রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ২

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : মে ১৫, ২০১৯

রুপনি ভাবছে ছেলেটা অফার করলে ও কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে। ওর অফার শোনার সাথে সাথে ওকে হা বলবে, নাকি না বলবে, অথবা চুপ করে থাকবে! ওর বন্ধু-বান্ধবী অনেকেই ইনগেইজড। কেউ কেউ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। গড়ে তুলেছে ফিজিক্যাল রিলেশন। আবার কারও কারও ব্রেক আপ হয়েছে, নুতন জুটি বেঁধেছে কেউ কেউ। সর্ম্পক গড়া আর টিকিয়ে রাখা দুটিই খুব কঠিন। আবার ইনগেইজ না হলেও এক বিপদ। সবাই শুধু প্রপোজ করতে চায়। নিউটন, ড্যানি সবাই। বন্ধু হিসাবে ওরা চমৎকার, তবে ফিয়াসে হিসাবে ক্লাশমেট মোটেই সুবিধার নয়। রূপনি এমন কাউকে চায়, যে সিনিয়র, যে রূপনিকে ডমিনেট করবে— রূপনি যার ওপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারবে। আর এই গুণটা জকির আছে। জকি ডিফারেন্ট। ভীষণ ইনোভেটিভ। গোল্ড জিমের কল্যাণে চেহারার সাথে মানান সই ফিগার। মেয়েরা সারাক্ষণ ওর চারদিকে ছোক্ ছোক্ করে। জকির সাথে যখন সম্পর্কটা পাকা হবে, তখন জকির পেছনে ঘুর ঘুর করা মেয়েগুলোর চেহারাগুলো কেমন হবে? ও সব চেহারা মনে হলে রূপনি একা একা হেসে ফেলে। মেয়েগুলোর জন্য এখনই বড্ড মায়া হচ্ছে।

সেই ছেলেবেলা থেকেই বেশ ধুমধাম করে রূপনির জন্মদিন পালন হয়। পাপা কখনো থাকেন, কখনো থাকেন না। ব্যবসার কাজে পাপাকে দেশের বাইরে থাকতে হয়। তবে যেখানেই থাকুন পাপা জন্মদিন পালনের জন্য মাকে প্রচুর টাকা দিয়ে যান। একদিন আগে থেকেই রূপনিকে জন্মদিনের উইশ পাঠান। দুতিন বছর ধরে রূপনির ইচ্ছে মতই জন্মদিনের মেনু আর ভ্যানু সেলেক্ট করা হয়। রূপনির পরিকল্পনায় সবকিছু হয়।

এ বছর জন্মদিনটা নিশ্চয়ই অন্য রকম হবে। ওদের বাড়ির কাছে এই গুলশানেই একটা পুরানো ক্লাব আছে ‘অলওয়েজ ফ্যানি’। হেন জিনিস নেই যা ওখানে নেই! আলো আঁধারির খেলা নিভু নিভু আলো, হেভি মেটাল মিউজিক— ইদানীং ইয়াবাও নাকি পাওয়া যায়। ওর বান্ধবীদের অনেকেই ‘অলওয়েজ ফ্যানি’তে যায়। রূপনি নিশ্চিত ওরা কেউ আর ভার্জিন নেই। এ কথাটা ভাবলে গাটা শিরশির করে। রূপনি জন্মদিনে বন্ধুদের নিয়ে ওখানেই পার্টি দেবে। জন্মদিনে দিনের বেলা কাটাবে বাবা-মার সাথে, বাড়ির পার্টিতে। ‘অলওয়েজ ফ্যানি’তে পার্টি চলবে ভোর রাত পর্যন্ত।

জন্মদিনের দিন রূপনি জকির ডাকে যদি সাড়া দেয়, তবে পার্টি হবে অন্য রকম। ড্যান্স ফ্লোরে জকির বাহুডোরে বাধা হয়ে ঘূর্ণি উত্তাল হবে রুপনি। হিম শীতল রুমে রূপনি ঘেমে উঠবে— এক সময় ক্লান্তিতে এলিয়ে যাবে জকির শক্তদেহের ওপর। তারপর, একটা প্রাইভেট রুমে ঢুকে যাবে দুজন। এসব কথা ভাবলে গরম লাগে, রূপনি গায়ের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে দেয়। রূপনি এখন শীতল হতে চায়। এসির রিমোট হাতে নিয়ে রূপনি রুমের টেম্পারেচার ষোলতে নামিয়ে আনে। ওর দেহে একটা শীতল ধারা বয়ে যায়।

রূপনি এখন ওর সমস্যা নিয়ে ভাবছে। আসলেই এতগুলো বছরে রূপনির কোনো সমস্যা নেই। মা-বাবা আর রূপনির জন্য পাঁচ হাজার বর্গ ফিটের এ ডুপ্লেক্স বাড়িটা নিঃসন্দেহে বিশাল আর বাড়িতে আছে প্রায় আধ ডজন কাজের লোক। আর পাপা তো এতই ব্যস্ত যে মাসে চার-পাঁচদিনের বেশি বাড়িতে রাত কাটাতে পারেন না। ব্যবসার জন্য পাাপাকে সারা বছরই এইদেশ সেইদেশে ছুটে বেড়াতে হয়। পাপা না থাকলে এ বাড়িটা কেমন নিঝুম হয়ে যায়। রূপনিকে অবশ্য সারাদিনই ব্যস্ত থাকতে হয়। ভার্সিটিতে যেতে হয়, হোম ওয়ার্ক করতে হয়, বাসায় টিউটর আসে। সন্ধ্যায় সুইমিংয়ে যেতে হয়। আসলে এ বাড়িতে নিজের রুমটা ছাড়া অন্য রুমগুলোর খবরও রূপনি রাখে না। কাজের লোকদের মধ্যে দুজন বুয়া ছাড়া অন্য কেউ রূপনির রুমে ঢুকতে সাহস পায় না। এ বুয়া দুজন রূপনি বাইরে চলে গেলে ওর বিছানা-কাপড়চোপড় পরিপাটি করে রাখে। রূপনিকে ওরা ভালও বাসে, আবার ভয়ও পায়। মাঝে মাঝে বুয়াদের সঙ্গ রূপনি উপভোগ করে। এক বুয়া প্রায়ই বলে রূপনি দেখতে নাকি ঠিক রাজকুমারীর মতো, এ বুয়া নাকি রোজ নামাজ পড়ে রূপনির জন্য একজন রাজপুত্র প্রাথর্না করে। বুয়ার কথা শুনে রূপনি হাসে। আরেক বুয়া বলে, ‘আফা’কে দেখতে ঠিক ঐশ্বারিয়ার মতো— ‘আফা’র বর নাকি হবে অভিষেক বচ্চনের মতো। এই বুয়াটা হিন্দি ফিল্মের পোকা। সারাদিনই বাসায় বসে হিন্দি ফিল্ম দেখে। মাঝে মাঝে রূপনিকে হিন্দি ফিল্মের নাচ দেখিয়ে যায়। ওর নাচের ভঙ্গি দেখে হাসতে হাসতে রূপনির পেটে খিল ধরে যায়।

পাপার সাথে রূপনির দেখা হয় মাসের মধ্যে বড়জোর এক থেকে দুদিন। তবু রূপনি সারাক্ষণই পাপার অস্তিত্ব অনুভব করে। পাপা যেখানেই থাকুক প্রতিদিনই রূপনিকে ফোন করে। কথা বলে দশ থেকে ত্রিশ মিনিট। সুতরাং পাপার সাথে কমিউনিকেইশন গ্যাপ হওয়ার সুযোগ নেই। পাপা রূপনির প্রতিটি বিয়য়ে নজর রাখে। ব্যালেন্স শেষ হওয়ার আগেই পাপা প্লাষ্টিক কার্ডে টাকা ভরে দেন। রূপনির কাজ শুধু প্লাষ্টিক কার্ড মেশিনে ঢুকিয়ে টাকা তোলা আর খরচ করা। পাপা রূপনির জন্য যত সহজ— মামনি ততটাই কঠিন। মামনিকে রূপনি ঠিক বুঝতে পারে না। সারাহ্মন গম্ভীর হয়ে থাকেন। রূপনির কোন কাজে বাধা দেন না, আবার সমথর্নও দেন না। তবে ইগ্জ্যাম মার্কশীট দেখলে মামনির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তখন মামনিকে ভীষণ সুইট লাগে। মামনির হাসিটুকুর জন্য রূপনি পড়াশুনার পেছনে প্রচুর সময় ব্যয় করে। মামনি আসলেই ঘরকুনো-বাড়ির বাইরে যান না বলেই চলে। পাপার সাথে ক্লাব কিংবা পার্টিতে তেমন যান না।  ওর বন্ধু-বান্ধবীর বাবা-মা, অন্য আঙ্কেল-আন্টিরা ক্লাবে যায়, পার্টিতে যায়— বাড়িতে চোখ ধাঁধানো পার্টি দেয়। অথচ রূপনিদের বাড়িতে পার্টি হয় না। মামনি একটু সেকেলে— কনসারভেটিভ। মায়ের এই কনসারভেটিভনেস পাপা বেশ উপভোগ করেন। বাড়িতে এলে কোন কোন সন্ধ্যায় পাপা ড্রিংকস্ নিয়ে বসেন— মা কখনো ড্রিংকস নেন না। পাপার পাশে বসে থেকে পাপার খাওয়া দেখে বিরক্ত হয়। পাপাকে একাকি ড্রিংক করতে দেখে একদিন রূপনি তার পাশে বসে ড্রিংকস এ চুমুক দিয়েছিল। মামনি রেগেমেগে উঠে গিয়েছিলেন আর পাপা হো হো করে হেসেছিলেন। দুজনে মিলে মাকে বেশ রাগিয়ে ছিল।

রূপনির কোন সমস্যা না থাকলেও, একটা ব্যাপারে ইদানীং ওর বেশ খটকা লাগে। মা কেন যেন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন। রূপনির কাছে মা একদিন ধরাও পরেছেন। মা প্রাণপণে কান্না লুকাতে চাইছিলেন। কান্নার কারণ মায়ের কাছ থেকে জানা সম্ভব হয়নি। রূপনির নানা-নানি নেই। রূপনি বেশ বোঝতে পারে নানা-নানির জন্য কান্না এলে মায়ের লুকানোর কিছু নেই। গোপন কষ্টে মা কাঁদেন। কার জন্য, কিসের জন্য মায়ের এই গোপন কষ্ট? এই গোপন কষ্টটা যদি জানা যেত! রূপনি অন্তত মায়ের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করতে পারত। মায়ের এই গোপন কষ্টটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে রূপনি ঘুমিয়ে পড়ে।

চলবে