রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ৯

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : মে ২৩, ২০১৯

আট.
লোকটি নিজেকে ডন ভাবতেই পছন্দ করে। ডনদের কথা বইয়ে পড়েনি, শুনেছে কেবল। আর হিন্দি ফিল্মে ডনদের অ্যাকশন দেখেছে। একজন ডনের কথা সবাই জানে দাউদ ইব্রাহিম, ডনদের সম্রাট। দাউদ নামের এই লোকটা ছিল বোম্বের রাজা। এখন পাকিস্তান না দুবাই কোথায় যেন আছে। দাইদ ইব্রাহীম ফিল্মের ডনদের মতো মারপিট করে বেড়ান না। ফাইভ স্টার হোটেলের মতো রাজপ্রাসাদে থেকে তার সাম্রাজ্য চালান। ছিঁচকে মাস্তানরা কখনো ডন হতে পারে না। এ কারণেই ছেলেবেলা থেকে লোকটির ডন হওয়ার ইচ্ছা ছিল। তবে এই লোকটা নিজেকে ডন ভাবলেও সবাই আড়ালে ওকে ‘লাল শুয়োর’ নামে ডাকে। প্রথম জীবনে যখন পথেঘাটে রাত কাটাতে হতো তখন কে কি নামে ডাকত তা  নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না। তখন একমুঠো ভাত আর আশ্রয়ের জন্য রাস্তার কুকুরের মতো কামড়া-কামড়ি করতে হয়েছে। একই সমতলের শত্রু কিংবা বন্ধুকে পথের কুকুরের মতোই প্রাণ হারাতে দেখেছে। তখন প্রতিদিন বেঁচ থাকাটাই ছিল বিস্ময়ের। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। দাউদ ইব্রাহিমের মতো অত বড় মাপের না হলেও লোকটি এই ঢাকা শহরের একজন ডন। শহরের এক বিশাল অংশের আন্ডার ওয়ার্ল্ডের অধিশ্বর সে। আড়ালে ‘লাল শুয়ার’ বলা হলেও লোকটিকে সবাই সামনা সামনি ‘মিয়া ভাই’ ডাকে। ‘লালশুয়ার’ কবে কেমন করে ‘মিয়া ভাই’ হয়ে গেল কে জানে! পুরানো দিনের কথা লোকটি এখন আর মনেও করতে চায় না। ও সব দিন ভুলে যাওয়াই ভাল। পেছন দিকে তাকালে পুরনো দিনের কিছুই এই লোকটির মধ্যে এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফেলে আসা শিশুকাল কিংবা বস্তি জীবন এখন লোকটির কাছে অলীক মনে হয়। বাবাকে কখনো দেখেছে কিনা মনে পড়ে না। অর্ধাহারে বিনা চিকিৎসায় মাকে মরে যেতে দেখেছে। তারপরও জীবনকে টেনে নিতে হয়েছে। একমুঠো ভাতের জন্য সমবয়সীদের সাথে লড়াই করতে হয়েছে। ভাতের বদলে কখনো প্রহারজনিত ব্যথা নিয়ে, পরদিন সকালের উদরপুর্তির বিভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুমাতে হয়েছে। পেটে অসম্ভব হ্মুধা নিয়ে দিন শুরু করতে হতো। ক্ষুধার্ত মুখ নিয়ে কারও সামনে দাঁড়ালে কুকুরের মতোই তাড়িয়ে দিত। আস্তে আস্তে এসব অপমান গা-সওয়া হয়ে গেল। কেউ দুর ছি করে তাড়িয়ে দিলে কিছু যেত আসতো না। আস্তে আস্তে লাজলজ্জা বিলুপ্ত হচ্ছিল। দেহের পরিবর্তনের সাথে সাথে মনটাও কেমন করে শক্ত হয়ে গেল!

রেল ইস্টিশনের এক পাশে প্রায়শ মালভর্তি বগি দাঁড়িয়ে থাকত। মাল খালাসের সময় বগির দরজার নীচে খাদ্যকণা, চাল-গমের দানা পড়ে থাকত। অপর কিশোরদের সাথে পাল্লা দিয়ে সেই সব খাদ্যকণা সংগ্রহ ছিল দিনের প্রধান কাজ। সেই সাথে জুটত কুলিদের লাথি-গুতা। অভাব-অনটন আর যাই হোক সময় থমকে দাঁড়ায় না। কৈশোর শেষে দেহের মধ্যে নানা ভাঙচুর চলে। মনজগতে চলতে থাকে নানা পরিবর্তন। অপর সাথিদের নিয়ে নানা পরিকল্পনা আঁটে। বুঝতে পারে, ওর শরীরের শক্তি। এই শক্তি দিয়ে পৃথিবীটা বশে আনার ইচ্ছে জাগে। একদিন ভর দুপুরে মালগাড়ির দরজা খোলা রেখে কুলিরা যখন উদরপূর্তিতে ব্যস্ত তখন সাথিদের নিয়ে বগিতে উঠে পড়ে। অমানসিক পরিশ্রমে মাথায় তুলে নেয় চালের বস্তা। রেললাইনের পাশেই বস্তি, মাথার চাল নিয়ে সেই বস্তিতে লুকিয়ে পড়তে কোনো অসুবিধা হয় না। চাল বিক্রির টাকায় শুরু হয় শখ পুরনের পালা। নুতন শার্ট-জিনসের পান্ট-আর রঙিন চশমা চোখে দিয়ে নিজেকে ফিল্মের হিরো, ঠিক সালমন খানের মতো লাগে। রাজার হালে থাকার পর সাতদিনের মধ্যে টাকা শেষ হয়ে যায়। এবারের পরিকল্পনায় যোগ হয় প্রতিরোধের ভাবনা। কেউ বাধা দিলে মাথা ফাটাতে হবে। ছুরি চালাতে হবে। সাথিদের নিয়ে খানিকটা মহড়াও দিতে হয়। পরিকল্পনায় কাজ হয়। এক বস্তা নির্বিঘ্নে সারানোর পর হই হই করে আসে বৃদ্ধমতো এককুলি। বেচারা কিছু বোঝার আগেই মাথায় আঘাত পেয়ে লুটিয়ে পড়ে। মাথা ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড, রেলপুলিশ আসার আগেই ওরা পালিয়ে যায়। এই ঘটনায় ওদের নিজেদের আরও শক্তিশালী লাগে। শুধু গায়ের জোরে হবে না, বুদ্ধি খাটাতে হবে। এই বয়সে কূটনৈতিক বুদ্ধি কেত্থেকে এসেছিল কে জানে! রেল লাইনের পাশের বস্তিতেই থাকে কুলি সর্দার। সর্দারের মেয়েটাকে দেখলে মন আনচান করে। কিন্তু ওর পরিকল্পনা ভিন্ন। একদিন রাতে সর্দারকে ঘিরে ধরে কৈশোর পেরুনো দলটা। কিছু বোঝার আগেই সর্দারকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যায় খোলা মাঠ পেরিয়ে নির্জন পুকুরের ধারে। রাতের অন্ধকারেও ওদের হাতের ছুরির ফলার ছিলিক দেখে সর্দার মূক হয়ে যায়। সর্দারকে জবেহ্ করার জন্য তার গলার ইঞ্চি খানেক দুরে ছুরি নেচে বেড়ায়। সর্দার প্রাণ ভিক্ষা চায় কেবল।

জীবন দানের বিনিময়ে ওদের দাবি সর্দারকে ওয়াগনের মালচুরিতে সহযোগিতা করতে হবে। তাহলে বখরা দেয়া হবে। ওদের কথা না শুনলে কিংবা কাউকে কিছু জানালে সর্দারের বস্তিঘর জ্বালিয়ে দিয়ে বউ আর মেয়েকে মেরে ফেলা হবে। অনেক আমতা আমতার পর ওদের কথায় সর্দার রাজি হয়। এরপর ম্যাজিকের মতো ঘটে চলে একের পর এক ঘটনা। ওয়াগন ভেঙে মাল চুরি একটা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। রেল পুলিশও কিছু করতে পারে না। পারবে কি করে! সর্ষের মধ্যে ভূত! চুরির বখরার ভাগ রেল পুলিশ থেকে স্টেশন মাস্টার পর্যন্ত সবাই পেতে থাকে। এবার রেল ইয়ার্ডের লোহা-লঙ্কর চুরি হাতে থাকে। কাঁচা টাকা হাতে আসায় আরও বেশি বেপরোয়া হয় সে। রেলের জায়গায় গড়ে উঠা বিভিন্ন দোকানপাট থেকে চাঁদা আদায়ে নামে সে। চাঁদা চাহিদামতো না পেলে দলবল নিয়ে হামলা চালিয়ে তছনছ করা হতো দোকানপাট। স্টেশন মাস্টারও এদের বশে আসে। এককুলি টক্কর দিতে এসেছিল। তাকে মেরে ইটের ভাটায় ফেলে দিতে বুক একটু কাঁপেনি। লোকটা ধুয়া হয়ে চিমনি দিয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেছে। ইটের ভাটায় মানুষ হত্যার কৌশল পরে কাজে লেগেছিল। শিশু ও কৈশরে অপুষ্টিতে ভুগলেও-যৌবনে দেহে এত বল কোত্থেকে এলো কে জানে! ওর শারীরিক শক্তি প্রবাদে পরিণত হয়, কে যেন বলেছিল ওর গায়ে মতো শুয়ারের শক্তি। টাকা আর ভাল খাওয়া দাওয়ার কারণে রোদে পোড়া চামড়া ভেদ করে ওর ফর্সা রংটা ফিরে আসে। চেহরার লালচে আভা আর শুয়ারের মত শক্তি এই দুই মিলে ওর নাম হয় ‘লাল-শুয়ার’। কাঁচা বয়সেই কুলি সর্দারের মেয়েকে বিয়ে করতে বেগ হয় না।  শহরের একটা মধ্যবিত্ত পাড়ায় বাড়িভাড়া নিয়ে সর্দারের মেয়েকে নিয়ে নুতন জীবন শুরু করে। নিজে ‘ভদ্রলোক’ হওয়ার চেষ্টা করলেও সর্দারের মেয়ের কোনো পরিবর্তন আসে না। সর্দারের মেয়ে বস্তির স্বভাবটা পাল্টাতে পারেনি। আগের মতোই মুখরা থেকে যায়। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সর্দারের মেয়ের ওপর থেকে মোহ উঠে যায়। ঘরে আর ঠিকমত ফেরা হয় না। পয়সা দিয়ে কত ধরনের ফূর্তিই না করা যায়! দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে ‘লালা-শুয়ারের’ চেহারা পোষাক আষাক পাল্টে যায়। চকচকে মটর সাইকেলে মহড়া দিয়ে বেড়ায় সারা মফঃস্বল শহর। এই জীবনের সাথে সর্দারের মেয়ে বেমানান। ছেলেবেলায় দেখা ধনির দুলালীদের আকাশের পরির মত লাগত। এই সব পরিদের হাতদিয়ে ছুঁয়ে দেখার তীব্র ইচ্ছে হত। মহল্লার এক ধনির দুলালি রুপা বেগমের প্রেমে পড়ে ‘লালশুয়ার’। রুপা বেগমের অনুকম্পা পাওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা নেই যেনে রুপা বেগমকে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা আঁটে। কিন্তু এ সময় বিপদ আসে অন্যদিক থেকে। নচ্ছার এক পুলিশ কর্মকর্তা শহরে এসেই ওদের পিছনে লাগল। যে সব বড়ভাইরা ‘লালা শুয়ার’কে আশ্রয়-প্রশ্রায় দিচ্ছিল তারা এই পুলিশ কর্মকর্তাকে বাগে আনতে ব্যর্থ হয়েছিল। দুই চ্যালাকে ধরে চালান করে দিল। তারপর হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলো লাল শুয়ারেকে। এ সময় কাকতালীয় ভাবে ঢাকার এক রিয়াল এস্টেট ব্যবসায়ীর পয়গাম আসে। ঢাকার আশপাশের নিচু এলাকা, খাল-বিল ভরাট করে একটা গোটা শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা ঐ লোকের। কিন্তু স্থানীয় কিছু লোক ক্রমাগত বাধার সৃষ্টি করছে। এদের একজন নেতাও গজিয়েছে। নেতা গোছের এই লোককে খুন করতে হবে। বিনিময়ে টাকা আর নিরাপত্তা। সুতরাং রুপা বেগমের বিষয়টা ভবিষ্যতের জন্য শিকেয় তুলে রাজধানীতে আসতে হলো লাল-শুয়ারকে। মফঃস্বলের তুলনায় এই শহরের ডাট-বাট অনেক বেশি। একটা খুন করলে যে টাকা আসে-সারা জীবন রেল ওয়াগনের মাল সরালেও সেই টাকা আসবে না। সেই নেতা গোছের লোকটিকে খুন করতে মোটেই বেগ পেতে হয়নি। কেউ ঐ লোকটার হদিস পাওয়ার আগেই লোকটি ইটের ভাটার চিমনি দিয়ে বাতাসের সাথে মিশে গিয়েছিল। এরপর আর লাল শুয়ারকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

সুতরাং ঢাকায় নিজের নেটওয়ার্ক তৈরি করতেও বেগ পেতে হয়নি। রিয়াল এস্টেট ব্যবসায়ী ড্রাইভারসহ গাড়ি দিল ওকে। প্রথম দিকে বনানী গুলশানের বাড়িগুলোকে অলীক মনে হতো। এখন অলীক মনে হয় না। রুপা বেগমকে নিয়ে এ ধরনের একটি বাড়িতে থাকার শখ মাথা চড়া দেয়। রূপা বেগমকে নিয়ে ঘর বাধার স্বপ্ন দিন দিন দানা বাধতে থাকে। তারপর ক্লেদাক্ত অতীত ছুড়ে ফেলার জন্য লোকটি প্রতিনিয়ত নিজের সাথে লড়াই’এ নামল। রিয়াল এস্টেট ব্যবসায়ীর অনুকরণে পোষাক গায়ে লাগালো। দুএকটি ইংরেজি শব্দ শিখে নিল। দামি রেস্টুরান্টে খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত হলো। অচিরেই ‘লাল-শুয়ার’ নামটি বদলে নুতন নাম হলো ‘মিয়া ভাই’। বিনয়ের অবতার রিয়াল-এস্টেট ব্যাবসায়ি ‘লাল শুয়ার’কে এই নামেই ডাকে যে! মফঃস্বল শহরের সব কিছু ভুলে গেলেও লোকটি রূপা বেগমকে ভুলতে পারে না। রূপা বেগমের জন্য লাল শুয়ার রাতে ঘুমাতে পারে না। সবার অলক্ষে ‘মিয়া-ভাই’ রূপা বেগমকে পাওয়ার জন্য নানা ফন্দি আঁটতে থাকে। ঢাকা শহরে গুলশান এলাকায় তাজমহলের মত একটা বাড়িতে রুপা বেগমকে নিয়ে থাকতে পারলে কেমন হয়?

চলবে