রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ৯

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : মে ২৬, ২০১৯

দশ.
লালনের ভাস্কর্য ভাঙার ঘোষণা দিয়ে মৌলবাদীরা বসে নেই। প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের বিবৃতি আর তৎপরতার খবর আসছে পত্রিকার পাতায়। সেই তুলনায় ঈশানরা তেমন কিছু করে করতে পারছে না। মৌলবাদীরা জরুরি অবস্থা উপেক্ষা করে মিছিল ও সমাবেশের ডাক দিয়েছে। ভাস্কর্য ভাঙার কর্মসূচি দিয়ে তারা একটা সুদুরপ্রসারী মতলবে নেমেছে। আনা আপাকে নিয়ে সমথর্নের আশায় নানা জায়গায় ধর্ণা দিলেও তেমন কাজ হচ্ছে না। মূলধারার ছাত্র সংগঠনগুলো ওদের পাত্তাই দেয়নি। আনা নেত্রী হওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে কিনা সেই প্রশ্নও তুলেছে কেউ কেউ। আরও নানা অপমানজনক কথা বলেছে। তবু আনা আশা ছাড়ছে না।

আজ আনা আর ঈশান এসেছে খোদ ভাস্কর্য শিল্পীর বাসায়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই শিল্পীর এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেছে। আনা দীর্ঘক্ষণ ধরে ভাস্কর্য রক্ষায় ওদের বিভিন্ন ধরনের তৎপরতার কথা বিবৃত করল। শিল্পী মনযোগ দিয়ে সব কথা শুনলেন। তারপর আনাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন, তার পক্ষ থেকে কাউকে কোনো ধরনের অনুরোধ জানানো সম্ভব নয়। কেউ যদি ভাস্কর্য রক্ষা করতে চায় তবে তাকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই করতে হবে। এমন কি তিনি কোন ধরনের বিবৃতিও দেবেন না। শিল্পীর কাজ শিল্প সৃষ্টি করা, শিল্পরক্ষার দায়িত্ব শিল্পীর হতে পারে না। সরকার ও জনগণই কেবল শিল্পের রক্ষক হতে পারে।

কথাগুলো একজন শিল্পীর জন্য মানন সই হলেও ঈশানরা হতাশ হলো। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে খোদ শিল্পীকেই যদি না পাওয়া যায়, তবে ওদের কর্মকাণ্ডের নৈতিক ভিত্তি থাকে কোথায়! এ যেন যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়া-পড়শির ঘুম নেই অবস্থা।

রিকশায় বসে আনাকে ঈশান বলল, এরপর আমাদের বোধ হয় আর এগুনো ঠিক হবে না।
আমিও তাই ভাবছি। আনা  হতাশ গলায় বললো। তবে, আনা  ফের শুরু করলো, কিন্তু বিষয়টা এখন আর একটা ভাস্কর্যে সীমাবন্ধ নেই। এখানে লালন জড়িয়ে গেছে। গান বাজনা জড়িয়ে গেছে। আফগানিস্তানে তালেবানরা বমিয়ানের নিরীহ বুদ্ধমূর্তিকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল। শুধু একটি ভাস্কর্য গুড়িয়ে দেয়ার জন্য নয়। নিজেদের পাশব শক্তি দেখাতে। আমাদের মৌলবাদীরা এখন একই খেলায় মেতেছে। আমার মনে হয় আমাদের শেষ দেখা উচিত। শিল্পীর ওপর রাগ করে আমাদের হাল ছেড়ে দেয়া উচিত হবে না। এটা তো শিল্পীর অভিমানও হতে পারে।
তাহলে বিকেলে সবাইকে নিয়ে টিএসসিতে বসো। দেখো সবাই কি বলে।
তাহলে তাই করি।
বিকেলে টিএসসির সবুজ চত্বরে একে একে হাজির হলো সবাই। জাহিদ, পনির, আসফাক, প্রাইভেট ভার্সিটির নোভা ও আরও অনেকে। সবাইকে অবাক করে রূপনি আর রুশনি এসে হাজির। সব মিলিয়ে প্রায় বাইশ জন। অথচ প্রথম দিন ওরা ছিল মাত্র সাত জন। উদ্দীপ্ত হওয়ার মত ঘটনা। প্রথমেই আনা মুখ খুললো। হতাশ গলায় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা বললো। আন্দোলনের ব্যাপারে শিল্পির অনাগ্রহ বিবৃত করলো। ওরা প্রতিবাদ চালিয়ে যাবে কিনা সবাইকে ভেবে দেখতে বললো। আনার কথা শুনে সবার মুখ শুকিয়ে গেল। একটু আগে ওরা সবাই টগবগ করে উত্তেজনা ফুটছিল, আনা যেন পানি দিয়ে সব নিভিয়ে দিল। কারও মুখে ভাষা নেই যেন! কেউ ভাবেনি ওদের প্রতিবাদটা দানা বেঁধে ওঠার আগেই শেষ হয়ে যাবে। পুরো রুমটায় নীরবতা নেমে এলো।

চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে জাহিদ বলল, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে। জাহিদ হয়ত আনমনে কথা বলেছে, কিন্ত এই মুহূর্তে যেন সবার মনের কথাটা জাহিদ আপন মনে বলে ফেললো। ওর কথার শেষে ইকবাল ভাই হাততালি দিয়ে উঠলেন। ইকবাল ভাই’র দেখাদেখি সবাই হাততালি দিতে থাকল। বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে ইকবালভাই বললেন,‘তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়লো, আমরা এগিয়ে যাব। কেউ না এলে ক্ষতি নেই। আমার মনে পড়ছে উনিশ শ একাত্তরে আমরা কারও জন্য অপেক্ষা করিনি। আমি একাই, একলা ঘর ছেড়েছিলাম। আজকে এই তরুণ বন্ধুরা সেই একই তরুণ। তরুণ বন্ধুদের প্রতি আমার আহ্বান, এসো আমরা এগিয়ে যাই।

সম্ভবত আজই প্রথম ইকবাল ভাই মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হওয়ার কথা উল্লেখ করলেন। তার কথায় আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। এবার ওরা ওদের কর্মসূচি ঠিক করার কাজে লেগে গেল। ভাস্কর্য ভাঙার দুদিন আগে মৌলবাদীরা গণ-মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে। ঠিক হলো একইদিন টিএসসির সামনে থেকে মিছিল বের হবে। মিছিল নিয়ে ভাস্কর্য রক্ষার দাবিতে ওরা এয়ারপোর্টে দিকে যাবে। পুলিশ হয়তো ওদের আটকে দেবে। এ কারণে রবীন্দ্র মঞ্চে গণ-সঙ্গীতের আসর আর সমাবেশ চলবে। তবে গণ-মিছিলের কর্মসূচির কথা এখন গোপন রাখা হবে। এতসব কথার পর সবাই খুব উত্তেজিত। এমনকি রূপনির কাছে ব্যাপারটা বেশ নুতন এবং থিল্ড মনে হলো। এ সব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষে চা বিরতির পর শুরু হলো গানের রির্হাসেল। আনা গান ধরল। রূপনির কাছে এটা এক নুতন অভিজ্ঞতা। গানগুলো ব্যান্ডের গানের চেয়ে আলাদা-সুর ভিন্ন অনুভূতিটাও ভিন্ন। বিশেষ করে আনার কণ্ঠে ‘বাড়ির পাশে আরশি নগর’ গানটা রূপনির মনে গেঁধে রইল। রিহার্সেল শেষে যখন সবাই আড্ডার মেজাজে তখনই রূপনির ঐ গানটার কথা মনে পড়ল।

পাশে বসা ঈশানকে রূপনি বলল, ‘ঈশান ঐ আরশি নগর গানটা এখানে কে লিখেছে, আমি তাঁকে থ্যাকস্ দিতে চাই।’ ঈশান অবাক হয়ে রূপনির দিকে তাকাল। রূপনি একটি সম্মিলিত হাসির শব্দ শুনতে পেল। রূপনি দেখল হাসির লক্ষ্যবস্তু আর কেউ নয়, রূপনি নিজে। ভীষণ অপ্রস্তুত মনে হলো নিজেকে। ঈশানও ওর দিতে তাকিয়ে হাসছে যেন! ইকবাল ভাই এগিয়ে এসে বলল, ওই গীতিকারকে পেতে হলে তোমাকে অন্তত দেড়শো বছর আগে ফিরে যেতে হবে। গীতিকারের নাম লালন ফকির।’ রূপনি অবাক হয়ে একবার ঈশানের দিকে আরেক বার ইকবাল ভাইয়ের দিকে তাকালো। আবার সম্মিলিত হাসি উঠল। রূপনি এবার লাল হয়ে গেল, ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কান্না চেপে রাখতে। আনা এসে ওর পিঠে হাত রাখল, সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এতে হাসির কিছু নেই। রূপনিকে আমি বুঝিয়ে বলছি।’

আনার কথায় রূপনির দুঃখটা বেড়ে গেল যেন! অপমানটা ভুলতে পারলো না। রূপনি ব্চ্চাা মেয়ের মত আনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। চলবে