রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘দূরের মানুষ কাছের মানুষ’

পর্ব ২

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৩

দ্বিতীয় অংশ
(ভাস্কর এবং তরুণীটি বসে আছে দুটো চেয়ারে। খুব সাধারণভাবে সাজানো। তাদের ঠিক উল্টোদিকেই বয়স্ক একজন মানুষ বসে আছেন। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন।)

 

বয়স্ক: প্রথমেই আমি খুব লজ্জিত এবং ক্ষমা প্রার্থী তোমাদের দুজনের কাছে। খুব চালাকির সঙ্গে এবং খুবই অন্যায়ভাবে তোমাদেরকে এভাবে ধরে নিয়ে আসতে হলো।
ভাস্কর: ধরে নিয়ে আসার কৈফিয়ত দিচ্ছেন।
বয়স্ক: কথাটা হলো, এই মানব-বিশ্ব বহুদিন যাবৎ এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে, না চাইলেও আমরা অপরাধ করতে বাধ্য হই। সত্যি বলতে মানব সভ্যতার সৃষ্ট এই বিশ্ব ব্যবস্থা টিকেই আছে অপরাধ-দ্বারা।
তরুণী: সন্দেহ নেই আপনি চমৎকার কথা বলেন।
বয়স্ক: সত্যি?
ভাস্কর: কিন্তু আমাদের ধরে আনার কারণটা ব্যাখ্যা করুন।
বয়স্ক: বলছো কি? তোমাদের মেধা তো আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করেছে?
ভাস্কর: কারণ?

 

বয়স্ক: যথেষ্ট মেধাবী হিসেবে তোমারা পরিচিত। দু-জন তারুণ্যে-ভরপুর বিজ্ঞানীকে এখানে ধরে আনলাম কেন সেটা তোমাদের জানার কথা।
তরুণী: সন্দেহটা অনেকক্ষণ ধরে আমার মনের ভিতরে ছিল। কারণটা বুঝতে পারছিলাম কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে বলতে চাইনি।
বয়স্ক: খুব স্বাভাবিক। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলে না।
তরুণী: ভাস্কর অনেক মেধাবী কিন্তু সরল প্রকৃতির। ফলে সে ব্যাপারটা সন্দেহ করেনি। কারণ তার ভিন্ন যুক্তি আছে।
বয়স্ক: কী সেটা?
তরুণী: ভাস্কর কিছুদিন আগে বিরোধী এক রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়েছে। সেদেশের জন্য কিছু করতে চায়। সেজন্য তার মনে হয়েছিল, সরকার বিরোধী রাজনীতিতে যোগ দেয়ার জন্য এটা সরকারী কোনো বাহিনীর কাজ। রাজনীতি থেকে তাকে সরিয়ে দিতে চায়।
বয়স্ক: সম্মানিত ভাস্কর তাহলে বুঝতে পারেনি, এটা এমন এক ব্যক্তির কাজ সব সরকার যাকে খুশি রেখে চলে।

 

ভাস্কর: কাজটা যে গণমানুষের বিরোধী কেউ করেছে সেটা বুঝেছিলাম। কিন্তু আপনার প্রতিষ্ঠানের মানুষগুলোর সুন্দর ব্যবহার দেখে বোঝা যায়নি, এটা আপনারই কাজ। নিঃসন্দেহে আমি বলবো, আপনার প্রতিষ্ঠানের মানুষগুলোর ব্যবহার অনেক সুন্দর।
বয়স্ক: প্রয়োজনের সময় আমার নির্দেশে তারা সকলেই খুব ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে?
ভাস্কর: কখন আপনার মানুষগুলো আমাদের উপর ভয়ংকর হয়ে উঠবে?
বয়স্ক: মনে হয় তার দরকার হবে না।
তরুণী: কেন?
বয়স্ক: কারণ ভয়ংকর না হয়েও অনেক কাজ আদায় করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমি তোমাদের বয়সটাকে বিবেচনা করেছি।
ভাস্কর: বয়স দিয়েই কি আপনি আমাদের সবকিছু বিচার করছেন?

 

বয়স্ক: ঠিক তা নয়। বয়সের বিবেচনায় তোমরা অনেক বেশি মেধাবী। আমাকে স্বীকার করতে হবেই, তোমরা নিখুঁত কাজ করো। তোমাদের কাজে আমি মুগ্ধ। যদিও তোমরা দু-জন আমার সাম্রাজ্যের ভিতকে বেশ ভালোই নড়িয়ে দিয়েছো। কিন্তু তোমাদের কর্মকৌশল এবং মেধার আমি প্রশংসা করি।
তরুণী: যখন আমরা একটা ভাড়া করা বাহনে নাট্যশালার দিকে নাটক দেখার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম, বুঝতে পারিনি ভাড়া করা বাহনটাকে আপনি ফাঁদ হিসেবে আমাদের জন্যই রেখে দিয়েছিলেন। চালকের সন্দেহজনক আচরণ দেখে কিছু বুঝে উঠবার আগেই বুঝতে পারি, চারদিকের প্রায় সবগুলো গাড়িও আপনার পাঠানো।
বয়স্ক: শুধু চারদিকের প্রায় গাড়িগুলো নয়, পথে সেদিন তুমি যতো সরকারী লোকজনকে দায়িত্ব পালন করতে দেখেছো, তাদের অধিকাংশই ছিল আমার সুবিধাপ্রাপ্ত।
ভাস্কর: পালাবার সামান্য পথ রাখেননি আমাদের জন্য।

 

বয়স্ক: সম্ভব ছিল না। কারণ তোমরা আমাকে বিরাট বিপদে ফেলে দিয়েছো। বিভিন্ন রকম আমার অপরাধের বহু তথ্য তোমাদের দুজনের হাতে চলে গেছে। তোমরা দুজনেই তোমাদের তীক্ষ্ণ মেধা কাজে লাগিয়ে তোমাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির সাহায্যে আমার তথ্যভাণ্ডারে গোপনে ঢুকে পড়েছিলে।
ভাস্কর: ভয় পাচ্ছেন, আপনার শত শত মানুষ হত্যা আর লুণ্ঠনের খবর ফাঁস হয়ে যাবে মনে করে।
বয়স্ক: না ভয়টা সেখানে নয়। সবাই সব জানে। জানার ভয় নেই। কিন্তু প্রমাণ করতে পারছে না কেউ। কিন্তু এখন তোমাদের কাছে সেই প্রমাণগুলো রয়েছে। তোমরা আমার তথ্যভাণ্ডার থেকে তা চুরি করেছো।
ভাস্কর: যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রমাণগুলো চলে যায়, তাহলে বিপদ হবে আপনার।

 

বয়স্ক: না, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে চলে গেলে ভয়ের কিছু নেই আমার। কারণ সেখানকার প্রায় সকল বড় কর্তারা আমার ক্রয় করা। কখনো তারা আমার বিরুদ্ধে মুখ খুলবে না।
তরুণী: ভয় তাহলে কাকে আপনার?
বয়স্ক: বিরুদ্ধ পক্ষকে। বিরুদ্ধ পক্ষ এসব তথ্য হাতে পেলে মাঠে নেমে পড়বে। দরকার হলে আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত যাবে। কয়েকজন বিদেশী পর্যন্ত আমার হাতে মারা পড়েছে।
ভাস্কর : আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে নয়, ভয়টা তাহলে আপনার বিরুদ্ধ পক্ষকে?

 

বয়স্ক: নিশ্চয়। বৃহৎ এক ভূমিদস্যু যেমন আমি, তেমনি আরো ভূমিদস্যু আছে। অপরাধ সাম্রাজ্য যেমন আমার আছে, বিরুদ্ধ পক্ষেরও আছে। দু-পক্ষই আমরা একদিকে পেশাগত বন্ধু, ভিন্ন দিকে পরস্পরের প্রতিযোগী। যদি তথ্যগুলো তাদের হাতে চলে যায় অবশ্যই আমার বিপদ হতে পারে। [কফি নিয়ে একজন প্রবেশ করে] নাও, কফি খাও।
ভাস্কর: কথাটা হলো, আপনার হাতে অনেক নিরীহ মানুষও মারা পড়েছে।
বয়স্ক: কখনোই তা অস্বীকার করি না। যখন আমি অপরাধের জগতকে নিয়ন্ত্রণ করছি, তখন সেটা ঘটা স্বাভাবিক। সত্যি বলতে আইনশৃঙ্খরা বাহিনী এ ব্যাপারে আমার সবচেয়ে বড় সহযোগী।
তরুণী: রাজনৈতিক দলগুলো?
বয়স্ক: ক্ষমতাসীন দল এবং আরো অনেক দল না চাইলে কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাকে সাহায্য করতে পারতো?

 

ভাস্কর: রাজনৈতিক দলগুলো কেন আপনাকে সাহায্য করে?
বয়স্ক: কারণ এখানে তাদের সুবিধা এবং ভাগ আছে। মানুষ কি কখনো একা অপরাধ করতে পারে? মনে রাখবে, অপরাধের বিস্তৃত এক জাল পাতা আছে। বিশ্বজুড়েই আছে?
তরুণী: [কফির কাপে চুমুক দিয়ে] বুঝতে পারছি, আপনার কণ্ঠে আপোসের সুর। নিশ্চয় কিছু একটা বলতে চান আমাদেরকে।
বয়স্ক: হ্যাঁ।
ভাস্কর: বলে ফেলুন।

 

বয়স্ক: সবচেয়ে বড় সঙ্কট হচ্ছে এবার তোমাদের বয়স। বয়সটা তোমাদের কম বলেই আমি নিজেই তোমাদের সঙ্গে কথা বলছি।
ভাস্কর: যদি অন্যরা কথা বলতো?
বয়স্ক: রুঢ় আচরণ করে ফেলতে পারতো তোমাদের সঙ্গে। হয়তো তোমাদের বয়স আর মেধা বিবেচনায় রাখতো না।
তরুণী: দুজনের আলোচনার পদ্ধতি যতই ভিন্ন হোক, মূল ফলাফল কি একই দাঁড়াতো না?
বয়স্ক: না। কারণ তারা সহজেই মাথা গরম করতো, তাতে আলোচনার ফলাফল ভিন্ন হতো।
তরুণী: কিন্তু আপনার সঙ্গে আলোচনায় অতিরিক্ত কী সুবিধা পাবো?

 

বয়স্ক: ধরো যদি তোমাদের দুজনকে আর ফিরে যেতে না দেই আমার তথ্যগুলো আর কারো হাতে পড়বে না বলেই আমার ধারণা। কিন্তু আমি তোমাদের মুক্ত করে দিতে চাই।
ভাস্কর : কিন্তু এতোটা নিশ্চিত হলেন কী করে যে, তথ্যগুলো অন্য কারো হাতে যায়নি? কাউকে আমরা ইতিমধ্যেই দিয়ে দেইনি?
বয়স্ক: যদি তথ্যগুলো আরো কারো কাছে পাচার করে দিয়ে থাকো, তাহলে তোমাদের সঙ্গে আমার আলোচনা সম্ভবত এখানেই শেষ হবে। কখনোই তোমরা আর ফিরতে পারবে না। তোমাদের ব্যাপারটা চুকিয়ে দিয়ে ইতিমধ্যে যাদের কাছে তথ্য চলে গেছে তখন তাঁদের খুঁজতে চেষ্টা করবো।
ভাস্কর : যদি তথ্যগুলো অন্যদের হাতে না গিয়ে থাকে?

 

বয়স্ক: নিশ্চয় সেটা তোমাদের জন্য মঙ্গলের হবে। সেক্ষেত্রে তোমাদেরকে বলবো, তথ্যগুলো আমাকে ফিরিয়ে দিতে। বিনিময়ে তোমরা যা চাও, তাই দেয়া হবে।
ভাস্কর : যদি তথ্যগুলো ফিরিয়ে দিতে না চাই?
(হঠাৎ বয়স্ক ব্যক্তির চেহারাটা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। কিন্তু কণ্ঠটা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে।)

 

বয়স্ক: ক্ষমা চেয়ে নিয়েই বলতে হচ্ছে, খুব দুঃখজনক ঘটনা ঘটবে। তোমাদের বয়সটাকে হয়তো তখন আর বিবেচনায় রাখা যাবে না।
তরুণী: কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, তথ্যগুলো আপনাকে ফিরিয়ে দেবো না। কারণ আমরা চাই আপনার কৃতকর্মের একটা উপযুক্ত বিচার হোক।
(খুব ঠাণ্ডা মাথায়)
বয়স্ক: যতক্ষণ তোমরা এখানে আছো, তথ্যগুলো তোমাদের কাজে আসবে না। তথ্যগুলো পড়ে থাকবে বস্তাবন্দী হয়ে।
ভাস্কর: যদি আমরা এখান থেকে মুক্তি পাই।
বয়স্ক: সম্ভাবনা নেই। সামান্য সম্ভাবনা নেই।
তরুণী: যদি আমরা মুক্তি নাও পাই, কখনো না কখনো তথ্যগুলো কারো হাতে পড়বেই।
বয়স্ক: যাতে না পড়ে সে ব্যবস্থা নেবো। কিন্তু আমার ভয়টা সেখানেই, যদি কারো হাতে পড়ে।
ভাস্কর: ভয় পাচ্ছেন তাহলে?

 

বয়স্ক: (কথাটা গায়ে না মেখে) দুজনেই তোমরা মেধাবী। খুব সম্মানজনক একটা প্রস্তাব রাখছি তোমাদের কাছে। আমার কোনো প্রতিষ্ঠানে কিংবা নিজেরা তোমরা স্বাধীনভাবে একটা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে বিজ্ঞানের যে-কোনো বিষয়ে গবেষণা করো। যতো অর্থ লাগে আমি দেবো। কারণ আমি জানি বিজ্ঞানকে বহুদূর তোমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু চুরি করা তথ্যগুলো আমাকে ফেরত দিয়ে দাও।
ভাস্কর: সবচেয়ে বড় বড় চুরিগুলো তো আপনিই করেছেন। যতোরকম লুটাপাট রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি চুরি করে নিজের প্রাসাদ বানিয়েছেন।
বয়স্ক: সামান্য মিথ্যা বলনি।
তরুণী: ভাস্করের অভিযোগ তাহলে মেনে নিচ্ছেন?

 

বয়স্ক: খুব ভালো করেই আমি জানি আমি কে? হাত আমার কতো জনের রক্তে রক্তাক্ত সেটা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। কিন্তু তার জন্য জবাবদিহি কাউকে আমি করি না।
ভাস্কর: বুঝতে পারছি। এবার জবাবদিহি করতে হবে, তাই ভয় পাচ্ছেন।
বয়স্ক: দুজনে তোমরা বুঝতেই পারছো না, তোমাদের বয়সের কারণেই আমি তোমাদের ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করছি।
তরুণী: সেজন্য অবশ্যই আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।
বয়স্ক: যা বলছি শোনো, তোমাদেরকে আমার প্রস্তাব দেয়া হয়ে গেছে। এবার ভেবে দেখো। পরে কথা হবে। চলবে