রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’

পর্ব ১০

প্রকাশিত : আগস্ট ০৩, ২০২১

বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

চতুর্থ দৃশ্য
(সময় রাত। দিউনাসাসেসর মন্দিরের অদূরে নগরের নির্জন প্রান্তে বসে সস্ত্রাতাস ও জোকাস্তা গল্প করছিল। আকাশে মাঝে মধ্যেই বজ্রপাতের শব্দ, ঝড় আসবার আশঙ্কা।)
জোকাস্তা: খ্রিষ্টানদের গীর্জার শাসনে নাটক মঞ্চায়ন নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু স্বাধীন থিউস রাষ্ট্রে নাটক নতুন প্রাণ পেয়েছে। সেজন্যই দিউনাসাসের মন্দিরের এই নাট্যোৎসব, যেখানে আমি গ্রীক ধ্রুপদী নাটকগুলোকে উপস্থাপন করতে চাই। ইস্কাইলাস, সোফোক্লিস, ইউরিপেডিস আর আরিস্তোফানেসের নাটকগুলো। সম্ভব হলে রোমের তেরেন্স ও সেনেকার নাটকগুলোও মঞ্চস্থ করার কথা ভাবছি।
সস্ত্রাতাস: রোমের প্লাইতুসের নাটকগুলোও তালিকায় রাখা দরকার। যুবকরা সেগুলো খুবই পছন্দ করে থাকে।

জোকাস্তা: প্লাইতুসের সস্তা হাস্যরস আমাদের দর্শকদের মানসিকতাকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। নাটকের কাজ দর্শকদের মানসিকতাকে উন্নত করা। বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠানে প্লাইতুসের নাটকের নামে যা দেখানো হয়, তা ক্ষতিকারক ভাড়ামি।
সস্ত্রাতাস: কিন্তু যারা ফুর্তি চায়, হৈ-হুল্লোর-চিৎকার-চেঁচামেচি করে আনন্দ পেতে চায়, সেইসব দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য তাহলে কী ব্যবস্থা থাকবে?

জোকাস্তা: মানুষের চিন্তা ও রুচি সর্বদাই পরিবর্তনশীল। দীর্ঘদিন ধরে রোমান সার্কাসের হৈ-হুল্লোর, গ্লাদিয়েতোরের দ্বন্দ্ব যুদ্ধ, রথচালনা প্রতিযোগিতা ও পশু ও মানুষের লড়াই দেখে দেখে যাদের রুচি নষ্ট হয়ে গেছে, সেইসব মানুষদের প্রতিও আমার এই সম্মান আছে যে, গ্রীসের উচ্চাঙ্গ নাট্যকলাও তাদের ভালো লাগবে। দরকার শুধু তাদের রুচির পরিবর্তন ঘটানো। সেজন্য আমার প্রথম পদক্ষেপ হবে দিউনাসাসের মন্দির থেকে যতসব সস্তা অশ্লীলতা দূর করা।
(দুজনেই দূরের দিকে তাকিয়ে কারো আগমন লক্ষ্য করছিল।)

সস্ত্রাতাস: বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এই রকম ঝড়ের রাতে নগরের নির্জন প্রান্তে বসেও দেখছি মানুষের উৎপাত। দেখো, কতগুলো লোক এদিকেই আসছে।
জোকাস্তা: মন্দিরের ঐদিকটাতে আমরা কি সরে দাঁড়াবো এখান থেকে?

সস্ত্রাতাস: দরকার নেই। দেখাই যাক না ওরা কারা।
(রাজা হলোফারনেসের প্রবেশ। সঙ্গে দেহরক্ষীরা)
হলোফার: ঝড়ের রাতে নগরের নির্জন প্রান্তে কে তোমরা? (রাজার সঙ্গীদের হাতের মশালে দেখা যায় জোকাস্তার মুখে মিষ্টি হাসি) বিজলীতে আর মশালের আলোতে যতদূর দেখতে পাচ্ছি মনে হচ্ছে জোকাস্তা?

জোকাস্তা: হ্যাঁ মহান রাজা, আমি জোকাস্তা। ও আমার বন্ধু, সস্ত্রাতাস। আপনি হয়তো ওর নাম শুনে থাকবেন। ও জিউস মন্দিরের একজন শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও কবি।
হলোফার: হ্যাঁ, ওর নাম আমি শুনেছি। যতদূর জানি থিউসের যুব সম্প্রদায়ের কাছে সস্ত্রাতাস খুবই জনপ্রিয়।

জোকাস্তা: মহান রাজা ঠিকই জেনেছেন।
হলোফার: প্রিয় জোকাস্তা, আজকের মতো এমন দুর্যোগের রাত তো নির্জন প্রান্তে বেড়ানোর জন্য মোটেই শুভ নয়। যদিও তোমার মন্দির কিছুটা নিকটেই। কিন্তু আমি বলবো, এখন দরকার গৃহের আশ্রয়।
জোকাস্তা: মহান রাজা, আপনি কি ভুলে গেছেন আপনার প্রথম যৌবনের দূরন্তপনার কথা। এমনি ঝড়ের রাতগুলোতেই আপনি আর ভ্রাতা ক্রোনাস খুব ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন। তখন সেই দুর্যোগের রাতে কখনো কখনো আমিও আপনাদের সঙ্গী হতাম।

হলোফার: সে তো আজ থেকে পনের বছর আগের কথা। সে সব স্মৃতি তোমার এখনো মনে আছে?
জোকাস্তা: কেন থাকবে না, ভ্রাতা ক্রোনাস কখনোই আমাকে সাথে নিতে চাইতেন না। কিন্তু আমি জেদ করতাম। আর তখন আপনি স্বয়ং আমার হাত ধরে বলতেন, চলো জোকাস্তা।

হলোফার: সব তাহলে তুমি স্মরণ রেখেছো। সে সব বেপোরোয়া দিনগুলোর কথা মনে এলে এখনো স্মৃতিতে আনন্দরা এসে ভিড় করে।
জোকাস্তা: মহান রাজা, সেই দিনগুলো সত্যিই খুব সুন্দর ছিল।

হলোফার: মাত্র চৌদ্দ বছরের কিশোরী তখন তুমি। সস্ত্রাতাস, আজকের জোকাস্তাকে দেখে সে কিশোরীকে তুমি চিনতে পারবে না।
জোকাস্তা: তখন আপনি খুব ঘন ঘন আমাদের বাসায় আসতেন। ভ্রাতা ক্রোনাস আর আপনার শিকার করে প্রচুর সময় কেটে যেত। আর কি প্রচুর মদই না খেতেন আপনি! আর আমাকে হোমার থেকে পাঠ করে শোনাতেন।

হলোফার: কেন সফোক্লিস, ইসকাইলাস? সস্ত্রাতাস, একবার আমরা অভিনয় করেছিলাম। জোকাস্তা, তোমার মনে পড়ে আমি হয়েছিলাম রাজা ক্রেয়ন আর তুমি আন্তিগোনে?
জোকাস্তা: মনে পড়ে মহান রাজা। সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম অভিনয়। ক্রোনাস আর আপনি দুজনে মিলে তখন আমায় আবৃত্তি শেখাতেন। কিন্তু আমি ভালো পারতাম না।

হলোফার: আজ তুমি দিউনাসাসের মন্দিরের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। শ্রেষ্ঠ আবৃত্তিকার এবং শিক্ষিকা।
জোকাস্তা: মহান রাজা, এর অনেক কিছুই আপনার দান। আমার প্রথম জীবনের সবকিছুই গড়ে উঠেছিল আপনার চেষ্টায়। প্লেটো, এ্যারিস্টটল আর সিসেরোরে রচনার সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল আপনার জন্যই। আপনি পড়তে খুব ভালোবাসতেন। মদ এবং পাঠ দুটোই আপনার সমান প্রিয় ছিল।

হলোফার: জোকাস্তা, ভগ্নি আমার; সেই অতীত থেকে রাজা হলোফারনেস এখন বিতাড়িত। পাঠের সময় এখন তার নেই। তার সময় কেটে যায় এখন শুধু রাজ্য পরিচালনায়।
জোকাস্তা: কিন্তু যখনই আমি আমার অতীতের কথা ভাবি, আপনার কথাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। আপনি সে সব দিনগুলোতে আমার জন্য নিয়ে আসতেন কতো চমৎকার চমৎকার পোষাক, খেলনা আর সে সাথে নানা গ্রন্থ। মা বলতেন, জোকাস্তা, এ হচ্ছে তোমার আর এক ভ্রাতা।

হলোফার: তোমার মা, তিনি আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। তার কাছে আমার অনেক ঋণ থেকে গেল। তিনি ছিলেন একজন চমৎকার মহিলা। সব সময় তিনি আমাকে নিজের সন্তানের মতো করেই দেখতেন।
জোকাস্তা: তখন আপনি সৈনিকের পোষাক পরতেন, এবং আপনাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগতো। মা বলতেন, ক্রোনাস একজন রাজপুরুষ হয়েও কায়াস হলোফারনেসের মতো সুন্দর নয়।

হলাফোর: ক্রোনাস আর আমি যখন প্রহরের পর প্রহর গল্প করতাম, তখন তোমার একমাত্র দায়িত্ব ছিল আমাদের জন্য খাদ্য আর পানীয় যোগান দেয়া। সস্ত্রাতাস, এ সব হচ্ছে আমাদের অতীত জীবনের স্মৃতিচারণ।
সস্ত্রাতাস: হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি একদা ক্রোনাস পরিবারের সাথে আপনার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে সম্পর্ক আজ অনেকটা স্মৃতিমাত্র।

হলোফার: না সস্ত্রাতাস। সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠই আছে। কিন্তু মানুষ হিসাবে আমরা পাল্টে গেছি। সময়ের স্রোত আমাদের ভিন্ন মানুষ বানিয়ে দিয়ে গেছে। দেখো, জোকাস্তাও আজ সেই শিশুটি নেই।
জোকাস্তা: মা আপনাকে আমায় নিজের ভ্রাতার মতো ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। কিন্তু আপনার বৈবাহিক জীবন এবং থিউসের স্বাধীনতা যুদ্ধ আপনাকে আমাদের পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল।

হলোফার: হ্যাঁ, থিউসের স্বাধীনতার পর ভীষণ রকম ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে সময় যাচ্ছিল। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাই আর তোমাদের সাথে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি। অথবা বলতে পারো নিজের ভাগ্য গড়ে নেবার কাজেই ব্যস্ত ছিলাম তখন।
সস্ত্রাতাস: সেটাই ছিল আপনার জন্য স্বাভাবিক। অতীতকে ভুলে গিয়ে শুধু নিজের ভাগ্য গড়ে তোলা।

হলোফার: সস্ত্রাতাস, মনে হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে তোমার অন্তরে অনেক ক্ষোভ জমে আছে?
সস্ত্রাতাস: রাজা হলোফারনেস, সাধারণ নাগরিকদের ক্ষোভে আপনার কি যায় আসে?

হলোফার: যখন জোকাস্তা তোমায় তার বন্ধু বলে দাবি করেছে, মনে রেখো রাজা হলোফারনেসও তখন তোমার বন্ধু। যুবক, এসো আমরা মন খুলে কথা বলি। ভুলে যাও, এখন আমি রাজা হলোফারনেস।
সস্ত্রাতাস: আমার অস্বীকার করবার উপয় নেই যে আপনার ব্যক্তিগত ব্যবহারে আমি মুগ্ধ। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, এখন আমার সামনে যে হলোফারনেস দাঁড়িয়ে আছেন এবং থিউসের রাজা হলোফারনেস কি একই ব্যক্তি?

হলোফার: মন খুলে কথা বলো সস্ত্রাতাস। বলো রাজা হলোফারনেসের বিরুদ্ধে তোমার কী অভিযোগ?
সস্ত্রাতাস: এই একটি অভিযোগই কি যথেষ্ট নয় যে, আপনি থিউসের গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন। সেনেতোরদেরকে অগ্রাহ্য করে সামরিক শক্তির প্রভাব খাটিয়ে আপনি রাজা হয়েছেন।

হলোফার: সেনেতোরদের শাসনকেই যদি তুমি শুধু গণতান্ত্রিক শাসন বলতে চাও, তাহলে আমার প্রশ্ন সেনেতোররা সবাই কি দেশপ্রেমিক? শাসকবর্গ যদি দেশপ্রেমিক না হয় তাহলে গণতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্রের পার্থক্য কোথায়?
সস্ত্রাতাস: কিন্তু সেনেতোরদের শাসন এক ব্যক্তির শাসন নয়। বহু ব্যক্তির শাসন। চলবে