রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’

পর্ব ১৫

প্রকাশিত : আগস্ট ১২, ২০২১

বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

হলোফার: নোংরা অতীত নিয়ে বাগাড়ম্বর করার ইচ্ছা আমার নেই। পুরানো দিনের কথা স্মরণ করতে গেলে তোমারই বেশি ক্ষতি হবে। হ্যাঁ, একদা তুমি আমার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলে, নিশ্চয় সেটা দয়া পরবশ হয়ে নয়, আমার কাছেও তোমার স্বার্থ ছিল।
ক্রানমার: হতে পারে। নাও হতে পারে হলোফারনেস। কার অনুরোধে ক্রোনাসের পিতা তোমায় সৈন্য বাহিনীর উঁচুপদ প্রদান করেছিল?

হলোফার: বিশ্বাস করবার যথেষ্ট কারণ আছে আমার, ক্রোনাসের পিতা আমার জন্য যা করেছিলেন তার মধ্যে হয়তো কোনো স্বার্থ ছিল না। হ্যাঁ, তোমার অনুরোধেই তিনি সেটা করেছিলেন। কিন্তু উচ্চপদস্থ সৈনিক হিসাবে আমি সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়ায় আমার চেয়ে তোমারই বেশি লাভ হয়েছিল। তোমার পণ্যবাহী যে সকল জাহাজ দূর সমুদ্রের পথে যাত্রা করতো, দেশের শুল্ক আইন, ফাঁকি দিয়ে আমার কারণেই তারা বিভিন্ন দেশে পৌঁছতে পারতো।
ক্রানমার: খুব সত্যি কথা। সেজন্য তোমার আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রতি আমি সব সময় নজর রাখতাম। চাকুরীর বেতনের চেয়ে তোমার ব্যয় দশগুণ বেশি ছিল। সে সেস্টাসগুলো কোথা থেকে আসতো? কে পাঠাতো?

হলোফার: ক্রানমার, তোমার স্বার্থেই তুমি পাঠাতে।
ক্রানমার: যদি সেদিন সৈন্যবাহিনীর উঁচুপদটা লাভ না করতে? থিউস সেদিন স্বাধীন রাজ্য ছিল না। যদি সেদিনকার রোম সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিকে আমি তোমার জন্য অনুরোধ না জানাতাম?

হলোফার: বলছি তো, তোমার সে উপকারের বহুগুণ প্রতিদান তুমি পেয়েছো। তোমার সে দয়ার কথা ভুলিনি বলেই, আজও তোমার বহু কুকর্ম আমি দেখেও না দেখার ভান করি। যদিও সেদিন তুমি আমায় দয়া দেখিয়েছিলে তোমারই স্বার্থে।
ক্রানমার: হলোফারনেস, সবটাই কি আমার স্বার্থ ছিল? বন্ধুত্ব কি ছিল না?

হলোফার: ক্রানমার, তোমার সাহায্য আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমার নিজের মেধার কথা ভুলে যেও না। থিউস যখন রোমের অধীন আর যখন গথদের সঙ্গে রোম সাম্রাজ্যের যুদ্ধ আরম্ভ হয়, গথদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমি বীরত্ব দেখিয়ে সৈন্যবাহিনীর আরো উঁচুপদ লাভ করি। নিজের বিশেষ যোগ্যতায় সে পদটা লাভ করেছিলাম।
ক্রানমার: নিশ্চয়। কয়েকবছর পর আবার যখন গথদেরই সহযোগিতা নিয়ে থিউস স্বাধীনতা ঘোষণা করে, হ্যাঁ, কম বীরত্ব তুমি দেখাওনি। দ্রুত সৈন্যবাহিনীর সর্বোচ্চ পদে চলে গেলে। নিজের সেই পদমর্যাদার বলে এবং কূটকৌশলে, স্বাধীন থিউসের পুরানো রাজা নিহত হলে তাঁর জায়গায় নিজেই রাজা হয়ে বসেছো।

হলোফার: এ সব প্রসঙ্গ থাক ক্রানমার। তার চেয়ে নাও, পান করো।
ক্রানমার: হলোফারনেস, সব সময় তোমরা ব্যবসায়ীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, আসছো। একবার নিজেদের দিকে তাকাও। তোমাদের কারো লোভ কি একজন ব্যবসায়ীর চেয়ে কম? শুধু সুযোগের অভাব। তারপরও তোমার বহু কুকীর্তির খবর আমার জানা আছে। ঘুষ গ্রহণ করে বহুজনকে বহু ব্যবসার সুযোগ তুমি দিয়েছে। আর সে সকল অর্থ নিরাপদেই লুকানো আছে।

হলোফার: হা হা হা। সে তো খুবই স্বাভাবিক ক্রানমার। চিরদিন যে আমি এ সিংহাসনে থাকতে পারবো তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। অতএব ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় থাকা অত্যাবশ্যক। ক্ষমতা চলে গেলে তোমরা সবাই যে আমার সাথে কুকুর বেড়ালের মতো ব্যবহার করবে সেতো আমি জানি।
ক্রানমার: হ্যাঁ, আইন তুমিই বানাচ্ছো আর সবার আগে সে আইন তুমিই ভাঙছো। অথচ কথায় কথায় প্রজা উন্নতির উদাহরণ দিতেও দেরি করছো না।

হলোফার: ক্রানমার, সত্যিকার ভাবে যদি আমি প্রজাদের মঙ্গলের জন্য কিছু করতে চাই, তোমরা কি কখনো সেটা আমায় করতে দেবে? কখনো দেবে না। ভালো কিছু একটা করবার আগেই তোমরা প্রজাদের আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলবে। আমাকে সিংহাসন ছাড়া করবে। (হঠাৎ স্বর পাল্টে) মাঝে মাঝে আমার কি ইচ্ছা হয় জানো, ইচ্ছা হয় তোমাদের মতো লোকগুলোকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলি। তারপর সকল রকম দুর্নীতির অবসান ঘটিয়ে ছেলেবেলার সেই সহজ সরল মনটি নিয়ে জনগণের জন্য কিছু করি। কিন্তু আমি জানি, তোমরা আমায় তা করতে দেবে না। কিছুতেই তা দেবে না। একজন শাসক আসলে সর্বদাই শৃঙ্খলিত। ক্ষমতার লোভ তাকে আরো বেশি শৃঙ্খল পরিয়ে দেয়। আর তখন সে আপোষ করে। আপোষ করতে করতে পুরো দেশকে সে নৈরাজ্যের মাঝে ঠেলে দেয়। নিজে শৃঙ্খলিত হয়। আর সে সাথে পুরো জাতিকে শৃঙ্খলিত করে।
ক্রানমার: হলোফারনেস, তোমার ছেলেবেলাকে তুমি ছেলেবেলাতেই হত্যা করেছো। তুমি আমি সবাই। পিছন ফিরে আর তাকিয়ো না। তাহলে তোমার অতীত তোমায় শান্তিতে থাকতে দেবে না। ভুলে যাও, ছেলেবেলার কথা ভুলে যাও।

হলোফার: ভোলা যায় না ক্রানমার। বয়স যতো বাড়ে ছেলেবেলার কথা ততই বেশি মনে পড়ে। তখনই মনে হয় একটা কিছু করি, প্রাণ দিয়ে হলেও। তারপর বুঝতে পারি হাত পা সব বাঁধা। কিছুই করার নেই শুধু ঘটনার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া ছাড়া। প্রতিটি ঘটনার নিজস্ব নিয়ম, নিজস্ব গতিবেগ আছে। পূর্ব বাস্তবতার কারণে আমাদের আকাঙক্ষা যার কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারে না।
ক্রানমার: হ্যাঁ হলোফারনেস, এই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সত্য। আমরা হচ্ছি ঘটনার ক্রীড়নক। ঘটনা যেভাবে খুশি আমাদের নিয়ে খেলছে। ঘৃণা কিংবা বিদ্বেষ,  এমনি ভালোবাসা, সবকিছুই এখানে আপাত। ঘটনা যেখানে তোমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, সেখান থেকেই তোমায় খেলে যেতে হবে, বিপরীত দিক থেকে নয়। ভিন্ন খেলা খেলতে চাওয়া মানেই মৃত্যু নিয়ে খেলা। রোমে জুলিয়াস সীজার ভিন্ন খেলা খেলতে গিয়েই মারা পড়েছিলেন। নিজের নির্দিষ্ট জায়গায়তেই ফিরে যাও হলোফারনেস।
(জেকোনেত্তাকে দেখা যায় ভেতরে প্রবেশ করতে। জেকোনেত্তার পরনে হুবহু আগের দৃশ্যের পোষাক।)

হলোফার: রানী জেকোনেত্তা, এসো। ক্রানমারের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেই। ক্রানমার, আমার স্ত্রী মহীয়সী জেকোনেত্তা। ক্রানমার আমার বন্ধু।
জেকোনেত্তা: সম্মানিত ক্রানমার, আপনার নাম বহুবার বহুজনের মুখ থেকে শুনেছি। আজ আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে আমি আনন্দিত।

ক্রানমার: আমিও ভীষণ আনন্দিত রানী। (গলার মালা খুলে) এটা আমার পক্ষ থেকে আপনার জন্য। দয়া করে এটা গ্রহণ করে আমায় অনুগ্রহ করুন। আমি মহীয়সী রানীর একজন সেবক।
হলোফার: কি করছো ক্রানমার! তুমি তোমার সব চেয়ে প্রিয় এবং সব চেয়ে মূল্যবান হীরার মালা জেকোনেত্তাকে দিয়ে দিচ্ছ!

ক্রানমার: প্রিয়জনদের সর্বদাই আমি মূল্যবান উপহার দিতেই পছন্দ করি। নিন, দয়া করে এটা গ্রহণ করুন। চলবে