রাহমান চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘বাংলার ১৯৩৬ থে‌কে ১৯৭১ সাল’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪

বিগত শত‌কের ১৯৩৬ থে‌কে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলা ভূখণ্ড ছিল নানাভা‌বে সরকারবি‌রোধী সংগ্রা‌মে উত্তপ্ত এবং শিল্পকলা ও সা‌হিত‌্য জগ‌তের নতুন দিগন্ত রচনার সময়। ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৪ সা‌লে প্রথমবার ভার‌তের ক‌মিউনিস্ট পা‌র্টি‌কে নি‌ষিদ্ধ ঘোষণা ক‌রে। এর আগে ঘ‌টে অনেকগু‌লো ঘটনা। দেশ‌প্রেমিক সূর্য‌সে‌নের নেতৃ‌ত্বে ১৯৩০ সা‌লে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণসহ বি‌ভিন্ন দেশ‌প্রেমিক সংগ্রামী‌দের নানারকম ব্রিটিশবি‌রোধী অভিযান। সরকারের পক্ষ থে‌কে চ‌লে নানারকম অত‌্যাচার।

ব্রিটিশ শাসক‌দের কারাগারগু‌লো ভ‌রে গি‌য়ে‌ছিল দেশ‌প্রেমি‌কে। তার ভিতর দি‌য়েই ১৯৩৪ সা‌লে রুশ বিপ্লব বা‌র্ষিকী পা‌লিত হয়। সেই একই সম‌য়ে শ্রমিক আন্দোলন বৃ‌দ্ধি পে‌তে থা‌কে বি‌ভিন্ন কারখানায়। শ্রমিক-কৃষক আন্দোল‌নের প্রশ্নে জাতীয় কং‌গ্রেসের রাজ‌নৈ‌তিক পদ‌ক্ষেপ‌কে দেশবাসী, বি‌শেষ ক‌রে স্বাধীনতা-প্রেমিক মানুষ মে‌নে নি‌তে পার‌ছিল না। ১৯৩৪ সা‌লে ক‌মিউনিস্ট পা‌র্টি‌কে নি‌ষিদ্ধ ক‌রে ইং‌রেজ সরকার ১৯৩৫ সা‌লে ভারত শাস‌নের নতুন সং‌বিধান ঘোষণা ক‌রে।

এরপর থে‌কে ব্রিটিশবি‌রোধী ভারতীয় রাজনী‌তির দু‌টি প‌ক্ষের চ‌রিত্র স্পষ্ট হ‌য়ে ওঠে। যা‌দের এক পক্ষ‌কে বলা হ‌তো দ‌ক্ষিণপন্থী, অপর পক্ষ‌কে বামপন্থী। সেই বামপন্থী‌দের ঘি‌রে এবং বামপন্থী‌দের নেতৃ‌ত্বে বঙ্গ‌দে‌শে তথা সমগ্র ভার‌তে নতুন ধর‌নের শিল্প-সা‌হিত‌্য সৃ‌ষ্টির জোয়ার তৈ‌রি হয়। হি‌ন্দি লেখক মুনসী প্রেমচন্দের সভাপ‌তিত্বে ১৯৩৬ সা‌লে‌ লখ‌নৌ‌য়ে অনু‌ষ্ঠিত লেখক স‌ম্মেলন থে‌কে গ‌ড়ে ওঠে ‘প্রগ‌তি লেখক সংঘ’। সেই সম‌য়েই প্রতি‌ষ্ঠিত হয় ‘নি‌খিল ভারত ছাত্র ফেডা‌রেশন’, যার উদ্বোধন ক‌রেন জওহরলাল নেহরু এবং অনুষ্ঠা‌নে সভাপ‌তিত্ব ক‌রেন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ।

সেই বছ‌রেই গ‌ঠিত হয় ‘নি‌খিল ভারত কিষাণসভা’। সেই ১৯৩৬ সা‌লে জওহরলাল নেহরুর উদ্যো‌গে প্রতি‌ষ্ঠিত হয় ‘নি‌খিল ভারত ব‌্যক্তি স্বাধীনতা সংঘ’। সম্মা‌নিত সভাপ‌তি ছি‌লেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সভাপ‌তি স‌রো‌জিনী নাইডু। তখন বি‌ভিন্ন কারখানায় শ্রমিক ধর্মঘট বাড়‌ছিল। ১৯৩৬ সা‌লে বাংলায় শ্রমিক ধর্মঘ‌টের সংখ‌্যা ছিল ১৬৭। ১৯৩৭ সা‌লের নির্বাচন প্রথম বয়কট করার কথা ব‌লে আবার নির্বাচ‌নে অংশ নেয় কং‌গ্রেস। গান্ধীর অনুসারীরা সংসদীয় রাজনী‌তি ও মন্ত্রিত্ব গ্রহ‌ণের প‌ক্ষে ছি‌লেন। সুভাষ বসুর অনুগামীরা ব্রিটিশ শাস‌নে সংসদীয় গণত‌ন্ত্রে আস্থা রাখ‌তে পা‌রেন‌নি।

নির্বাচ‌নে জয়লাভ ক‌রে ১৯৩৭ সা‌লে কং‌গ্রেস প্রা‌দে‌শিক শাসন ক্ষমতায় ব‌সে যখন সকল প্রদে‌শে জোর ক‌রে হি‌ন্দি চা‌পি‌য়ে দি‌তে চেষ্টা ক‌রে, অন্ধ প্রদে‌শে তার বিরু‌দ্ধে ব‌্যাপক প্রতিবাদ হয়। ভারতব‌র্ষের প্রথম ভাষার জন‌্য আন্দোলন সেটা। এর কিছুকাল প‌রেই কং‌গ্রেস দ‌লের স‌ঙ্গে ক‌মিউনিস্ট পা‌র্টির বি‌চ্ছেদ অবশ‌্যম্ভাবী হ‌য়ে ওঠে। শিল্প- সা‌হিত‌্য সৃ‌ষ্টির ক্ষে‌ত্রে সেই পার্থক‌্য লক্ষ‌্য করা গেল। ত্রিশের দশ‌কের মাঝামা‌ঝি যখন ‌বি‌শ্বের ক‌য়েক‌টি র‌া‌ষ্ট্রে ফ‌্যা‌সিবাদ মাথাচাড়া দেয় তখন সারা বি‌শ্বে ফ‌্যা‌সিবাদ বি‌রো‌ধিতাও প্রবল হ‌য়ে ওঠে।

১৯৩৬ সা‌লের মার্চ মা‌সে হিটলার রাইনল‌্যা‌ন্ডে তার সেনাবা‌হিনী পাঠা‌লো। সেই বছ‌রের মে মা‌সে মু‌সো‌লি‌নি আক্রমণ কর‌লো আবি‌সি‌নিয়া। জুলাই মা‌সে জেনা‌রেল ফ্রা‌ঙ্কো বি‌দ্রোহ কর‌লো স্পে‌নের প্রজাতন্ত্রী সরকা‌রের বিরু‌দ্ধে। স্পে‌নে গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হ‌লো। গণত‌ন্ত্রের প‌ক্ষে বহু শিল্পী সা‌হি‌ত্যিক স্বতঃপ্রবৃত্ত হ‌য়ে যোগ দি‌লেন। যুদ্ধে নিহত হ‌লেন ইংল‌্যা‌ন্ডের ভাস্কর ফে‌লি‌সিয়া বাউন, লেখক র‌্যালফ ফক্স ও ক্রিস্টোফার কডও‌য়েল। স্পে‌নের বিখ‌্যাত ক‌বি লোরকা মারা গে‌লেন ফ‌্যা‌সিস্টদের হা‌তে। এই সময় থে‌কে শিল্পী সা‌হি‌ত্যিক‌দের ম‌ধ্যে নতুন চিন্তা দেখা দি‌য়ে‌ছিল।

তারা অ‌নে‌কেই বল‌লেন, `এখন তাঁ‌দের শুধু বাস্তববাদী হ‌লে চল‌বে না, বাস্ত‌বের মু‌খোমু‌খি দাঁড়া‌তে হ‌বে একজন যোদ্ধা হি‌সে‌বে।` গায়ক পল রোবসন স্পে‌নের গণত‌ন্ত্রের সমর্থ‌নে আয়ো‌জিত লন্ড‌নের বিরাট সমা‌বে‌শে বার্তা পাঠা‌লেন। সেখা‌নে বল‌লেন, `সকল সা‌হি‌ত্যিক, শিল্পী ও বিজ্ঞানী‌কে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নি‌তে হ‌বে সে কোন প‌ক্ষে দাঁড়া‌বে। তাঁ‌দের জন‌্য বিকল্প নেই, বর্তমান সংঘ‌র্ষের কোন এক প‌ক্ষে দাঁড়া‌তেই হ‌বে। নির‌পেক্ষ দর্শক হ‌য়ে ব‌সে থাকার সু‌যোগ নেই।` বি‌ভিন্ন দে‌শের শিল্পী সা‌হি‌ত্যিকরা আবেদন রাখ‌লেন অন‌্যদের কা‌ছে লেফট রি‌ভিউ প‌ত্রিকার মাধ‌্যমে।

তারা বল‌লেন, `পৃ‌থিবী‌তে এখন এমন একটা সময় এসে‌ছে যা ইতিপূ‌র্বে কখ‌নো ঘ‌টে‌নি। নির‌পেক্ষ থাকার সু‌যোগ নেই এ সম‌য়ে, তাই আমরা সিদ্ধান্ত নি‌য়ে‌ছ, আমরা এক প‌ক্ষে দাঁড়া‌বো।` মানবসভ‌্যতা রক্ষা এবং প্রগ‌তির প‌ক্ষে দাঁড়া‌লেন তারা। পরবর্তী সময় চে‌কো‌শ্লোভা‌কিয়া আক্রান্ত হ‌লো, পোল‌্যান্ড আক্রান্ত হ‌লো, চী‌নের উপর জাপানী আগ্রাসন চল‌লো। নানান দে‌শে ফ‌্যা‌সিবাদী আক্রম‌ণের বিরু‌দ্ধে সর্বভারতীয় প্রগ‌তি লেখক সংঘ ইতিবাচক ভূ‌মিকা রা‌খে।

সর্বভারতীয় প্রগ‌তি লেখক সং‌ঘের প্রথম সূত্রপাত হ‌য়ে‌ছিল আস‌লে লন্ড‌নে। ইতিপূ‌র্বে ১৯৩৫ সা‌লের জুন মা‌সে প‌্যা‌রিস সম্মেল‌নে আন্তর্জা‌তিক ফ‌্যা‌সিস্ট বি‌রোধী লেখক সংঘ গ‌ড়ে ওঠে। তার দ্বিতীয় সভায় ভার‌তের প্রতি‌নি‌ধিত্ব ক‌রেন তরুণ লেখক মুলকরাজ আনন্দ। স‌ম্মেল‌নে আরম্ভ হবার আগে থে‌কে ইংল‌্যা‌ন্ডে পাঠরত ক‌য়েকজন ভারতীয় ছা‌ত্রের মাথায় ঢু‌কে‌ছিল, আন্তর্জা‌তিক ফ‌্যা‌সিস্ট বি‌রোধী আন্দোল‌নে যুক্ত হ‌তে হ‌বে ভারতবর্ষ‌কেও। সেই ঘটনার প‌রি‌প্রেক্ষি‌তে ১৯৩৬ সা‌লে গ‌ঠিত হয় প্রগ‌তি লেখক সংঘ। ফ‌্যা‌সিবাদ সম্প‌র্কে তখ‌নো ভার‌তের প্রত‌্যক্ষ অ‌ভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু ব্রিটিশ শাস‌নের পরাধীনতার গ্লা‌ণি তাঁ‌দের মাথায় ছিল।

মুনসী প্রেমচান্দ সং‌ঘের প্রথম ভাষ‌ণে দু‌টি কথা ব‌লে‌ছি‌লেন প্রতিষ্ঠা‌নের চিরন্তন আদর্শ হি‌সে‌বে, ভ্রাতৃত্ব এবং সাম‌্য। বাংলায় অল্প‌ কিছু‌দিন পর প্রগ‌তি লেখক সং‌ঘের শাখা গ‌ঠিত হয়। স‌ন্দেহ নেই সাম‌্যবাদী‌দের চিন্তার প্রভাব ছিল এই সংগঠ‌নে কিন্তু সক‌লের ম‌তের মানুষ জ‌ড়ো হ‌য়ে‌ছিল। ভুল বোঝা‌বো‌ঝিও হ‌য়ে‌ছিল। বুদ্ধ‌দেব বসু প্রগ‌তির ব‌্যাপা‌রে অত‌্যুৎসাহী হ‌য়ে রবীন্দ্রনাথ‌কে আক্রমণ ক‌রে বস‌লেন। রবীন্দ্রনাথ‌কে বা‌তিল করার কথাও তি‌নি ব‌লে‌ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ স্বভাবতই এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন। তি‌নি অমিয় চক্রবর্তীর কা‌ছে লেখা চি‌ঠি‌তে প্রগ‌তিবাদী‌দের সম্প‌র্কে বিরূপ মন্তব‌্য ক‌রেন। কিন্তু এই আন্দোলন‌কে রবীন্দ্রনাথ সমর্থনই দি‌য়ে‌ছি‌লেন, প্রগ‌তি লেখক সংঘ রবীন্দ্রনাথ‌কে বাদ দি‌য়ে চ‌লেনি।

জওহরলাল নেহরু এই সময় ফ‌্যা‌সিবাদ বি‌রোধী বক্তব‌্য রাখ‌তেন আন্তর্জা‌তিক সভায়। ১৯৩৭ সা‌লে যখন চীন আক্রান্ত হয় জাপানী‌দের দ্বারা, তখন কং‌গ্রেস চী‌নের প‌ক্ষে দাঁ‌ড়ি‌য়ে‌ছিল। কং‌গ্রেস তখন বারবার ঘোষণা ক‌রে‌ছে তারা ফ‌্যা‌সিবাদ ও নাৎসীবা‌দের বিরু‌দ্ধে। ১৯৪০ সা‌লে ক‌মিউনিস্ট‌দের সহ‌যো‌গিতায় গ‌ঠিত হয় ইয়ুথ কালচারাল ইন্স‌টি‌টিউট। ক‌লিকাতা বিশ্ব‌বিদ‌্যাল‌য়ের স্নাত‌কোত্তর প‌র্বের সেরা ছাত্রছাত্রীরা নি‌জে‌দের ম‌ধ্যে প্রচুর আড্ডা দি‌তেন, নাচগা‌নের আসর জমা‌তেন, আবার গুরুতর বিষ‌য়ে অফুরন্ত আলোচনা চালা‌তেন। নি‌জে‌দের ম‌ধ্যে কথা বল‌তেন শিল্পকলা, রাজনী‌তি এসব নি‌য়ে। সেই সব আড্ডায় থাক‌তেন দেবব্রত বিশ্বাস, দেবব্রত বসু, রামকুষ্ণ মু‌খোপাধ‌্যায়, অম্বিকা ঘোষ, জ‌লি কাউল, স‌রোজ দত্ত, সুনীল চ‌ট্টোপাধ‌্য‌্যায়,  চিন্মোহন সেনাহবীশ, উমা চক্রবর্তী প্রমুখ।

দেবব্রত বিশ্বা‌সের প‌রিচালনায় ইয়ুথ কালচারাল ইন্স‌টি‌টিউট রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসা‌দের সম‌বেত দেশাত্ম‌বোধক গা‌নের অনুষ্ঠান শুরু ক‌রে‌ছি‌লেন। নাটক লেখা হাত দিল এই প্রতিষ্ঠা‌নের অ‌নে‌কে।  পুরা‌নো বা চল‌তি নাটক নয়, সমা‌জের বৃহত্তর সঙ্কট নি‌য়ে নাটক লিখ‌তে আরম্ভ কর‌লেন। প্রথম হ‌লো ইং‌রে‌জি নাটক, তারপর কিছু‌দি‌নের ম‌ধ্যে বাংলা নাট‌কের অভিনয় আরম্ভ হ‌লো।‌ পেশাদার নাট‌্যচর্চার বিপরী‌তে বর্তমান সম‌য়ের বাংলার বি‌ভিন্ন ধর‌নের নাট‌্যচর্চা বা নাট‌্য আন্দোল‌নের সেটাই ছিল শুরু। ব‌ণেশ দাশগুপ্তের উপর আক্রমণ, সো‌মেন চন্দ‌কে হত‌্যার ঘটনা‌কে কেন্দ্র ক‌রে ১৯৪২ সা‌লে গ‌ঠিত হয় নি‌খিল বঙ্গ ফ‌্যা‌সিস্ত‌-বি‌রোধী শিল্প ও লেখক সংঘ। সেই সম‌য়ে গ‌ড়ে ওঠে ভারতীয় গণনাট‌্য সংঘ বা ইপ্টা বা আইপিটিএ, বাংলার নাট‌্য ও গণসঙ্গী‌তে জগ‌তে যার অবদান বিরাট।

ত্রিশের দশ‌কের মাঝামা‌ঝি ভার‌তের স্বাধীনতা এবং ফ‌্যা‌সিবাদ-বি‌রোধী আন্দোলনকে ঘি‌রে বাংলার শিল্প সা‌হিত্যের জগৎ ভিন্ন দি‌কে মোড় নেয়। য‌দি লক্ষ‌্য করা যায় দেখা যা‌বে, তখন থে‌কেই বাংলায় এক‌দি‌কে রাজ‌নৈ‌তিক আন্দোলন এবং সেই স‌ঙ্গে শিল্পকলার আন্দোলন দু‌টোই বিস্তার লাভ কর‌তে থা‌কে। রবীন্দ্রনাথ নজরুল প্রমুখ‌কে স‌ঙ্গে নি‌য়ে শিল্পকলার নতুন যাত্রাপথ তৈ‌রি হয়। শিল্প সা‌হি‌ত্যের ক্ষে‌ত্রে বি‌ভিন্ন সব প্রতিভার দেখা মে‌লে। অবিভক্ত বাংলায় তো ব‌টেই, ১৯৪৭ সা‌লের পর সরকার বি‌রোধী রাজ‌নৈ‌তিক আন্দোলন দুই বাংলা‌তেই ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তা ব‌্যাপক রূপ লাভ ক‌রে। পাশাপা‌শি মার্কসবাদে বিশ্বাসী দলগু‌লোর বহু সদস‌্য নি‌জে‌দের সর্বস্ব ত‌্যাগ ক‌রে জনগ‌ণের প‌ক্ষে বিপ্লব সাধন করার জন‌্য। বামপন্থী‌দের ম‌ধ্যে অনেক বিভ্রা‌ন্তি আর বি‌ভেদ ছিল, ঠিক‌ যেমন ছিল প্রগ‌তিশীল ডানপন্থী‌দের ম‌ধ্যে।

কিন্তু রাজ‌নৈ‌তিক অঙ্গন উত্তাল ছিল সরকা‌রের নানা অন‌্যায় অত‌্যাচা‌রের বিরু‌দ্ধে। বি‌শেষ ক‌রে শিল্পী সা‌হি‌ত্যিকদের বড় অংশটাই ছিল জনগ‌ণের স‌ঙ্গে। সরকা‌রের প‌ক্ষে তখ‌নো চাটুকার ছিল, কিন্তু সবাই ক্ষমতার ভাগ নেয়ার জন‌্য চাটুকা‌রি ক‌রে‌নি। সেই রাজ‌নৈ‌তিক পর্বগু‌লো, সেই সম‌য়ের শিল্প সা‌হি‌ত্যের আন্দোলনগু‌লো আজ‌কের প্রজন্ম তো জা‌নেই না, গত প্রজন্ম পর্যন্ত জা‌নে না। যখনকার কথা বলা হ‌চ্ছে, তখন শিল্প সা‌হি‌ত্যের চর্চা কর‌তে বা আন্দোলন চালা‌তে সরকা‌রী পদক দরকার হয়‌নি, মন্ত্রণাল‌য়ের আর্থিক সাহায্যের জন‌্য মানুষ করুণা ভিক্ষা ক‌রে‌নি। জনগণ ছিল তা‌দের ভরসার জায়গা। মুকুন্দ দাশ যে নি‌জের সঙ্গীত দি‌য়ে বিরাট জনগণ মা‌তি‌য়ে তু‌লে‌ছি‌লেন কিংবা বাংলার গণনাট‌্য সংঘ যে বিরাট কর্মযজ্ঞ আরম্ভ ক‌রে‌ছি‌লেন তা সরকা‌রের পৃষ্ট‌পোষকতা নি‌য়ে নয়। বরং তা‌দের স‌ঙ্গে ছিল সর্বস্ত‌রের জনগণ। সেই ইতিহাসগু‌লো এখন ক্রমাগত নতুন প্রজ‌ন্মের সাম‌নে আনা দরকার। সকল রকম ইতিহাস রচনার পাশাপা‌শি বাংলার ১৯৩৬ সাল থে‌কে ১৯৭১ সা‌লের রাজনী‌তি এবং শিল্প সা‌হি‌ত্যের নি‌র্মোহ ইতিহাস লেখা এবং প্রচা‌রের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।

লেখক: প্রাবন্ধিক