রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘ক্রীড়নক’

পর্ব ১৭

প্রকাশিত : আগস্ট ১৪, ২০২১

বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে পুস্তক আকারে নাটকটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই নাটকটি দেশের সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। নাটকটার পটভূমি প্রাচীন যুগের কাল্পনিক এক গ্রীকরাষ্ট্রকে ঘিরে। থিউস রাষ্ট্রটাই কাল্পনিক, ভিতরের বাকি সার কথাগুলোর প্রায় সম্পূর্ণটাই ঐতিহাসিক। মহাত্মা আহমদ ছফা নাটকটি পাঠের পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘বহুদিন পর আমি গ্রিক ধ্রুপদী নাটক পাঠ করার আনন্দ পেয়েছি। নাটকটা আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করাবো। সারা বিশ্বকে আমি নাটকটা পড়াতে চাই, বাঙালিরা যে নাটক লিখতে জানে, সেটার প্রমাণ দিতে চাই।’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

ব্রাসিডাস: মহান রাজা হলোফারনেস দীর্ঘজীবী হোন।
হলোফার: থিউসের সকল প্রজারা দীর্ঘজীবী হোক।

ব্রাসিডাস: মহান রাজা, আমি এক ভীষণ দুঃসংবাদ দেয়ার জন্য এখানে এসেছি।
হলোফার: দুঃসংবাদ!

ব্রাসিডাস: হ্যাঁ, মহান রাজা, একটু আগে নগর প্রান্তরের নির্জন পুরানো কুঠিরের কাছে দুজন নাগরিকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। দুজনেই আমাদের খুব পরিচিত। একজন যুবক কবি সস্ত্রাতাস। আর অপরজন মান্যবর ক্রোনাসের ভগ্নি, জিউস মন্দিরের শিক্ষিকা ও অভিনেত্রী জোকাস্তা।
ক্রোনাস: হায় দেবতারা, এ আমি কি শুনছি!

ব্রাসিডাস: সস্ত্রাতাসকে পেছন থেকে ছুরি বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। আর প্রিয় জোকাস্তাকে হত্যা করবার পূর্বে তার নারীত্বকে অপমান করা হয়েছে।
ক্রোনাস: হায় দেবতাগণ, একি বিশ্বাস করবার মতো কথা! মাত্র গতকাল বিকেলে তার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছে। সে এসেছিল তার নতুন নাটক সম্পর্কে কথা বলার জন্য।

নেস্টর: ভেঙে পড়বেন না মহামান্য ক্রোনাস। ঘটনাকে মেনে নিতে চেষ্টা করুন। শান্ত হয়ে বসুন। হয়তো এখনো অনেক দুঃসংবাদ শোনা বাকি রয়ে গেছে।
ক্রোনাস: কেমন করে আমি বিশ্বাস করবো জোকাস্তা আর বেঁচে নেই। সে ছিল আমার প্রাণাধিক প্রিয়।

নেস্টর: যা সত্য, যা ঘটে গেছে তাকে বিশ্বাস না করে উপায় নেই মান্যবর। এ সময় ধৈর্য ধারণই হচ্ছে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
হলোফার: মাত্র কয়েকদিন আগে সে তার স্বামীকে হারালো। আর আজ সে নিজেই বেঁচে নেই। সবাই বলতো, জোকাস্তা ছিল নগরের সবচেয়ে সুন্দর মনের অধিকারী। ছোট-বড় সবাই তাকে ভালাবোসতো। মানুষের মন জয় করার সমস্ত ক্ষমতা তার জানা ছিল। গতকাল রাতে জোকাস্তা আর সস্ত্রাতাসকে আমি নগর প্রান্তে নাটক নিয়ে কথা বলতে দেখি। আমিও তখন তাদের সাথে খানিকটা সময় ব্যয় করি।

ক্রোনাস: মহান রাজা, সে আর বেঁচে নেই তা কি বিশ্বাস করা সম্ভব? জিউসের মন্দিরে ঈগল পাখিরা নোংরা খাবার ফেলে দিয়ে কি তার এই অশুভ সংবাদই পরিবেশন করেছিল!
হলোফার: মান্যবর ক্রোনাস, এ ঘটনায় আমি আপনার মতো সমান শোকাভিভূত। তবুও আমাদের শান্ত থাকতে হবে। আমাদের দায়িত্ব এ সময় ভেঙে পড়া নয়। দোষী ব্যক্তিদের চরম শাস্তি দানের জন্য তৈরি হওয়া। জোকাস্তা শুধু একজন সামান্য নাগরিক নয়। সে দিউনাসাস মন্দিরের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, এবং একজন শিক্ষিকা। আর সস্ত্রাতাস একজন শক্তিমান কবি। এ দুই হত্যাকাণ্ডের বিচার অবশ্যই হতে হবে।

ব্রাসিডাস: দুটো মৃত্যু ঘটেছে একই দিনে এবং রাজধানীর অভ্যন্তরে। ব্যাপারটা খুবই রহস্যপূর্ণ। মহান রাজা, এ নিশ্চয় কোনো সাধারণ লোকের কাজ নয়। এর পেছনে নিশ্চয় কোনো শক্তিশালী লোক রয়েছে।
হলোফার: জোকাস্তার খুনী যেই হোক চরম শাস্তি তাকে পেতেই হবে। জোকাস্তাকে যে হত্যা করেছে সে আমার আপন ভগ্নিকে হত্যা করেছে। সেনাধ্যক্ষ ব্রাসিডাস, সমস্ত গুপ্তচরকে বলে দিন যেভাবে হোক আগামী সাতদিনের মধ্যেই জোকাস্তা আর সস্ত্রাতাসের খুনীদের খুঁজে বের করতে হবে।

জেকোনেত্তা: মহান রাজা, গতকাল রাতে জোকাস্তা আর সস্ত্রাতাসকে একসঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে। যার অর্থ দাঁড়ায় সস্ত্রাতাস প্রথমে জোকাস্তাকে জোরপূর্বক ভোগ করে এবং পরে হত্যা করে।
ক্রোনাস: না। সেটা কখনোই সম্ভব নয়। সস্ত্রাতাস আর জোকাস্তা পরস্পরকে ভালাবোসতো। তাদের অবাধ মেলামেশায় কখনো আমি বাধা দেইনি। কারণ সস্ত্রাতাস জোকাস্তাকে বিয়ে করবার কথা দিয়েছিল। মহানুভব, সস্ত্রাতাসের পক্ষে জোকাস্তাকে হত্যা করা সম্ভব নয়।

হলোফার: আমারও তাই ধারণা। সে সাহসী এবং স্পষ্টবাদী। গতকাল তার সাথে সামান্য আলাপেই আমি বুঝতে পেরেছি, পেছন থেকে কাউকে হত্যা করার লোক সে নয়। এ কাজ অন্য কারো হাতে ঘটেছে। এ কথাও তো সত্য, সস্ত্রাতাস যদি জোকাস্তাকে হত্যা করে, তাহলে সে নিজে মারা পড়লো কী কারণে?
জেকোনেত্তা: মহান রাজা, এমন তো হতে পারে জোকাস্তাকে যখন সস্ত্রাতাস হত্যা করে তখন জোকাস্তার কোনো নিকট আত্মীয় তা দেখতে পায়, এবং সে নিকট আত্মীয়ই পরে সস্ত্রাতাসকে হত্যা করে।

হলোফার: জেকোনেত্তা, যে ভাবে তুমি হিসাবটা মেলাতে চেষ্টা করছো, সেভাবে হিসাবটা এক্ষেত্রে মেলে না। জোকাস্তার একমাত্র নিকট আত্মীয় হচ্ছে মান্যবর ক্রোনাস। ক্রোনাসের পক্ষে এ কাজ অসম্ভব।
জেকোনেত্তা: হ্যাঁ, মান্যবর ক্রোনাসের পক্ষে এ কাজ আবশ্যই অসম্ভব। এবং মান্যবর, ক্রোনাস যদি বোনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সস্ত্রাতাসকে হত্যা করে, সেজন্য কোনোভাবে তাকে দোষও দেয়া যাবে না।

হলোফার: জোকাস্তা আর সস্ত্রাতাসকে কে হত্যা করেছে সে খবর গুপ্তচররা ঠিকই বের করে ফেলবে। খুনের সাথে সাথে খুনী তার চিহ্নও রেখে যায়। সে খুনী যেই হোক, ক্রোনাস কিংবা আমি কিংবা অন্য কেউ, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। জোকাস্তার মৃত্যু আমার কাছে ভিন্ন এক ঘটনা। এ যেন কোনো শিশুর চোখের সামনে থেকে চাঁদ কেড়ে নেয়া। যান সেনাধ্যক্ষ, খুনীদের খুঁজে বের করুন।
(কথা শেষ করে হলোফারনেস বের হয়ে যায়। নেস্টর ক্রোনাসের কাছে এগিয়ে যায়।)
 
নেস্টর: ক্রোনাস, আপনার ভেঙে পড়বার কোনো কারণ নেই। খুনের সাথে যে আপনি জড়িত নন তার সাক্ষী আমি। কারণ গতকাল সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আমি আপনার সাথেই ছিলাম। চলুন, আপনাকে গৃহে পৌঁছে দিয়ে আসি।
(ক্রোনাস ও নেস্টর বের হয়ে গেলে রানী সেনাধ্যক্ষের মুখোমুখী হয়।)

জেকোনেত্তা: সেনাধ্যক্ষ, রাজা হলোফারনেস খুনীদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব আপনার ওপর অর্পণ করেছেন। আমার মনে হয়, মন প্রাণ দিয়ে আপনার সে কাজটি করা উচিত।
ব্রাসিডাস: নিশ্চিত থাকবেন মহান রানী, খুব শীঘ্রই আমি খুনীদের খুঁজে বের করবো। গুপ্তচরদের পূর্বেই সব খবরাখবর নিতে বলা হয়েছে। দু-একদিনের মধ্যেই হয়ত খুনীদের সন্ধান পাওয়া যাবে।

জেকোনেত্তা: খুনীদের নাম জানার সঙ্গে সঙ্গে যদি খবরটা আমার কাছে পৌছে দেন খুশি হবো। এটা রাখুন। (নিজের গলা থেকে মালা খুলে দেয়) বন্ধু হিসাবে আপনাকে, আমার উপহার। যদি আমাদের বন্ধুত্ব ঠিকঠাক বজায় থাকে হরহামেশাই আপনার জন্য এমন উপহার মিলবে।
ব্রাসিডাস: মহামান্যা রানী যে তার বন্ধু হিসাবে আমাকে গ্রহণ করেছেন সে জন্য আমি কৃতার্থ। দরকার হলে প্রাণ দিয়ে এ বন্ধুত্বের সম্মান আমি রক্ষা করে যাব।

জেকোনেত্তা: সময় মতোই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
ব্রাসিডাস: প্রমাণ করবার সময় ও সুযোগ যদি কখনো আসে আমি মহামান্য রানীকে অবশ্যই হতাশ করবো না।

জেকোনেত্তা: আজকের মতো আমাদের কথাবার্তা এখানেই শেষ। আবার কাল কিংবা পরশু দেখা হবে। খুনী যেই হোক, খবরটা যেন সবার আগে আমাকেই দেয়া হয় সেনাধ্যক্ষ ব্রাসিডাস। ভালো কথা, আমার পুত্রের নামটা কি আপনার জানা আছে? ওর নাম হিস্টাফাস। হিস্টাফাস সম্পর্কেও কখনো কোনো খবর পেলে আমাকে জানাবেন।
ব্রাসিডাস: নিশ্চয় মহামান্য রানী। আপনি কোনো রকম দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি সর্বদা আপনার অনুগত এবং বিশ্বস্ত বন্ধু।

(সেনাধ্যক্ষের প্রস্থান)
জেকোনেত্তা: বাঁচা গেল! যদি কোনোভাবে গুপ্তচরদের মাধ্যমে হিস্টাফাসের কথা জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে রাজার আগেও সে খবরটা আমিই পেয়ে যাবো। এতে করে হিস্টাফাস পালাবার সুযোগ পাবে। এক পুত্রকে আমি অকালে হারিয়েছি। দ্বিতীয় পুত্রকে আর কোনোভাবেই হারাতে চাই না। (হিস্টাফাসের প্রবেশ) হিস্টাফাস, কাল রাতে তোমার গায়ে এ জামাটাই তো ছিল?
হিস্টাপাস: হ্যাঁ মা। কিন্তু সে কথা কেন জানতে চাইছো?

জেকোনেত্তা: বড় বিপদ হিস্টাফাস। দেখি তো, তোমার জামার সবগুলো বোতাম ঠিক আছে কি না। হ্যাঁ সবগুলো বোতামই তো ঠিক রয়েছে দেখছি। আর কোনো ভয় নেই তাহলে। চলবে