
রূপনির রূপকথা
উপন্যসা ১৩
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জুন ০১, ২০১৯
১৪.
খুব ভোরে ঈশানের ঘুম ভেঙে গেল। আগামীকাল সেই শুক্রবার, এই দিন লালনের ভাস্কর্য গুড়িয়ে দেয়া হবে। মৌলবাদীরা আজ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় গণ-সংযোগের কর্মসূচি দিয়েছে। ঈশানরা আজ বিকেলে টিএসসিতে একসঙ্গে বসে কালকের কর্মসূচির নানা প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনায় করবে। ঈশান ওর মোবাইল ফোনের দিকে তাকালো। অনেকগুলো মিসকল, আনা আর রূপনির। বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথমেই ওকে ফোনে অন্তত একহাজার টাকার কার্ড ভরতে হবে। তারপর সবাইকে বিকেলে টিএসসিতে আসার জন্য বলতে হবে। চারুকলার ছেলেরা একটা ব্যানার এঁকে নিয়ে আসবে। ঈশানকে লালন ভাস্কর্যের শিল্পীর বাসায় যেতে হবে। ওই শিল্পী যদি আগামীকালের মিছিলে থাকে তবে ওদের মিছিলটা অর্থবহ হবে। মিডিয়া এগিয়ে আসবে, অন্য হোমড়া-চোমড়ারাও এগিয়ে আসবে। কিন্তু সমস্যা হলো, শিল্পীর সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মোবাইল ফোন বন্ধ। বনানীর এলাকার একটা বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে শিল্পী থাকেন। শিল্পীর বাসায় গিয়ে ঈশানের হতাশা বাড়ল। অ্যাপার্টমেন্টের সিকিউরিটি গার্ড বলল, দু’দিন আগে শিল্পীকে দেখেছে। বাসায় যে বুয়া কাজ করে সেই বুয়া শিল্পীকে না পেয়ে ফিরে গেছে। এছাড়া আর কোনো তথ্য লোকটি দিতে পারল না।
ঈশান চিন্তায় পড়ে গেল। এখন শিল্পীর সাথে যোগাযোগের উপায় কি? আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে ঈশান রিকশায় চাপল। হঠাৎ করে একটা আশঙ্কা উঁক দিল, শিল্পীকে কি পুলিশ ধরে নিয়ে গেল? মৌলবাদী অথবা অন্য কেউ কি গুম করে ফেলল? ঈশান মোবাইল ফোনে আনাকে সবই বলল। আনা চিন্তিত কণ্ঠে ওকে তাড়াতাড়ি টিএসসিতে আসতে বলল।
টিএসসিতে জাহিদ আর আনাকে পেয়ে গেল। আনা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, তোর কথা সত্যি হলে ঘটনা খুব খারাপ। চল আগে চারুকলায় যাই। সেখানে গিয়ে সবার সাথে আলাপ করে দেখি।
ওরা যখন চারুকলায় পৌঁছল, তখন ক্লাশ শেষ তো বটেই অফিস তালা বদ্ধ। চারুকলার বাইরে দু চারজন ছাত্র-ছাত্রী আড্ডা দিচ্ছে। আনা ওদের চেনা, ওরা নিজেরাই এগিয়ে এলো। আনা ওদের সব খুলে বলল। একটি ছেলে মোবাইল ফোনে ওদের এক টিচারের সাথে কথা বলতে লাগল। আনা আর ঈশানরা অধীর আগ্রহে ছেলেটির কথা শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। ছেলেটি বলল, ওর স্যার বলেছে, আরও দু’এক দিন অপেক্ষা করে থানা পুলিশ করা উচিত। এভাবে হঠাৎ হঠাৎ কোথাও চলে যাওয়াই শিল্পীর স্বভাব। আনা কিংবা ঈশান কেউ এই যুক্তিটা মেনে নিতে পারছে না। একটা আশঙ্কা যেন থেকেই যাচ্ছে! আনা বলল, আমি বলি কি, আমরা যে শিল্পীকে খুঁজে পাচ্ছি না এ ব্যাপারটা মিডিয়াকে অন্তত জানানো উচিত।
ঈশান বলল, ঠিক বলেছ। এতে অন্তত শিল্পী কোথাও গিয়ে থাকলেও আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে। তাহলে আগে চলো প্রেস ক্লাবে যাই। আমার এক ইউনির্ভাসিটি রির্পোটার বন্ধু আছে, দেখি ওকে ফোনে পাওয়া যায় কিনা। ঈশান মোবাইল ফোনে ওর বন্ধুর সাথে কথা বলতে লাগল। ভাগ্য ভালো বন্ধুটিকে পাওয়া গেল। বন্ধুটি প্রেসক্লাবেই আছে। ওদেরকে সময় নষ্ট না করে ক্লাবে যেতে বলল।
ওরা যখন প্রেসক্লাবে এলো তখন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। সব রিপোর্টার আর ফটো জার্নালিস্ট যেন ওদের অপেক্ষায় ছিল। কারণ আছে। কিছুক্ষণ আগে মৌলবাদীরা একটা জমজমাট প্রেস কনফারেন্স করে গেছে। বিমানবন্দরের সামনের ভাস্কর্য ভাঙবেই, ভবিষ্যতে পর্যায়ক্রমে সব ভাস্কর্য গুড়িয়ে দেয়ারও হুমকি দেয়া হয়েছে। সুতরাং এই গোষ্ঠির বিরুদ্ধে একটা মতবাদ কিংবা কর্মসূচির সমান গুরত্বপূর্ণ। এছাড়া ঈশানের সাংবাদিক বন্ধু ওরা পৌঁছার আগেই প্রেসক্লাবে চলে এলো। অনেক সাংবাদিকই লালন-গানের শিল্পী হিসাবে আনাকে চেনে। সুতরা বারান্দায় বসলেও একটা তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন সহজেই হয়ে গেল।
আনা গুছিয়ে ওর বক্তব্য বলে গেল। তারপর শিল্পীর নিখোঁজ হওয়ার কথা বলতেই যেন বোমা ফটল। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। আনা খুব ভালভাবেই প্রশ্নগুলো মোকাবেলা করল। এরপর এক সাংবাদিক জিজ্ঞাস করলো, আপনারা টাকা পয়সা কোথায় পেয়েছেন, টাকার পরিমানই বা কত? প্রশ্নের ধরনে আনা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। মাথা নাড়িয়ে না, না করতে লাগল। সাংবাদিক বলল, কিন্তু আমার কাছে ইনফরমেশন আছে আপনি একটি এম্বেসিতে গিয়ে টাকা এনেছেন। আমি জানতে চাচ্ছি টাকার পরিমান কত।
এই প্রশ্নে আনা সত্যি সত্যি নার্ভাস হয়ে গেল। বলল, দেখুন আমি গত এক বছর কোনো এম্বেসিতে যাইনি। এ কথা আমি জোর গলায় বলতে পারি। ওই সাংবাদিক আবারো বলল, তাহলে বলুন আপনাদের ফিনান্স কে করছে? কত টাকা দিয়েছে? আনার বেহাল দশা দেখে ঈশান বলল, আমাদের কেউ ফিনান্স করেনি। এ পযর্ন্ত আমাদের পকেট মানি দিয়েই আমরা কাজ চালিয়েছি। আরেক সাংবাদিক প্রশ্ন করল, এই পকেট মানিটা আপনাদের কে দিল? কিছুটা রেগে আনা এবার বলল, পকেট মানি কাকে বলে ভাই!
সাংবাদিকটা ফের বলল, আমি জানতে চাচ্ছি টাকার অঙ্কটা। আনা বলল, ঠিক আছে বলছি, এরপর ঈশানকে দেখিয়ে বলল, আমার এই বন্ধুটাই অধিকাংশ টাকা খরচ করেছে। ঈশান প্লিজ এদের একটু বলে দে তুই এ পযর্ন্ত কত খরচ করেছিস। ঈশান বলল, এ পযর্ন্ত আমার প্রায় দুই হাজার টাকা খরচ হয়েছে, বিভিন্ন যাতায়াত খরচ বাবদ। কখনো রিকশায়, কখনো বাসে আর মাঝে মাঝে সিএনজিতে। মাঝে মাঝে গাড়িঅলঅ বন্ধুরা আমাকে লিফট দিয়েছে। আর এ টাকাটা আমি বিভিন্ন সময়ে মায়ের কাছ থেকে নিয়েছি।
এই উত্তরের পর প্রশ্নকর্তা সাংবাদিকে বোকা বোকা দেখাচ্ছে। আরেরক সাংবাদিক বলল, আপনারা বলছেন তেমন কেউ আপনাদের সাথে নেই, কেউ ফিনান্সও করেনি, তাহলে এই ধরনের ঝুঁকি নিলেন কেন?
আনা এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ফুঁসে উঠল যেন সে, বাহান্ন সালে যারা ভাষা আন্দোলন করেছিল, তাদের বাজেট কত ছিল ভাই? একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা কি বাজেটের জন্য বসেছিল? যেহেতু ওদের কোনো বাজেট ছিল না, আমাদেরও তেমন বাজেট নেই। আমরা আপনাদের মাধ্যমে সকলের কাছে অনুরোধ করছি আমাদের সাথে থাকুন, আমাদের সমথর্ন করুন।
আগের সাংবাদিক বলল, যারা ভার্স্কয রক্ষা কমিটি করেছে তাদেরকে মুরতাদ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন? আনা বলল, এসব মৌলবাদীরা যা খুশি বলুক, ওদের পাত্তা দিচ্ছে কে?
চলবে