড়ন থেকে মুক্ত হবার যুদ্ধ। কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ ছিল না। যুদ্ধটা ছিল রোমানদের লুণ্ঠন আর শোষণের বিরুদ্ধে।
নেস্টর: এটা আপনাদের সৌভাগ্য যে যুদ্ধ শেষ।

ক্রোনাস: সেই ক্ষমা লাভের পাঁচ বছরের মধ্যে আপনারা কিনা আবার নতুন খেলায় মেতে উঠেছেন।
নেস্টর: জেকোনেত্তা, থিউসের ক্ষমতা লাভের দিকে আপনারা হাত বাড়াচ্ছেন। কিন্তু শুনুন, কোনোদিনই আর আপনারা এ দেশের শাসনক্ষমতা ভোগ করার সুযোগ পাবেন না। ধর্মের নামে অতীতে আপনারা জনগণের সাথে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, তা তারা আজও ভুলতে পারেনি।

জেকোনেত্তা: ভয় দেখিয়ে খ্রিষ্টধর্মের প্রসার রোধ করা যাবে না মান্যবর নেস্টর। মহান জেসাস ক্রাইস্ট হচ্ছেন ঈশ্বরের পুত্র। সম্রাট টাইবেরিয়াসের হুকুমে জেরুজালেমের শাসক পন্টিয়স সেই ঈশ্বরের পুত্রকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু এ হত্যার ফল কি দাঁড়ালো? জীবিত ক্রাইস্টের চেয়ে মৃত ক্রাইস্টই বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন! ক্রাইস্টের মৃত্যুর পরই তাঁর প্রচারিত ধর্ম মানুষের মন কেড়ে নিয়েছিল। ক্রাইস্ট মরে গিয়েই মানুষের মনে জেগে উঠলেন।

হলোফার: পৃথিবীতে এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে। জীবিত ব্যক্তির চেয়ে মৃত ব্যক্তি কিংবা তার মরদেহ বেশি সম্মান লাভ করেছে। জেসাস ক্রাইস্ট ছিলেন একজন মহান মানুষ সে নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু মহীয়সী জেকোনেত্তা, খ্রিষ্টধর্মের নামে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলা কিছুতেই চলবে না।

জেকোনেত্তা:  ধর্মের ব্যাপারে রাজার কোনো কর্তৃত্ব চলে না রাজা কায়াস হলোফারনেস। মনে রাখবেন, জেসাস ক্রাইস্টকে বাদ দিয়ে পৃথিবী একদিনও চলতে পারে না।

হলোফার: মহীয়সী জেকোনেত্তা, পৃথিবী এখন যেমন চলছে, জেসাস ক্রাইস্টের জন্মের আগেও পৃথিবী ঠিক তেমনি চলছিল। অতএব আপনার জেসাস ক্রাইস্টকে বাদ দিয়েও পৃথিবী চলতে পারে। জেসাস ক্রাইস্ট যখন ছিল না, তখনো জেসাস ক্রাইস্ট নেই বলে পৃথিবী কোনো দুঃখ প্রকাশ করেনি।

ক্রোনাস: সম্মানিত জেকোনেত্তা, খ্রিষ্ট নিজেই ছিলেন একজন ইহুদি। তিনি ছিলেন জেরুসালেমের  গ্যালিলাইয়ের এক কৃষক সন্তান। সুদখোর ইহুদিদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহ করেছিলেন সাধারণ মানুষের পক্ষে। তিনি কোনো ধর্ম প্রচার করেননি। তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য তরবারি হাতে বিদ্রোহ করেছিলেন । তিনি ক্রীতদাস সমাজের মুক্তি চেয়েছিলেন। কিন্তু খ্রিষ্টজগতের আপনারা, যিশুর আসল মহৎ উদ্দেশ্যটাকে বাতিল করে তাঁকে বানিয়েছেন খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তক। পুরাটাই আপনাদের বানানো গল্প।

হলোফার: ঠিক তাই জেকোনেত্তা! যিশু ধর্মপ্রচারক নন, তিনি ছিলেন বিদ্রোহী। তিনি জনগণের পক্ষে ইহুদি ধর্মের সংস্কার চেয়েছিলেন। কিন্তু যিশুর নামে আপনার একটা নতুন ধর্ম বানিয়ে তথাকথিত পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে মানুষের উপর নতুন ধরনের নির্যাতন চাপিয়ে দিয়েছেন।

জেকোনেত্তা: পাষণ্ড সম্রাট জুলিয়নের সুরেই আপনি কথা বলছেন। মাত্র পনের বছর আগে সম্রাট জুলিয়ন পূর্ব রোম সাম্রাজ্য থেকে খ্রিস্টধর্মকে বিতারিত করে আবার পুরানো দেব-দেবীদের ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি কি তা পেরেছিলেন? খ্রিষ্টের বিরোধিতা করতে গিয়ে উল্টো পাষণ্ড সম্রাট নিজেই ঘাতকের হাতে প্রাণ দিলেন।

হলোফার: জুলিয়ন খ্রিষ্টধর্মের বিরোধিতা করেছিলেন রোমানদের শাসন থেকে পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের গ্রীস ভূখণ্ডকে আলাদা করার জন্য, গ্রীসের পুরানো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার জন্য। খ্রিষ্টধর্মের বিরোধিতা করার জন্য আপনারা খ্রিষ্টানরা তাকে বলে থাকেন পাষণ্ড জুলিয়ন। কিন্তু সমগ্র গ্রীসে সম্ভব না হলেও থিউস রাষ্ট্র সম্রাট জুলিয়নের আকাঙ্ক্ষাকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেছে। থিউসে প্রাচীন দেব-দেবীর পূজা ফিরিয়ে এনেছে। থিউসকে রোমের শাসন থেকে স্বাধীন করেছে। যা আপনি বলেছেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো ধর্মেই আস্থা স্থাপন করি নাÑকথাটা ঠিক। কিন্তু সকল ধর্মের স্বাধীনতায় আমি বিশ্বাস করি।

জেকোনেত্তা: কিন্তু স্বাধীন থিউসের নাগরিকদের বিরাট একটি অংশই খ্রিষ্টান। খ্রিষ্টধর্ম আজ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। থিউসে খ্রিষ্টধর্মই প্রধান ধর্ম হওয়া দরকার। ঈশ্বরের পুত্র যিশুর ধর্মকেই সবার আগে মূল্যায়ন করতে হবে।

ক্রোনাস: যিশু যদি ঈশ্বরপুত্রই হোন, ঈশ্বর তার পুত্রকে পন্টিয়সের ক্রুশে বিদ্ধ হবার হাত থেকে রক্ষা করতে পারলেন না কেন? কিংবা কেন রক্ষা করলেন না?

জেকোনেত্তা: যিশু আবার ফিরে আসবেন। তিনি মারা যাননি। শীঘ্রই তাঁর পুনরুত্থান ঘটবে মান্যবর ক্রোনাস।
হলোফার: তিনি আর কোনদিনই ফিরে আসবেন না। জেকোনেত্তা, মানুষের মুক্তির জন্য তিনি প্রাণ দিয়ে গেছেন।

ক্রোনাস: যিশুখ্রিষ্ট স¤পর্কে আপনারা খ্রিষ্টানরা নানা মিথ্যা গল্প চালু করেছেন। বহু মিথ্যা ভাষণে আপনাদের গীর্জার ইতিহাস কলঙ্কিত।

নেস্টর: রাজা হলোফারনেসের কথাটাই সত্য, যিশু ছিলেন গালিলিয়ার এক কৃষক সন্তান। যিনি কোনো ধর্ম প্রচার করতে আসেননি। তিনি ছিলেন একজন সমাজ বিপ্লবী। যিশু যখন জেরুসালেমের মন্দিরে দেখেন, বনিকরা সেখানে টেবিল পেতে লেনদেনের ব্যবসা করছে, তিনি তখন টেবিল উল্টে দিয়ে বলেছিলেন, আমার পিতার গৃহকে বাজারে পরিণত করো না। তিনি বণিক ও ব্যবসায়িদের চাবুক মারতে মারতে সেখান থেকে বের করে দেন।

জেকোনেত্তা: জেরুসালেমের মন্দিরকে তিনি ধনী-দরিদ্র সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি সমস্ত মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করতে এসেছিলেন।
হলোফার: না, মহীয়সী জেকোনেত্তা। যিশুর ঘোষণা ছিল, আমি পৃথিবীতে এসেছি বিরোধ সৃষ্টি করতে। শিষ্যদের তাই তিনি বলেছিলেন, যার তরবারী নেই সে যেন নিজের পরিচ্ছদ বিক্রয় করে তরবারী কেনে। সংগ্রামী এক মনোভাব নিয়ে যিশুর জন্ম। দাস আর কৃষকদের মুক্তির কথা তিনি ভেবেছিলেন। ধনীদের তিনি মনে করতেন রক্তচোষার দল। তিনি বলেছিলেন, ধনীরা জনতার সর্বস্ব লুণ্ঠনকারী। যে-সব ধনীরা দাস-ব্যবসা করতো যিশু চেয়েছিলেন সেই সব ধনীদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটাতে। সেজন্যই তাকে হত্যা করা হয়। সে ইতিহাস আপনারা বিকৃত করেছেন, তাকে শান্ত সমাহিত ধর্মের ধ্বজাধারী করে তুলেছেন। জেকোনেত্তা, আপনাদের প্রচার করা খ্রিষ্টধর্ম আর খ্রিষ্টের বাণীগুলো এক নয়। রোমের শাসকরা নিজের মতো করে খ্রিষ্টের বাণীগুলোকে তৈরি করে নিয়েছে নিজেদের লুটপাটের স্বার্থে। চলবে