রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ১০

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : মে ২৪, ২০১৯

নয়.
জন্মদিন এগিয়ে আসছে অথচ পাপার দেখা নেই। টেলিফোনে অবশ্য পাপার সাথে রোজই কথা হয়। পাপা যদি দেশের বাইরে না যায় তবে অবশ্যই রূপনির জন্মদিনে বাড়িতে আসবে। তারপরও পাপার সাথে সামনা-সামনি কথা না হলে রূপনি শান্তি পাচ্ছে না। জন্মদিন নিয়ে পাপার উৎসাহের ঘাটতি নেই। অথচ মামনি কেমন যেন নির্বিকার। মামনির এই ম্যারম্যারে ভাবটা রূপনির পছন্দ নয়। রূপনির জন্মদিন নিয়ে মামনির দায়সারা উৎসাহ। মামনির এই ব্যাপারটা মনে এলে রূপনির মন খারাপ হয়ে যায়। মামনি সব ব্যাপারেই কেমন শীতল! মায়ের কোনো মানসিক সমস্যা আছে কিনা কে জানে! ইদানীং পাপার প্রতি মামনির উদাসীনতা চোখে পড়ে। মামনির গোপন কান্না কিসের লক্ষণ! মামনি কি দিন দিন অসুস্থ হচ্ছে? দেখা হলে পাপাকে মায়ের সমস্যাটাও বলতে হবে। রূপনি পাপার অপেক্ষায় থাকে।

জকির কথা মনে এলে রূপনির মন ভালো হয়ে যায়। জকি প্রতিদিন ই-মেইলে ম্যাসেজ পাঠায়। ওয়েভ-ক্যাম এ সময় সময় দুজন চ্যাটিং করে। জকি ওয়েভ-ক্যামে বিভিন্ন ভাবে রূপনিকে দেখতে চায়। রূপনিও নিরাশ করে না। সময়গুলো জেট বিমানের মতো উড়ে যায়। রূপনির কম্পিউটারে জকির নানা ফটোগ্রাফ। রূপনি কাজের বুয়াদের জকির ফটোগ্রাফ দেখিয়েছে। দুজনের চোখ একেবারে ছনাবড়া। ‘আফা এই যে দেখছি অভিষেক বচ্চন।’ একবুয়া কপালে হাত রেখে বিস্ময় প্রকাশ করে। ‘কি যে কইলি না, এই চেহারার কাছে অভিষেক ফেল, ফেল হইবো না ক্যা, আর আমাগো আফার কাছে ঐশ্বরিয়া ফেল।’ আরেক বুয়া বলে। বুয়াদের কথা রূপনি উপভোগ করে। মনে মনে বুয়াদের জন্মদিনের গিফট বরাদ্দ করে। জকি ডিসকো থ্যাকের পাচটি টিকেট ওকে গিফট দিলেও আরও পনেরটি কিনতে হয়েছে দ্বিগুণ দামে। জন্মদিনের রাতে এই চল্লিশ জন ওকরার ডিসকো থ্যাক কাঁপিয়ে তুলবে। পার্টি চলবে সারা রাত। জকি নাকি ঐ রাতে স্পেশাল কিছু গিফট দেবে। জকি খুবই আশ্চার্য ছেলে। ওর সাথে সময় কাটালে এ পর্যন্ত একটা চুমুও খায়নি। চুমু খাবার চেষ্টাও করেনি। হয়ত জন্মদিনের জন্য ওসব তুলে রেখেছে। ঐ রাতে সুদ-আসলে তুলে নেবে। এ সব কথা মনে এলে রূপনির গরম লাগে। দেহটা কেমন ঘেমে যায়। জন্মদিনটা এত দেরিতে আসছে কেন?

রূপনি প্রতিদিনই পাপার জন্য অপেক্ষা করলেও পাপা নানা কারণে বাসায় আসতে পারে না। রূপনির বিরক্তি বাড়ে। একদিন রূপনি ভাবল পাপাকে একটা সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়। পাপা বাড়িতে আসার সময় পায় না-তাতে কি! রূপনি তো হঠাৎ করে পাপার অফিসে যেয়ে তাকে চমকে দিতে পারে! রূপনির মাথায় কিছু ঢুকলে সেটা পোঁকার মত কামড়াতে থাকে। কাজটা শেষ না করা পর্যন্ত রূপনি শান্তি পায় না। অনেক দ্বিধাদ্বন্দের পর রূপনি পাপার অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এ ব্যাপারটা মায়ের কাছে সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হবে। মামনি জানতে পারলে বাগড়া দিতে পারে। মাঝে মধ্যে পাপার গাড়ির ড্রাইভার সোলায়েমান চাচা এ বাড়িতে আসেন-বাজার টাজার করে নিয়ে আসেন। পাপার সব খবর এই লোকের নখদর্পনে। সোলায়মান চাচার মোবাইল নম্বর বের করে তাকে আসতে বললেই হয়। সোলায়মান চাচাকে পাপার অফিসে যাওয়ার কথা বলতেই লোকটার চোখ কপালে উঠল। আরও অবাক হলো যখন জানতে পারলো রূপনি তার পাপাকে না জানিয়ে পাপার অফিসে যেতে চায়। সোলয়মান চাচাকে ফাঁসির আসামির মতো লাগছে। অনেক অনুরোধ উপরোধ তারপর টাকার লোভ দেখিয়ে সোলায়েমান চাচাকে রাজি করনো গেল। আসলে পাপার সব কর্মচারীই পাপাকে খুব ভয় পায়। পাপার বিশ্বাসকে নষ্ট করতে চায় না। তবে সোলায়মান চাচা শুধু পাপার ঠিকানাই দেবে। রূপনিকে নিজের গাড়ি নিয়ে যেতে হবে। আর কোন ভাবেই সোলায়েমান চাচার নাম প্রকাশ করা যাবে না। এত সব শর্ত মেনে যখন রূপনি পাপার অফিসের ঠিকানা পেল তখন খুশিতে ওর মন ভরে গেল। এই শহরের নানা যায়গায় পাপার নানা ধরনের অফিস। কিন্ত পাপা বসেন পুরানো ঢাকার অফিসে। পুরানো ঢাকায় থাকা পাপার প্যাশন কি না কে জানে! পুরানো ঢাকায় রূপনি কখনো যায়নি। ব্যাপারটা বেশ থ্রিলিং। রূপনি ওর ড্রাইভারকে ঠিকানা বুঝিয়ে দেয়ার পর ওর ড্রাইভার এক অদ্ভুত কথা বলল। এই ড্রাইভার কোনক্রমেই পাপার মুখোমুখি হতে রাজি নয়। গাড়ি বড় রাস্তা পর্যন্ত যাবে। বাকি পথ রূপনিকে একাকি রিকশায় যেতে হবে। এদের আদিখ্যেতা দেখে রূপনি হেসে বাঁচে না। ওরা নখরামি করে রূপনির কাছ থেকে বাড়তি বখশিস আদায় করতে চাচ্ছে কিনা কে জানে! এ ব্যাপারটা মাথায় আসায় রূপনি ওর ড্রাইভারকে একটা চকচকে হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দেয়। লোকটা টাকা নিতে আমতা আমতা করে। রূপনি ধমক দেয়ার পর ড্রাইভার টাকাটা পকেটে ভরে। তারপর ড্রাইভার গম্ভীর মুখে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

অনেক জ্যামে আটকা পড়ে-এলোমেলো গলির শেষে একটা বড় সর রাস্তায় ড্রাইভার গাড়িটা পার্ক করালো। রূপনি যখন গাড়ি থেকে নামল তখন আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্তত একশ জোড়া চোখ রূপনির দেহের সাথে আটকে গেল যেন! এ এলাকায় এ ধরনের পোষাক-আষাকে কেউ তেমন আসে না একটা। রূপনি জানে ওর পোষাক-আষাকের খবর। গায়ে কালো গেঞ্জিটা একটু টাইট বটে-ওর ক্লাভিজ স্পস্ট দেখা যাচ্ছে। এ সব নিয়ে রূপনি কখনো মাথা ঘামায় না। কেউ যদি ওকে দেখে শান্তি পায় তবে হ্মতি কি! শুধু গায়ে না পড়লেই হলো। লোকজনের চোখকে পাত্তা না দিয়ে রূপনি একটা রিকশায় উঠে বসলো। এখানে মদিনা অয়েলমিলের ঠিকানা দেয়া আছে। ঐ মিলে গেলেই পাপাকে পাওয়া যাবে। পাপার যে অয়েল মিল আছে রূপনির জানা ছিল না। রিকশাটা একটু সরু গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল। গলিটা এতই সরু যে দুটি গাড়ি পাশাপাশি যেতে পারে না। গাড়ি নিয়ে এলে ঝামেলা হত। রিকশাটা এগুতেই রূপনি শুনতে পেল পেছন থেকে কে যেন শিশ দিচ্ছে। রূপনি একটু ভড়কে গেল। মোবাইল ফোনটা শক্ত করে ধরল। জায়গাটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। রূপনি ভেতরে ভেতরে ঘামতে থাকে। পাপাকে কল দেবে কি না চিন্তা করল। পরে চিন্তাটা বাতিল করে দিল। এ পর্যন্ত বিপদ তেমন আসেনি। এত ভীরু হলে কি চলে!

রিকশাটা অরেকটু এগুতেই তিনটা ছেলে রিকশার সামনে এসে দাঁড়ালো। ছেলেগুলোর চেহারায় ভদ্রতার লেশ মাত্র নেই। ভয় পেয়েই যেন রিকশায়ালা রিকশাটা থামিয়ে দিল। ’এই কি হচ্ছে?’ গলা চড়িয়ে রূপনি বলল। রূপনির এখন সাহস হারালে চলবে না। ‘জানতে চাই আপনি কই যাইবেন?’ কর্কষ কণ্ঠে একটি ছেলে বলল। ‘আমি মদিনা অয়েল মিলে যাব’। ‘এই ক্যাবলা ছাইরা দে। বসের কোনো মাল অইবো।’ পেছনের ছেলেটা বলল।

কথাটা শুনে রূপনির কান ঝা ঝা করতে লাগল। এতক্ষণ ছেলেগুলো ওর দেহের দিকে বিষ নজরে তাকিয়ে ছিল। চোখের বিষের চেয়ে ওদের কথা রূপনির কাছে বিষের চেয়েও তীব্র মনে হলো। ওর চোখে পানি আসতে চাচ্ছে। যাই হোক, ছেলেগুলো রিকশাটা ছেড়ে দিল। হাফ ছেড়ে রিকশায়ালা প্যাডেলে পা দিল। গলির ঠিক শেষ মাথায় একটা একতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। রিকশা থামতেই কেত্থেকে উদয় হয় তিনটি লোক। লোকগুলোর পোষাক-আষাক চেহারা রুক্ষ্ম। এই চেহারার লোকদের রূপনি খুব একটা দেখেনি। একজনের চোখ টকটকে লাল-আরেকজনের গালে আড়াআড়িভাবে কাটার দাগ। এই সব চেহারা দেখে একটা ভয়ের স্রোত বয়ে যায় রূপনির শিরঃদাড়া দিয়ে। রিকশাআলা ওকে ভুল জায়গায় নিয়ে এলো না তো? রূপনি বাড়িটার দিকে তাকায়। একটা রং ওঠা সাইনবোর্ড ঝুলে আছে। এটাই মদিনা অয়েল মিলই। তবে দেখেই বোঝা যায়, এটা একটা পরিত্যক্ত কারখানা। লোকগুলোকে উপেক্ষা করে রূপনি রিকশা থেকে নামে। একজনকে পাপার কথা বললে কাজ হয়। লোকগুলোর দেহের ভাষা বদলে যায়। রূপনি গেটের কাছে আসতেই গেটটা খুলে গেল। ও ঢুকে পড়তেই গেট বন্ধ করে, ওর মুখোমুখি হয় একজন গেটম্যান। ‘আপনি এইখানে বসেন। বস পারমিশন দিলে ভিতরে যাইবেন।’গেটম্যান ওকে একটি টুল দেখিয়ে দেয়।

‘পারমিশনের দরকার নেই। আপনি আমাকে নিয়ে চলুন। আমি তার মেয়ে।’ লোকটা অবাক চোখে ওর দিকে তাকায়। রূপনি ফের একই কথা বলে। ‘পারমিশন ছাড়া দেখা করার নিয়ম নেই।’ রূপনি এবার লোকটিকে ধমকের স্বরে কথা বলে। কাজ হয়। ‘যদি মালিকের মাইয়া হন-যাইতে পারে না-আর তা না হইলে হান্দইদা দিব।’ লোকটি একটা অশ্লীল ইংগিত করে। রূপনির দু কানে ঝা ঝা লাগে যেন। পাপার চারপাশের এরা কি ধরনের লোক! নাকি এ এলাকার লোকগুলোই এমন! লোকটির পেছন পেছন রূপনি হাঁটতে থাকে। এই বিল্ডিংটা শেষে আরেকটা বিল্ডিং। বিল্ডিং এর সামনে ফাঁকা চত্বর। দশ বারো জন বিভিন্ন বয়সের লোকের ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। রূপনির দিকে হা হয়ে তাকচ্ছে সবাই। রূপনি যেন চিড়িয়াখানার জীব অথবা অন্য কিছু! ওদের ফিসফাস কথাও কানে আসে। রূপনি গা করে না।

নতুন বিল্ডিংটায় ঢুকতেই চারজন লোক একটা প্রাচীরের মতো সামনে এসে দাঁড়ায়। একজনের পকেট থেকে উকি দিচ্ছে একটা পিস্তলের বাট। রূপনি মনে মনে ভয় পায়। ভেবে পায় না পিস্তলধারীরা এখানে কেন? রূপনির সাথে আসা লোকটা একটা ইংগিত করতেই লোকগুলো সরে দাড়ায়। রূপনির ভয়টা কেটে যায়। রূপনি লোকটার পেছন পেছন হাঁটতে থাকে। সরু প্যাসেজটায় আসার পর লোকটি রূপনির দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘ঐ সোজা যে রুমটা। ঐটাই বসের রুম। আপনে যান।’ লোকটি আর দাঁড়ায় না-পিছনে ফিরে চলে গেল। রূপনি আরেকটু এগুতেই একটা চীৎকার ভেসে আসে, কেউ যেন কাকে ধমকাচ্ছে। খুব অশ্লীল ধরনের কথা। গলার স্বরটা রূপনির চেনা। পাপার গলা। এতক্ষণ পর্যন্ত যে দুশ্চিন্তা হিমালয়ে মতো ভারি হয়ে ওকে চাপা দিতে চেয়েছিল তা নেমে গেল যেন! ভেসে আসা পাপার গলাটা এত মধুর লাগেনি কখনো। রূপনির চলার গতি বেড়ে যায়। চারপাশের কোন কিছু না দেখে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে রূপনি তীব্র গতিতে ভেজানো দরজাটা ঠেলে রুমে ঢুকে গেল।

রূপনিকে দেখে পাপার মুখটা বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। পাপার সামনে আসামীর মত দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা মাথা তুলে রূপনির দিকে তাকালো। অসহায় চোখে রূপনিকে দেখে যেন বাঁচার একটা পথ পেল। পাপা রূপনির দিকে অবাক হয়ে তাকালো। রূপনি এসবের কিছুই দেখলো না। দৌড়ে গিয়ে পাপাকে জড়িয়ে ধরল। রূপনির দুচোখ পানিতে ভরে গেল। রূপনি পাপার কাঁধে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো।

চলবে