রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ১২

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : মে ৩০, ২০১৯

তের.
ঈশানরা ঠিক করেছে, ওরা এখন আর বড় কোনো রাজতৈনিক দল কিংবা ব্যক্তির কাছে উপযাজক হয়ে সমর্থনের আশায় যাবে না। এদের পেছনে ঘুরে যথেষ্ট তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। তারচেয়ে পাবলিক ও প্রাইভেট ইউনিভারসিটির অরাজনৈতিক ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রচার জোরদার করাই উত্তম। ওদের আন্দোলনের একটা অরাজনৈতিক আদল রক্ষাও জরুরি। এ কারণে ঈশান একাই বিভিন্ন প্রাইভেট ইউনিভাসিটির ক্যাম্পাসগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

নোভা ওকে ওদের ক্যাম্পসে আসতে বলায় ঈশান এসেছে। কিন্তু নোভাকে পায়নি। মোবাইল ফোনে নোভা জানালো, একটা কাজে আটকে আছে। ওর আরো ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোতে একাকি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যায় না। সিকিউরিটির লোকরা এসে নানা ঝামেলা পাকায়। ঈশান ভাল ফাপড়ে পড়ল। চলে যাবে কিনা ভাবছে। এমন সময় রূপনির সাথে সাথে দেখা। ঈশানকে দেখে রূপনি এগিয়ে এলো। কিছুদিন আগে রূপনি বেশ ঘটা করে ওর আঠারতম জন্মদিন পালন করেছে। নোভা ঈশানকে সবই বলেছিল। রূপনিকে সে জন্য বোধ হয় আজ ম্যাচির্উড মনে হচ্ছে। চেহারায় আগের সেই ছেলেমানুষি ভাবটা নেই যেন।

রূপনি ঈশানের পোষাক-আষাকগুলো ভাল করে দেখল। ছেলেটার রোদে পোড়া চেহারার মতই রোদে পোড়া পোষাক-আষাক। এগুলো যেন ওর ট্রেডমার্ক। ফেড জিন্সের ট্রাউজার আর নীল কটন শার্ট। ছেলেটার কাছে যেন পোষাক-আষাকের কোন দামই নেই। যতটুকু না হলে চলে না ততটুকুই পড়েছে ছেলেটি। এই ছেলের সাথে জকির তুলনা করলে রাত ও দিনের উপমা চলে আসে। দুজন সার্বিক অর্থেই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। জকি অসাধারণ, নিজের প্রতিটি ব্যাপারে অতি সচেতন। ঈশান খুবই সাধারণ, উদাসীন। তারপর কেন যেন ঈশানকে উপেক্ষা করা যায় না। কে কোথায় একটা স্কাপচার ভাঙবে, সেটা নিয়ে এই ছেলেটা রাতদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়! নিজের খেয়ে পরের মোষ তাড়ায়!

এখন দেখে মনে হচ্ছে, ছেলেটা লাঞ্চ করেনি অথবা লাঞ্চ করার সময় পায়নি। কি কেয়ারলেস টাইপের ছেলেরে বাবা! রূপনির মায়া লাগে। ‘তুমি বোধ হয় নোভার জন্য বসে আছ। ফোনে কন্টাক করনি?’ এগিয়ে গিয়ে রূপনি ঈশানকে বলল। ঈশান বলল, কথা হয়েছে। বলল, অপেক্ষা করতে। এসে যাবে বোধ হয়।

রূপনি বলল, ওর কথা ছাড়ো তো। নোভার নয়টার গাড়ি বারোটায় ছাড়ে। এখানে আর কতক্ষণ দাঁড়াবে! চলো আমাদের ক্যান্টিনে।
তোমার ক্লাশ নেই?
দু ঘণ্টার ব্রেক।
ঈশান আর কথা বাড়ালো না। রূপনির সাথে হাঁটতে লাগলো। রূপনির সাথে হাঁটতে ভালই লাগছে। ছিমছাম ক্যান্টিনের কোণার দিকে একটা টেবিলে মুখোমুখি বসল দুজনে। ঈশানের দিকে তাকিয়ে জকির একটা কথা মনে পড়ল। জকি বলেছে এই পৃথিবীতে সবাই টাকার পেছনে ছুটছে। কেউ যদি সময়ের সাথে সাথে টাকা বানাতে না পারে তবে সে ছিটকে যাবে। ছিটকে পড়া মানুষের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। যদি জকির কথা সত্য হয় তবে সামনে বসা এই ছেলেটার ভবিষ্যত অন্ধকার। এ কয় দিনে কখনো মনে হয়নি ছেলেটা টাকার পেছনে ছোটে কিংবা ছোটার চেস্টা করছে! এটা সত্যি হলে ছেলেটার সামনে একটা ভয়াবহ ভবিষ্যত, যত সময় যাবে ঈশান ততই নিঃস্ব হতে থাকবে। রূপনির উচিত বন্ধু হিসাবে ঈশানকে সাবধান করে দেয়া। একদিন ঈশানদের কথা জকিকে বলতে জকি আর হাসি ধরে রাখতে পারেনি। জকি ভাষায় এরা সব পাগল, নয়তো বিপদজনক। রূপনিকে বলেছে এদের সাথে কোন সর্ম্পক না রাখতে। রূপনি এরপর থেকে একটু দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে আছে। ঈশানের সাথে কথা বলে সবকিছুর সুরাহা করে নিতে চায়।

রূপনি বলল, আচ্ছা ঈশান এই যে তোমরা স্কাপচারটা ভেঙ্গে ফেলতে দিতে চাচ্ছ না, এই জন্য কি তোমরা কোন টাকা পাবে? ঈশান অবাক হয়ে রূপনির দিকে তাকালো। ভেবে পাচ্ছে না এতে টাকার কথা কেন আসছে! ‘টাকা! আমরা টাকা পাব কেন? কে আমাদের টাকা দেবে! আর এখানে টাকার প্রশ্ন উঠছে কেন?’ ঈশান অবাক হয়ে রূপনিকে বলল। ‘বারে, এই স্কাল্পচারটা যারা বানিয়েছে তারাই তো তোমাদের টাকা দিতে পারে। কারণ তোমরা তো সেটা রক্ষা করতে চাচ্ছ। এজন্যই বলছি টাকা পাবে কি না? রূপনির কথা শুনে ঈশান থ বনে গেল। ভেবে পাচ্ছে না কি ভাবে এর উত্তর দেবে। মৃদু স্বরে শুধু বলল, পৃথিবীর সব কিছু কি টাকার জন্য হয়! রূপনি বলল, যদি টাকা না পাবে, তবে তোমাদের কি স্বার্থ এ সব ঝুট ঝামেলা পাকিয়ে?

রূপনির কথা শুনে ঈশান হেসে ফেলল। ভাবছে রূপনির এই প্রশ্নের উত্তর কেমন করে দেবে? কিছুক্ষণ চিন্তা করে ঈশান বলল, ‘তোমার এই প্রশ্নে উত্তরটা পেতে হলে আমার কথা একটু মন দিয়ে শুনবে রূপনি। হাঁ আমরা এই যদি এ ধরনের কাজ করি, তবে কেউ আমাদের পয়সা টাকা দেবে না। পুলিশ আমাদের মারতে পারে, আমাদের জেলে পাঠাতে পারে। তারপরও আমাদের কাজের সাথে টাকার একটা সম্পর্ক আছে। টাকা আমরা পাবো।
টাকা তাহলে তোমরা পাবে? রূপনি একটু নড়েচড়ে বসল।
দেখো, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা ঘর ছেড়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল, তাদেরকে কিন্তু কেউ বলেনি যে মুক্তিযুদ্ধে গেলে টাকা পাওয়া যাবে। এমন কি মুক্তিযুদ্ধে গেলে পেট ভরে ভাত খাবে এই ভরসাও কেউ তাদের দেয়নি। সুতরাং ধরে নেয়া যায় মুক্তিযোদ্ধারা টাকার জন্য যুদ্ধ করেনি। তারপর টাকার জন্যই তারা যুদ্ধ করেছে। ঈশান একটু থামল, রূপনির প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইল। ‘ভ্যারি কন্ট্রডিকটারি! একবার বলছ মুক্তিযোদ্ধারা টাকার জন্য যুদ্ধ করেনি, আবার বলছ টাকার জন্য যুদ্ধ করেছে।’ রূপনি বলল। ‘ওয়েল, পাকিস্তানিরা তখন আমাদের টাকা পয়সা গায়ের জোরে নিয়ে যেত। এখন কেউ আর আমাদের টাকা পয়সা নিয়ে যেতে পারে না। ১৯৭১ সালে এই ঢাকা শহরটা একটা আধা গ্রাম আধা শহর গোছের একটা কিছু ছিল। ধর তোমাদের এই ক্যাম্পাস, এই ঝা চক্চকে ক্যাম্পাস তখন কল্পনাও করা যেত না। স্বাধীন না হলে এসবের কিছুই হত না। মুক্তিযোদ্ধারা টাকার জন্য যুদ্ধ না করলেও আমাদের জন্য টাকার ব্যবস্থা করে গেছে। প্রাদেশিক রাজধানী থেকে ঢাকা এখন একটা স্বাধীন দেশের রাজধানী। এই যে ঢাকার উত্তরন এতে কি টাকা পয়সার ব্যাপার নেই? স্বাধীনদেশের রাজধানীতে তুমি-আমি দাপিয়ে বেড়াচ্ছি! এতে কি কোন ইনভেস্টমেন্ট নেই? অবশ্যই আছে। মুক্তিযোদ্ধারা রক্ত দিয়ে এই ইনভেস্ট করেছে।

বুঝলাম, আর এই স্কাল্পচারের ব্যাপারটা? এর সাথে টাকার পয়সার সম্পর্ক কি?
দেখো, যারা এই স্কাল্পচার ভাঙ্গতে চায় তারা আরও অনেক কিছু করতে চায়। তারা মেয়েদের ঘরের ভেতর বন্দি করতে চায়। এতে করে দেশের অর্ধেক জনশক্তি নিষ্ক্রিয় হবে যাবে। তারপর তারা আমাদের কালচার ধ্বংস করবে। এতে করে দেশে যারা গান করে, যারা ছবি আঁকে, অভিনয় করে, নাটক সিনেমা বানায় তারা সব বেকার হয়ে যাবে। এসবের সাথে টাকা পয়সার ব্যাপার জড়িত। মৌলবাদিরা বিজয়ী হলে আমরা গরীব হয়ে যাব। এ কারণেই আমি বললাম আমাদের সাথেও টাকার সর্ম্পক আছে।

আমাদের গর্ভামেন্ট কি করে? তারা কি এ সব বুঝে না?
আমাদের গভার্মেন্টের টার্গেট হলো তাদের মেয়াদ নির্বিগ্নে পার করা। নিজেদের আখের গোছানোর জন্য তারা সবই করতে পারে। তাদের মধ্যেও মৌলবাদিরা আছে, ইহকাল বাদ দিয়ে পরকাল নিয়ে টানাটানি করার লোকের অভাব নেই। আর সবকিছুর মধ্যে ধর্ম টেনে আনলে ধর্মের নামে শাসন করা যায়, একদল লোককে বোকা বানানো যায়। পরকালের লোভ দেখিয়ে ফয়দা লোটা যায়। এ ছাড়া এ মুহূর্তে মৌলবাদীদের সমথর্ন সরকারের দরকার।

তোমার কথাগুলো খুব জটিল, বলে রূপনি চায়ে চিনি মিশাতে মিশাতে বলল। ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।’ রূপনির দিকে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে ঈশান বলল।

চলবে