রাহমান চৌধুরীর স্মৃতিগদ্য ‘জাতধর্ম’
প্রকাশিত : নভেম্বর ১৮, ২০২০
ষাট দশকের শুরুতে আমরা ফেঞ্চুগঞ্জ থাকতাম পিতার সরকারি চাকরির কারণে। আমাদের বাসভবন সংলগ্ন মূল সড়কের উল্টোদিকে কিছুটা খালি জমিতে থাকতেন একটি কুলি পরিবার এবং তাদের আত্মীয় আরেক পরিবার। দুটি পরিবারই ছিল খুব দরিদ্র। দুটি পরিবারের দুটি ছোট কুঁড়েঘর ছিল। কুলি যার কথা বলছি, তি অনেক সময় আমাদের মালপত্র মাথায় করে ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে দিতেন। কুলি মানুষটির দীর্ঘ গোঁফ ছিল, খুব সরল কিন্তু রাশভারি ধরনের। মাঝে মধ্যে রাতের বেলা মদ খেয়ে দুটি পরিবারের কর্তারা পাড়া মাথায় তুলতেন, সকালে এসে আবার আব্বার কাছে দুঃখ প্রকাশ করতেন। কিন্তু আব্বা তাদেরকে স্নেহের সঙ্গে শাসন করতেন।
কুলি পরিবারের স্ত্রীটি ছিলেন খুব হাসিখুশি ধরনের হালকা পাতলা গড়নের। তিনি বলতে গেলে আম্মার বন্ধু ছিলেন। প্রায় বিকেলে এসে আম্মার সঙ্গে গল্প করতেন। তখন আমি এতটা ছোট যে, সেসব গল্পের সবটা বুঝতে পারতাম না। স্বামীর বিরুদ্ধে তার অভিযোগ ছিল বলে মনে হয় না। কারণ আম্মার সঙ্গে তিনি মিষ্টিমুখ নিয়ে গল্প করতেন আর পান খাওয়া লাল ঠোঁটে হাসি লেগেই থাকতো সারাক্ষণ। আমরা ওনাকে মাসিমা ডাকতাম। তার পুত্র হেমরাজ আর কন্যা সুভদ্রা ছিল আমাদের খেলার সাথি। দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র তখন আমি। প্রথমে সেখানকার উচ্চবালিকা বিদ্যালয় ভর্তি হয়েছিলাম, পরে পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলে যাই। তখন বহু বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বালকরা পড়াশুনা করতে পারতো।
সুভদ্রা আমার সমবয়সী বা সামান্য বয়সে বড় আর খেলার সাথি। সে আর হেমরাজ বিদ্যালয়ে যেতে না। সম্ভবত তেমন সামর্থ ছিল না। সুভদ্রা প্রায় পাশের হাসপাতালের নিচের টিউবওয়েল থেকে নিজেদের পরিবারের খাবার পানি কলসিতে ভরে মাথায় করে বহন করে আনতো। হঠাৎ একদিন কী হলো, সুভদ্রা মাথায় করে কলসিতে পানি নিয়ে আসছিল। আমি তখন ওর হাত ছুঁয়ে বললাম, `বাসায় পানি রেখে খেলতে চলে আয়।` সঙ্গে সঙ্গে সুভদ্রা কী করলো, মাথার উপর থেকে কলস ভরা সব পানি রাস্তায় ফেলে দিল আর রেগেমেগে চলে গেল। চলে গেল আমাদের বাসায়। বুঝতে পারলাম না কী হলো! বাসায় গিয়ে শুনছি সুভদ্রা আম্মার কাছে নালিশ করছে, আমি ওর খাবার পানি ছুঁয়ে দিয়েছি। সেজন্য নাকি সব পানি ফেলে দিয়েছে।
আমি ওর নালিশ শুনে মনে মনে ভাবলাম, কীরকম ডাহা মিথ্যা বলে মেয়েটা! কখনো আর ওর সঙ্গে মিশবো না। আম্মা সুভদ্রাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ঠিক আছে মা, আমি এর বিচার করবো।
সুভদ্রা চলে গেল। গিয়ে এবার নিজের মায়ের কাছে চিৎকার করে একই অভিযোগ করলো আমার বিরুদ্ধে। বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি তা শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হলো, সুভদ্রা মায়ের কাছে নালিশ জানিয়ে সুবিধা করতে পারেনি। বিকেলবেলা, আব্বা তখন অফিসে। আম্মা আমাকে ডেকে পাঠালেন বিচারপর্ব সেরে ফেলবার জন্য। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কেন এমন কাজ করেছি। বললাম, `সে মিথ্যা বলেছে।` সাধারণত আমার উপর আম্মার আস্থা ছিল, আর এরকম কাজ করার ছেলে যে আমি না, সেটাও জানতেন। কিন্তু তবুও বললেন, `সুভদ্রা কি মিথ্যা বলেছে তুমি এমনটা না করলে?` মাথায় জেদ চেপে গেল আমার, খুব জোর দিয়ে বললাম, `আমি এমন করিনি। সুভদ্রা মিথ্যা বলেছে। ওকে আর এ বাসায় ঢুকতে দেবে না।`
আম্মা বললেন, সে তোমার বন্ধু, কেন তুমি তার খাবার পানি এভাবে নষ্ট করেছো, সেটা বলো। বললাম, আম্মা, আমি তা করিনি। মিথ্যা অভিযুক্ত হয়ে আমার তখন প্রায় কান্না চলে আসছিল। কিন্তু আম্মা কঠোর থাকলেন।
হঠাৎ সেখানে হাজির হলেন মাসিমা, মানে সুভদ্রার মা। বাসায় ঢুকেই সামান্য ভূমিকা না করে আম্মাকে বললেন, দিদি, তাকে বকবেন না। সুভদ্র ঠিক কথা বলেনি। আম্মা বিস্মিত তখন। মাসিমাকে বললেন, `সুভদ্রা যে বললো, ও তার জল ছুঁয়ে দিয়েছে।` মাসিমা তখন হাসছেন মিষ্টি করে। বললেন, `দিদি, এ আমাদের জাতধর্ম। সুভদ্রা মাথায় করে পানি নিয়ে আসছিল, ও তখন তার হাত ছুঁয়েছে শুধু খেলায় নিয়ে যাবার জন্য। দিদি, আমাদের ধর্মে তাতে জল ছোঁয়া হয়ে যায়। আপনার ছেলে জল ছোঁয়নি।`
আম্মা এমন ঘটনা নিজেও জানতেন না, আমি শুনে পর্যন্ত থ। মাসিমা আমাকে বললেন, `বাবা তুমি রাগ করো না সুভদ্রার উপরে। আমাদের এমনই নিয়ম।` কথাটা শুনে সুভদ্রার উপর থেকে আমার রাগ আসলেই কমে গিয়েছিল। আম্মা নিজের আচরণে অনুতপ্ত হয়ে আমাকে তার কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তোমাকে না বুঝে শুধু শুধু বকেছি।
যদি সেদিন আজকের মতো বয়স আর অভিজ্ঞতা থাকত, হয়তো সেদিন আম্মাকে বলতাম, `পুরোটা না জেনে না বুঝে আমরা শুধু মানুষদের ভুল বুঝি, বকা দেই আর শাস্তি দিয়ে থাকি। সব সত্য সঠিকভাবে জানতে চেষ্টা করি না।`
লেখক: সমাজ ও ইতিহাস গবেষক