রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ১১

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : মে ২৯, ২০১৯

১২.
জন্মদিনের দিন অনেক ভোরে রূপনির ঘুম ভাঙে। সতের শেষে আজ আঠারো বছর বয়সের প্রথম সকাল। বাথরুম সেরে রূপনি একটা হাউসকোট গায়ে জড়িয়ে নিল। জানালার কাছে গিয়ে পর্দাটা সরিয়ে দিল। বার্ড’স আই ভিউ থেকে বাইরে তাকালো। অক্টোবরের হালকা একটা কুয়াশার চাদরে মুড়ে আছে ঢাকা শহর। সূর্য উঠতে এখনো অনেক দেরি। আধো আধো আলোতে দেখা যাচ্ছে ঢাকার স্কাই-স্কাপারগুলো, কোন কোনটার গায়ে এখনো আলোর রশ্মি। হাইওয়ের ওপর দিয়ে এখনো সার বেঁধে ছুটে যাচ্ছে বিভিন্ন যানবাহন। চমৎকার দেখাচ্ছে গাড়ির হেডলাইটের আলো। গাড়ি নয়, যেন এদিক সেদিক ছুটে যাচ্ছে ঝাঁক ঝাঁক লাল-কমলা আলো। আসলে এই শহরটা কখনো ঘুমায় না। এমন কি এই ভোরেও না। আরও ভাল করে শহরটা দেখার জন্য রূপনি জানালার পাল্লা সরিয়ে দিল। রূপনির রুমে এসি চলছে। এরপরও একটা ঠাণ্ডা তাজা বাতাস যেন ছুটে এলো। টাটকা বাতাসটা ভাল করে গায়ে লাগাতে রুপনি হাউস কোটের ফিতেটা ঢিলা করে দিল। তাজা বাতাসে শিরশির করে উঠল ওর দেহটা। ভোরের তাজা বাতাস যে এতো চমৎকার আগে জানা ছিল না। রূপনি ঠিক করলো এখন থেকে প্রতিদিন সকালে ভোরের তাজা বাতাসে ভিজবে। ওর চোখ গেল জানালা লাগোয়া বারান্দার গ্রীলে। চমৎকার দেখতে দুটি ছোট দোয়েল পাখি বসে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে রূপনিকে দেখল যেন তারপর লজ্জা পেয়ে উড়ে গেল। এই সব পাখিদের প্রতিদিন খাবার দিলে কেমন হয়? রূপনি ঠিক করল এখন থেকে এই পাখিদের প্রতিদিন খাবার দেবে। বুয়াদের দিয়ে নয়, নিজ হাতে পাখিদের খাবার দেবে। তারপর হয়ত পাখিরা ওকে বন্ধু ভাববে। ওর ডাকে চলে আসবে। হাতের ওপর বসে খাবার খাবে।

ঢাকার আকাশ আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে শহরটা। অনেক দূর থেকে শব্দ করে এগিয়ে আসছে একটা বিমান, যেন ঘুম ভাঙাচ্ছে ঢাকার। রূপনি পূব আকাশে তাকালো, আকাশটা লাল হয়ে গিয়েছে। সূর্য উঠি উঠি করছে। রূপনির মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল এ সময়। রিংটোন বলে দিচ্ছে পাপার ফোন। ঘুম জড়ানো গলায় পাপা বললেন, ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।’ কালরাতে পাপা অনেকদিন পর বাড়িতে এসেছেন। রূপনির কি যে ভাল লাগছে! সেই দিন পুরানো ঢাকার ঘটনার পর আজ পাপার সাথে দেখা হবে। ঐ দিন পাপা রূপনির ওপর একটু রাগ করেনি। শুধু বলেছিল, ‘একটা ফোন করে আসলেই হতো।’

তাহলে তুমি কি সারপ্রাইজ পেতে! রূপনি বলেছিল। পাপা বাচ্চা ছেলের মত মাথা দোলাচ্ছিল। পাপাকে তখন পৃথিবীর সেরা পাপার মত লাগছিল। পাপার আশপাশে থাকা বাজে লোকগুলোকেও তখন আর এত খারাপ লাগেনি। তারপর পাপা ওকে নিয়ে লাঞ্চের জন্য এসেছিল সোজা সোনারগাঁও হোটেলে। অদ্ভুত সুন্দর কেটেছিল সেই দিনটা! পাপা এখন বেডরুম থেকে ফোন করেছেন। রূপনি ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকালো। প্রচুর ম্যাসেজ এসে ম্যাসেজ অপশন ভরিয়ে দিয়েছে। সব বন্ধুদের বার্থ ডে-উইশ। প্রথমে জকির ম্যাসেজ ওপেন করলো। জকির ম্যাসেজ পড়ার পর অন্য ম্যাসেজগুলো ওপেন না করে সবার নাম গুলো দেখে নিল। সবার সাথে সেই রোদে পোড়া ছেলেটা, ঈশানও ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। এখন মনে পড়লো এই ছেলেটাকে আজ রাতে ওকারার পার্টিতে ডাকা হয়নি। ডাকবে কি করে? ওর কাছে আর বাড়তি টিকেট নেই! তা ছাড়া ছেলেটার কোন বান্ধুবী আছে কিনা রূপনি জানে না। বান্ধুবি ছাড়া ওকারার পার্টিতে যাওয়ার নিয়ম নেই। আনা নামের সেই সিংগার মেয়েটার সাথে এই ছেলেই ঘুরে বেড়ায়। আনা ওর বান্ধুবি কিনা কে জানে! ওরা সবাই বেশ ভাল, তবে অনেক শক্ত শক্ত কথা বলে। রূপনি ওদের সব কথা বোঝতে পারে না। এই জন্য লালনের গানের গীতিকারের সাথে কথা বলতে চাইলে ওরা হেসেছিল। আনা রূপনিকে লালানের ওপর একটা বই গিফট দিয়েছে। রূপনি সময় পেলে বইটা নাড়াচাড়া করে দুর্বোধ্য লাগলেও অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে। এছাড়া ওরা যা করতে চাইছে তা এক্স্যাইটিং, নিশ্চয়ই ইনজয় করা যাবে। ওদের জন্য ফিলিংস থাকা সত্ত্বেও ওকারার পাটিতে ওদের নিয়ে আসা যাচ্ছে না। জন্মদিনের দিন মন খারাপ না করতে চাইলেও ওদের কথা ভেবে এখন রূপনির মনটা খারাপ হলো।

দুপুরের পার্টির জন্য মা সকাল থেকে নিজ হাতে নানা রকমের রান্না করেছে। প্রচুর রান্না হলেও পাপার দু একজন বন্ধু ছাড়া আর কেউ বাড়িতে আসবে না। আসলে ওদের বাড়িতে তেমন কেউ আসে না। পাপা একটা পেল্লাই সাইজের কেক কেটে একটি টুকরা রূপনির মুখে তুলে দেবেন। মা ওর কপালে চুমু দেবেন। এই মুহূর্তগুলো রূপনির ভাল লাগে।

ওকারার ডিসকো শুরু হয় রাত নয়টায়। মাঝারি সাইজের বল রুমে মঞ্চ বানানো হয়েছে। পুরো রুমটা আলো-আঁধারিতে ভরা। একপাশে বার, বিভিন্ন কুপন বিক্রির ব্যবস্থা। রূপনি আজ স্পেশাল একটা পোশাক পড়েছে, প্যারিস থেকে নিয়ে আসা। রূপনি নিশ্চিত এই পোশাকের কপি অন্তত এই রাতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। রূপনি যখন ওকারায় এলো ততক্ষণে ওর বন্ধুরা এসে গেছে। উনিশটি জোড়া। সুতরাং আজকে রূপনির দলটাই আসর মাতাবে। রূপনিকে দেখে সবাই হ্যাপি বার্থ ডে বলে চেঁচিয়ে উঠল। রূপনি একে একে সবার সাথে হাগ করলো।

জকি এখনো আসেনি। ফোনে জানিয়েছে আধা ঘণ্টা পরে আসবে। জকির জন্য মায়া হলো, বেচারার সময় সংকট। তবে সময় জ্ঞান নিখুঁত। নিশ্চিত আধা ঘণ্টা পরে আসবে। একদিকে ভালই হয়েছে। এই সময়টা রুপনি অন্যদের সাথে কাটাবে। পাঁচ মিনিট পরই হেভি মেটালের মূর্ছনায় কেঁপে উঠল পুরো বলরুম। এই মিউজিকের সাথেই  এখনই দেহ দোলাচ্ছে কেউ কেউ। রুপনিকে নিয়ে ড্রিঙ্কস্ কর্ণারের সামনে এলো ওদের দলটা। একজন একটা শ্যামপেইনের কর্ক ওপেন করলো। ছিটকে বেরুলো শ্যামপেইনের ধারা। স্পট লাইট এসো পড়ল ওদের গোটা দলের ওপর। এ সময় হেভিমেটাল বন্ধ হয়ে এনাউন্সমেন্ট এলো ‘হ্যাপি বার্থডে টু রুপনি।’ তারপরই জন্মদিনের গান। গোটা হল রুমটা তীব্র হাততালি মুখর হলো। ঘোষক বললেন আজকের সন্ধ্যায় যেহেতু অন্য কারও জন্মদিন নেই সেই কারণে এই সন্ধ্যা রুপনির জন্য উৎসর্গ করা হলো। রূপনির হাতে একজন এসে শ্যামপেইনের গ্লাস তুলে দিল। স্পট লাইটটা ওর ওপর থাকায় গোটা হলরুমের সবাই রুপনিকে দেখছে। রুপনি গ্লাস উচু করে সবাইকে দেখিয়ে হালকা চুমুক দিল। গোটা হলরুমটা করতালিতে ফেটে পড়ল যেন। এরপর মঞ্চে লাইফ কনসার্টের শিল্পিরা। ইনানির হালকা গান দিয়ে কনসার্ট শুরু হলো, শ্যামপেইনের সিপ্ নেয়ার পর রূপনির দেহটা হালকা মনে হলো। দেহটা আর যেন দেহে নেই, উড়ছে। সবাই রুপনিকে উইশ করছে। রূপনি ভাবছে জকির কথা, কখন জকি আসবে। রূপনি দেখল রুশনি আর নোভা হাত ধরাধরি করে নাচছে। মিউজিকের তালে তালে ওদের দেহ এক হয়ে যাচ্ছে কখনো কখনো। মাঝে মাঝে রুশনির ঠোঁটে নেমে আসছে নোভার ঠোঁট। আধা ঘণ্টা শেষ হচ্ছে অথচ জকি আসছে না। জকির ওপর রাগ হলো রূপনির, এভাবে আর কতক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?

রূপনির বিরক্তি যখন চূড়ান্তে তখনই জকি পেছন দিক থেকে এসে রূপনিকে জড়িয়ে ধরল। জকির স্পর্শে রূপনির গোটা দেহটা কেঁপে উঠল যেন! জকি এতক্ষণ নানা ধরনের কাজ সেরে এসেছে। আজকের এই আয়োজনের নেপথ্য কারিগর জকি। ওর লোকদের নানাভাবে কাজে লাগিয়ে এখানে আসতে হয়েছে। জকির ইশারায় মঞ্চে একটা সাইড টেবিল রাখা হলো। টেবিলের ওপর নিয়ে আসা হলো পেল্লাই সাইজের একটা কেক। রূপনির জন্য জকির গিফট। এনাউন্সমেন্টে রূপনিকে কেক কাটার জন্য ডাকা হলো। জকির সাথে গিয়ে রূপনি কেক কাটল। পুরো হলরুমটা করতালিতে ফেটে পড়ল যেন! কেক কাটার পরই ব্যান্ডের গায়করা মঞ্চে এসে গান ধরল। গানের পর একদল মেয়ে স্বল্প পোশাকে মঞ্চে এলো। স্বচ্ছ পোশাকে ওদের দেহের প্রতিটা বাঁক স্পষ্ট। মেয়েগুলোকে দেখে ছেলেরা সিটি দিচ্ছে। এরা স্ট্রিপিস্ ড্যান্সার কিনা, কে জানে! এই পরিবেশে যা হয়, রূপনি আর বেশি কিছু ভাবতে পারে না। জকি এসে ওর কাঁধে হাত রাখে। মঞ্চে শুরু হয়েছে ঘূর্ণি উত্তাল নৃত্য। ওদের দেখাদেখি পুরো ফ্লোরের তরুণ-তরুণীরা উদ্দাম হয়ে উঠল। এরমধ্যেই কেউ একজন ইয়াবার প্রসঙ্গ উঠাল। এই নিয়ে ফিসফাস গোটা ফ্লোর জুড়ে। দেখা গেল ড্রিঙ্কস্ কর্নারের কাছেই ইয়াবা বিক্রির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ইয়াবা নেয়ার জন্য পুরো ফ্লোর যেন ভেঙে পড়ল সেদিকে। সেদিকে তাকিয়ে রূপনিকে বাহুবদ্ধ করে জকি তৃপ্তির হাসি হাসল। এই হাসির রহস্য রূপনি কেন, কেউ জানবে না।

এই ফ্লোরে সময় নিমিষে উড়ে যায়। প্রথম দিকে কথাবার্তা চলে লঘু লয়ে, সময়ের সাথে সাথে গুনগুন শব্দ বেড়ে যায়। শেষদিকে সবার কণ্ঠ জড়িয়ে গেলেও গলার স্বর উচ্চগ্রামে ওঠে। খিস্তি-খেউর চললেও কারও কথা শোনার মতো সময় ও ধৈর্য কারও নেই এখন। এখন সবাই বক্তা, বিশেষ করে ছেলেগুলো। ছেলেরা এখন যেমন নিজেদের রাজা ভাবছে, মেয়েরা তেমনি নিজেদের রানি ভাবছে। বান্ধবীদের কানের কাছে মুখ নিয়ে নানা ধরনের কথার ফোয়ারা ছোটাচ্ছে সবাই। ওদের যেন গতকালও নেই, আগামীকালও নেই, আছে শুধু এই মুহূর্ত, আজ। তিনঘণ্টা সময় কখন যে শেষ হয়ে গেল টের পেল না কেউ। এবার শুরু হলো অন্য পর্ব। এই ক্লাবে আছে অনেকগুলো প্রাইভেট রুম। এই রুমগুলো স্বল্প সময়ের জন্য ভাড়া দেয়া হয়। আজ রাতের জন্য যারা এই রুমগুলোর রির্জাভেশন পেয়েছে তারা নিজেদের ভাগ্যবান ভাবছে। ড্রান্স ফ্লোর থেকে অনেক কাপল প্রাইভেট রুমে ঢুকে যাচ্ছে। এখন আর কাউকে দেখছে না, নিজেদের নিয়ে নিমগ্ন সবাই। মঞ্চে ওপর যে মেয়েগুলো নেচে চলছে, তাদের তাল-লয় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ঠিক স্ট্রিপস্ না হলেও ভঙ্গিমা গুলো স্ট্রিপসের এক কাঠি বাড়া, অশ্লীল। ভাগ্যিস্ প্রতিটি ছেলের সাথেই বান্ধবী রয়েছে, বান্ধবীরা না থাকলে মঞ্চে অন্যরকম ঘটনা ঘটতে পারত।

রূপনির ঠোঁটে কখন যে জকির ঠোঁট নেমে এসেছে রূপনি জানে না। রূপনি এখন বেপরোয়া, শ্যামপেইন কাজ শুরু করেছে। কারও স্পর্শ যে এতো ভাল লাগে রূপনি আগে কখনো বুঝতে পারেনি। জকি ছাড়া ওর সামনে আর কিছু নেই যেন! জকি দু হাত দিয়ে রূপনিকে যেন নিজের সাথে পিশিয়ে ফেলতে চাচ্ছে। জকি রূপনিকে চুমো খেতে খেতে প্রাইভেট রুমের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। রূপনির দেহটা এখন আর নিজের নেই। দেহটাও যেন আরও কিছু চাচ্ছে। দেহটাকে জকির ওপর ছেড়ে দিয়ে রূপনি যেন নির্ভার হতে চাচ্ছে!

চলবে