রাহেলা বুয়া

মোহাম্মদ আলী

প্রকাশিত : মে ১৯, ২০১৯

অফিস যাবার জন্য বের হয়েছি। হঠাৎ কান্না শব্দ কানে ভেসে এলো। সিঁড়ির নিচে বসে রাহেলা বুয়া কাঁদছে। আমাকে দেখে আরও জোরে হু হু করে কেঁদে উঠল। পিঠ বের করে দেখাল। কিভাবে মেরেছে আলম সাহেবের মেয়ে! রাহেলা আলম সাহেবের বাসায় ঝিয়ের কাজ করে।

রাহেলা বুয়া প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে। শুরু করে কাজ। ঘরদোর পরিষ্কার করে রান্না বসায়। আলম সাহেব ও তার বিবি অফিস যান সকাল আটটায়। তাদেরকে রুটি, ভাজি ও ডিম পোচ দিতে হয়। ছোট নাতি লেবু বিছানা ছাড়ে ছয়টায়। কেমন করে রান্না রেখে নাতিকে কোলে নেবে রাহেল বুয়া?

রাণী ও জামাই ঘুম যায় দুপুর বারোটা পর্যন্ত। বাবুটা দুধের জন্য কান্না করে। সেই জন্য রাণী প্রায়ই রাহেলা বুয়াকে চড়থাপ্পড় মারে। রাহেলা বুয়া চরম অপমান বোধ করে। রাণী তার মেয়ের বয়সী। আজ যখন রাণী চুল ধরে তাকে পিটাচ্ছিল, তখন আলম সাহেব কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাহেলা এবার বুঝতে পেরেছে তার পায়ের তলায় মাটি নেই।

রাহেলার স্বামী রবি যৌতুকের জন্য তাকে এভাবে মারধর করত। মেয়ে হওয়ার জন্য তাকে তালাক দেয়। রাহেলা সেই থেকে একা। বরিশাল থেকে লঞ্চে ঢাকা আসে সেই দিনই। ভেবেছিল গ্রামে ফিরে গেলে মুখ দেখাবে কেমন করে? তালাক! কথা মনে করে কেঁপে উঠে রাহেলা।

শহর থেকে আবার গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। যার বেতন ছিল বারোশত টাকা। দুই বছরের বেতন ফেলে জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে হচ্ছে। একজন বিধবা যেমন ছাল তোলা নিম গাছের মতো। রাহেলাও আজ তাই। তার কোনো পরিচয় নেই। ভাসমান একজন মানুষ। গুলিস্তান থেকে লঞ্চে যাবে সে। কিন্তু লঞ্চ ভাড়া নেই।

বাবা শহিদ মুক্তিযোদ্ধা। বাবা বেঁচে থাকলে রাহেলার জীবন হতো ভিন্ন রকম। লঞ্চ ঘাটের সূর্যের মতো রাহেলাও যেন ঢলে পড়ে। জীবনের অর্থ খুঁজে পায় না রাহেলা। বাঁশি বেজে লঞ্চ ছাড়ল। রাহেলা রাত্রি কাটাবে কোথায়? পান দোকানদার দোকান গুটাচ্ছে। রাহেলা তার পা জড়িয়ে ধরে বলল, বাবা, আমাকে বাঁচাও। আমি এত রাতে কই যাব? আমার যাবার কোনো জায়গা নেই।

রহমত তাকে মেয়ে ডাকল। ছোটবেলা তার মেয়ে কনা মরে যায়। তার কনার কথা বুকে নদীর ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে। সে একবার রাহেলাকে তার বাড়ি নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সমাজের কথা চিন্তা করে তার বুক ছ্যাৎ করে উঠে। যদি সমাজ তাকে এক ঘরে করে?

ভোরে দেখে মেয়েটি মরা টাকির মতো নেতিয়ে গেছে। ওর বুক কেঁপে উঠে সিঁদুরে মেঘের মতো। সে ভাবে তার নিজের মেয়ে হলে তাকে ফেলে যেতে পারত? নিজেকে তার মনে হয় সে একটা মান্দার! নিজের প্রতি ঘৃনা দগদগে ঘা মতো জ্বলতে থাকে।

শ্রমিকেরা লঞ্চের রশি ছাড়ে। জীবনটা এমন করে তাকেও হয়তো ফেলে চলে যাবে!

১৮ মে ২০১৯