রিফাহ সানজিদার গল্প ‘বৃষ্টি ও মন খারাপের গল্প’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৬, ২০২১

পেঁয়াজ আর রসুনের কোয়াগুলো তেলে ফুটছে। আমেনা বিবি বাইরে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তবে হাত নাড়তে থাকে স্বভাবমতো। মনসুরের বাপ আজ বেতন পাবে, কথাটা মনে হতেই আবার চুলোয় দৃষ্টি দ্যায় সে। বাইরে কেমন রোদ ছিল একটু আগেও, এখন দ্যাখো কেমন মেঘ করছে। আষাঢ়ের এই এক যন্ত্রণা! কখন মেঘ করে বোঝা মুশকিল। অথচ বাইরে কাপড় দেয়া আছে, যদি বৃষ্টি নামে!
বৃষ্টির আশঙ্কা হতেই তার মনে পড়ল সুলেখার কথা।
অ সুলেখা... বলে হাঁক ছাড়ে সে। সুলেখা বেরিয়ে আসে। সে যেন জানতোই এসময় মায়ের ডাক পড়বে। আমেনা বিবি বলে, কাপড়গুলো এনে ঘরে রাখ। সুলেখা কাপড় আনতে যায়।
সুলেখা নামটি রেখেছে মনসুর। নামটা কেমন হিন্দু হিন্দু ঠেকে বলে আমেনা প্রথমে রাজি ছিল না। জুলেখা হলে ভালো হয়, মত দিয়েছিল সে। অমনি মনসুরের বাবা মুখ গম্ভীর করে বলেন, না, নাম সুলেখাই। আমেনা আর কিছু বলেনি। আর এই মনসুর হয়েছে আরেক জাতের! কী কী যেন করে বেড়ায়। সারাদিন বাইরে থাকে। ঘরে ফেরে রাতে। জিজ্ঞেস করে উত্তর পাওয়া ভার। ছেলেটার বিয়ে দেয়া দরকার এখন। অথচ বলার মতো কিছুই সে করে না। একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে তেলের পেঁয়াজের রং আন্দাজ করতে চেষ্টা করে আমেনা।

মনসুর টংয়ে বসে থাকে। আরো দু’একজনের আসার কথা। এলেই ওরা পার্টি অফিসের পথ ধরবে। ঝামেলা বাধিয়েছে কেবল বৃষ্টিটা। ছেলেগুলো আসতেই ওরা অফিসের পথ ধরে। মনসুর তালা খুলবে, সব দায়িত্ব ওর কাছেই দিয়েছেন নেতা। বড় বিশ্বাসের লোক সে। নামে পার্টি অফিস হলেও নেতার সব কাজই আসলে এখানে
চলে। টাকা পয়সা-ব্যবসায়িক লেনদেন থেকে বিচার, সবই। সকাল থেকে রাত অব্দি তদবির এখন সেই সামলাবে। নেতার তো বিশ্রামের দরকার আছে। কত কাজ করেন। নেতা মানুষ। পরদিন একটা সমাবেশে বহু লোক আনতে হবে, দলের উঠতি গ্রুপটা না-হক ঝামেলা বাধাতে পারে। এজন্য ছেলেগুলোকে জড়ো করে সে আজ।
অফিসে পৌঁছে ভাষণ দেয়ার মতো করে সে বলে, পাঁচশো করে পাবা। সাথে দুপুরের খাবার। এসব বকোয়াজি নেতার কাছ থেকে সে শিখেছে। নেতা এভাবেই দাঁড়িয়ে কথা বলেন। দরকারি কথা অতি সংক্ষেপে, যেটুকু বলা দরকার। মনসুরের ধারণা, একদিন সে একজন ছোটখাটো নেতায় পরিণত হবে।

নেতার আজ মন ভালো নেই। এই বালের বৃষ্টি হলেই নেতার মন খারাপ হয়। মন খারাপের কারণটা অবশ্য গূঢ়। বৃষ্টি হলে ওই মেয়েটার মনও ভালো থাকে না। অদ্ভুত বিষয়! ভাবেন নেতা। আমি মেয়েটার নাম জানি না? মনসুরকে একবার বলবে নাকি খোঁজ নিতে? নাহ থাক। সব কথা সবাইকে জানানো দরকার নেই। এটা তার দুর্বলতা নাকি? নিজেকে সে প্রশ্ন করে। মনসুরকে বিশ্বাস করে সে। তবে... তবে, সবসময় মানুষ বিশ্বাস রাখতে পারে না। সেক্ষেত্রে বিশ্বাস যে করে, দোষটা তার। নিজেকে বোঝান তিনি।
নারী বিষয়ক দুর্বলতা তার কখনোই ছিলো না। আজো নেই। তবে ওই মেয়েটা! আবারো নিজেকে বোঝান তিনি। ওই যে সেদিন মেয়েটা তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। হ্যাঁ, সেদিন ভয়ানক একটা দিনই ছিল। গুলি লেগেছিল তার পায়ে। মেয়েটা তাকে আশ্রয় দেয়। ওইরকম অবস্থায় অন্য মেয়ে হলে এ কাজ করতো কীনা, সন্দেহ। কিংবা ডাক্তার বলেই এই কাজ করেছে মেয়েটি, বহুবার এ কথা ভেবে নেতার মন খারাপ হয় একটু। নেতা কেবল তার ঠিকানা জানে, আর বাড়ির নাম। ব্যথায় হুঁশ ছিল না। নইলে নির্ঘাত নাম জেনে নিত। বাড়ির নাম, নীলাঞ্জনা। ড্রাইভার বলেছে। এটা কি তার নাম হতে পারে? নাহ, শখ করে মানুষ এমন সাহিত্যিক নাম দেয়। হতেই পারে ওটা তার নিজের সাথে জড়িত কিছুই নয়।
সে একটা মিথ্যে বলেছিল অবশ্য, একটা মিছিল চলছিল। সেখান থেকে লেগেছে। জানেনই তো আজকাল পার্টিগুলোর কী অবস্থা!"
আসল কথাটা চেপে গেছিল সে।
মেয়েটি জিগেশ করেছিল, আপনিও সেসব পার্টির মিছিলে ছিলেন নিশ্চয়ই? আপনার পরিচয় কি?
নিজের পরিচয় দিয়েছিল সে, মেয়েটা আর প্রশ্ন করেনি। অদ্ভুত মেয়েটা, এত নীরবতা কিসের ওর মধ্যে?
নেতা তখন বলেছিল, দুঃখিত, আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম।
তার চেয়ে বেশ ক`বছরের বড় সেই নারী উত্তর দেন, বেঁচে থাকাটাই ঝামেলার, তাই না?
নেতা জানতে চায়, আপনার মন খারাপ?
নারীর জবাব, বৃষ্টির দিনগুলো ছাড়া আমার মন খারাপ হয় না।
এই কথাটাই কেবল অর্থপূর্ণ ঠেকে নেতার কাছে। নেতা ফোনের ডায়াল বের করেন। ফোনবুকে একটা নাম আছে, স্ক্রিনে ভেসে উঠলো, ডাক্তার।

ঝুপ করে বৃষ্টি নামতেই চারদিক থেকে গাড়ির হর্ণ ও মানুষের কোলাহল কমে যায়। নীলাঞ্জনার ব্যাপারটা ভালো লাগে না। চারদিক যেন অসীম শূন্যতায় ভরে যায়। শুধু থাকে কেবল একঘেয়ে ঠাণ্ডা একটা বাতাস আর বৃষ্টির ঝিমঝিম শব্দ। যেন ঝিঁঝি পোকার ডাক। ঝিঁঝি পোকার ডাক, ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ...
এরপর অবিরত মাথার ভেতরে এসব ডাক বাজতে থাকে। তার মাথা ব্যথা হয়, মন বিষিয়ে ওঠে। ঝিঁঝি পোকার ডাক আরও বাড়তেই তার ফোনে একটা কল আসে। অচেনা একটা নাম্বার। তবু ওটা এড়িয়ে যায় না।
জি বলছি। নীলাঞ্জনা ওঠায় কলটা।
নেতা বলে, আমি।
নীলাঞ্জনা বিরক্ত হয়, নাম বলুন। আপনার নামে নাম্বার সেভ করা নাই।
ও প্রান্ত তখন বলে, আচ্ছা, আমাকে সেদিন আপনি আশ্রয় দিয়েছিলেন, ওই যে নেতা...
হ্যাঁ, কেমন আছেন? ভালো? নীলাঞ্জনা অবাক হয় না। লোকটার নাম মনে নেই, নেতা না বললেই বরং চিনত না। চিশ্চয়ই এখন ধন্যবাদ দিতে চাইবে।
অথচ সেদিন গাড়ির সামনে ওরকম একটা মানুষকে দেখে তার বহুদিন আগেই ছেড়ে দেয়া ডাক্তারি পেশার তাড়না জেগে উঠেছিল। আর কিচ্ছু না।
নেতা জানতে চায়, জি আপনি ভালো আছেন?
নীলাঞ্জনা প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে জবাব দ্যায়, আমি? হ্যাঁ, ভালো আছি।
আপনি বোধহয় ভালো নেই। বলেছিলেন বৃষ্টি হলে আপনার মন ভালো থাকে না। তাই খবর নিলাম।
নীলাঞ্জনা এবার অবাক হয়। এই সামান্য কথা, মানে অন্যকারো জন্য সামান্যই তো, সামান্য এ কথা কারো মনে রাখার মানে কি?
এমন সময় বাইরে বৃষ্টিটা আরো বাড়তে থাকে। কিন্তু ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়িয়ে তার মাথায় বাজতে থাকে: আপনি বোধহয় ভালো নেই। বলেছিলেন বৃষ্টি হলে আপনার মন ভালো থাকে না।