রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ১৪

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জুন ০২, ২০১৯

১৫.
আজ বৃহ্স্পতিবার। আনারা টিএসসি থেকে মিছিল বের করবে। একই সময়ে বায়তুল মোকারমের উত্তর গেট থেকে মৌলবাদীদের মিছিল বের হবে। মৌলবাদীরা মিছিলের ঘোষণা আগেভাগেই দিয়েছে। এমনকি এই জরুরি অবস্থার মধ্যে ওদের মাইকিং সমানে চলেছে। আনাদের মিছিলের স্থান ও সময়টা গোপন রাখা হয়েছে।

কাল রাতে রূপনির ঘুম আসেনি। জকির সাথে থাকা সময়গুলো যেন জেট বিমানের গতিতে উড়ে চলে। সময়গুলোকে মুঠোর মধ্যে আটকে রাখা যায় না। সারাদিন, সারাক্ষণ জকিকে কাছে পাওয়া গেলে বেশ হতো। কিন্তু জকি নিজের কাজকে বড্ড বেশি ভালবাসে। এ কারণেই হয়তো জকিকে রূপনির এত বেশি ভালো লাগে। ঈশান একেবারে বিপরীত। ছেলেটা বেশ ভালো। নিজের কথা একটুও ভাবে না। ওরও ওর কাজের পক্ষে প্রখর যুক্তি। ওদের কাজগুলোও বেশ মজার। রূপনি বিদেশি চ্যানেলগুলোতে ডেমনসট্রেট দেখেছে। পুলিশের সাথে ধ্বস্তাধস্তি করছে একদল তরুণ-তরুণী। রূপনির মনে হচ্ছে রাজপথে এই ধরনের ডেমনসট্রেট করাই ওদের বয়সি তরুণ-তরুণীদের কাজই। রূপনির এখন বয়স হয়েছে। সব ধরনের কাজই রূপনি করতে চায়। আজকের মিছিলে রূপনি যেতে চায়। রূপনি একাই না ওর অন্য বন্ধু নোভা,রুশনি, নিউটন, ইলা সবাই যাবে।

এখনই জকি ফোন করবে। জকিকে ছাড়া এখন রূপনির একদিনও কাটে না। তবে বেচারা খুব ব্যস্ত। রোজ রূপনিকে সময় দিতে পারে না। তবে ওয়েবক্যাম আর মোবাইল ফোনে রোজ কথা হয়। জকিকে মিছিলের কথা বলতে হবে। মিছিলে যাওয়ার মধ্যে রূপনি রোমাঞ্চ খুঁজে পাচ্ছে। ভাল হয় যদি জকিও ওর সাথে মিছিলে যায়। জকি পাশে না থাকলে সব কিছু ফিকে হয়ে যায় যেন! সকাল বেলা ঈশান একটা ভাঁজ করা ব্যানার নিয়ে টিএসসিতে চলে এসেছে। চারুকলা প্রথমবর্ষের একদল ছাত্ররাত জেগে ব্যানারটা এঁকেছে। ব্যানারের একপাশে আঁকা হয়েছে মৌলবাদী শকুন বাংলাদেশের মানচিত্র খাচ্ছে। অন্যপাশে লালনের ছবি। আজকের পত্রিকায় ওদের প্রেস কনফারেন্সের খবর বেশ গুরত্ব  দিয়ে ছেপেছে। প্রাধান্য পেয়েছে ভাস্কর্য শিল্পীর নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ। অন্যদিকে মৌলবাদী নেতারা জেহাদের আহ্বান করেছেন। পুরা ঘটনা ওদের জন্য উদ্দীপক বটে। তবে আশঙ্কার কথা হলো, শিল্পীর খোঁজ সত্যিই পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা শিল্পীকে ক্রস ফায়ারের নাটক সাজিয়ে নাই করে দিল কিনা কে জানে! এই শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। কয়েকটি পত্রিকা এ সব নিয়ে সাইড স্টোরি লিখেছে।

ঈশানকে বেশিক্ষণ বসতে হলো না, আনা ঠিক চলে এসেছে। ঈশান আনার পোষাকের দিকে তাকালো। আনা বাংলাদেশের পতাকার ডিজাইনের সালোয়ার কামিজ পরেছে। আজকের দিনের জন্য পারফেক্ট।
‘তুমি স্লিপার কেন পড়েছ! কেডস্ পড়ে আসতে।’ ঈশান বলল।
‘কেন এই পোষাকে আমাকে কি খুব খারাপ লাগছে?’ আনা বলল।
‘না, কিন্তু ধর মিছিলে গোলমাল হলো। তোমাকে তো দৌড়াতে হবে। স্লিপার পড়ে দৌড়াবে কিভাবে!’
‘এই ঈশান তুই আমাকে নাভার্স করার চেষ্টা একদম করবি না। কেউ যদি হামলা করে আমি দৌড়াতে পারবো না বলে দিচ্ছি। দৌড়ানোর চেয়ে মার খাওয়া অনেক ভাল।’
‘তাহলে তোমার মিছিলে থেকে কাজ নেই। নেত্রীদের মত মিছিলের আগে চাপাবাজি করে কেটে পরো। তোমাকে নিয়ে ফাপড়ে পড়তে চাই না।’
‘বেশি পাকামো করলে চড় খাবি।’ আনা ঈশানের দিকে তেড়ে গেল।
রুশনি আর নোভাও চলে এলো। আধা ঘণ্টা সমনের মধ্যে ওদের বাকি বন্ধুরা চলে এলো। রূপনিকে ঝক্ঝক্ লাল গাড়ি থেকে নামতে দেখে অবাক হলো সবাই। ঈশান অবশ্য অবাক হলো না। ঈশান আগেই জানতো রূপনি আজ মিছিলে আসবে। ইকবাল ভাই এসেছে সবার শেষে। ওদের সবচেয়ে প্রবীন সদস্য। ইকবাল ভাই জলপাই রংয়ের গেঞ্জি আর মাথায় সবুজ মাঙ্কি ক্যাপ লাগিয়ে এসেছেন। ঈশান হাসল, চে গুয়েভারার মত গেট-আপ নিতে চেয়েছেন বোধ হয়। ঈশান ধরেই নিল আজ ইকবাল ভাই আনার পাশে পাশে থাকতে চেষ্টা করবে। যাক, গোলমাল হলে ইকবাল ভাই অন্তত আনাকে বাঁচাতে পারবে।

ওদেরকে একটা ব্যানার হাতে জটলা করতে দেখে, পাশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেকেই চলে এলো। ব্যাপারটা বোঝতে চেষ্টা করলো। ইকবাল ভাই বক্তৃতার ভঙ্গিতে বিভিন্ন ধরনের কথা বলছেন। ইকবাল ভাইকে বক্তৃতার ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখে কেউ একজন পাশের চটপটির দোকান থেকে একটি চেয়ার টেনে নিয়ে এলো। ইকবাল ভাই চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিতে বক্তৃতা চালিয়ে গেলেন। ইকবাল ভাই যে এতভাল বক্তৃতা করেন আগে জানা ছিল না। ঈশানের মনে হলো ওরা আজ আশাতীত সাড়া পাচ্ছে। ওদের মিছিল আজ বেশ বড়ই হবে। ঈশান ঘড়ির দিকে তাকালো। ঘড়ির কাটা বারটা ঘর ছুঁই ছুঁই। ইকবাল ভাইকে ইশারা করতেই তিনি আনাকে কথা বলার অনুরোধ জানিয়ে চেয়ার থেকে নেমে গেলেন।

রূপনির কাছে এই পরিবেশটা সম্পূর্ণ নতুন। ওদের ক্যাম্পাসের পাবলিক ইউনিভারসিটির কোন তুলনাই চলে না। এখানে বিশাল রাস্তা সবুজের সারি মাথার ওপর ছড়ানো নীল আকাশ। এসবে তুলনা মেলা ভার। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতে কত মজা! এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশুনা ছাড়াও নানা-ধরনের বিষয় নিয়ে সারা বছর মেতে থাকে। পড়াশোনার বাইরেও আছে গ্রুপ থিয়েটার, আর্ট এক্সিবিশন, ফিল্ম ফেস্টিভেল আরও কত কি! ঈশানের সাথে আলাপের পর থেকে রূপনি এই বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করছে। পাবলিক ভার্সিটি পড়াশুনা করতে পারলে বেশ হতো। কিন্তু পাপা রাজি হবেন না। এখানে সেশন জট আর নানা ধরনের ঝামেলা লেগেই থাকে। এই এলাকাটাকে জকি বলে ডাউন-টাউন। যানজটের ভয়ে জকি এ এলাকায় আসতেই চায় না। কিছুহ্মন আগে জকি ফোন করেছে। রূপনি এখানে আছে শুনে অবাক হয়েছে। জকি যদি ঈশানদের দলের সাথে কাজ করত তবে রূপনির ভাল লাগত। রূপনিকে দেখে ঈশান এগিয়ে এলো। রূপনি ঈশানকে দেখতে থাকে। ছেলেটা রাতে ঘুমায়নি। ওর কাজে শেয়ার করতে পারলে রূপনির ভাল লাগবে।

‘দেখ আমি ঠিকই এসেছি। তোমার সাথে মিছিলেও যাব।’ রূপনি উচ্ছাসে বলল।‘এই দেখ কেডস্ পড়ে এসেছি, যদি দৌড়াতে হয়!’ ঈশান রূপনির পায়ের দিকে তাকালো। রূপনি নাইকির কেডস্ পড়ে আছে। রূপনি আসায় ঈশান খুশি হলো। রূপনি ওদের একজনই হয়ে গেছে যেন! শুধু রূপনি কেন-ওর অন্য বন্ধুরা নোভা, রুশনি, ইলা, নিউটনরা কেমন মুগ্ধ চোখে ওদের কার্যকলাপ দেখছে। মিছিল করার জন্য উসখুস করছে।

ওদের নিয়ে ঈশানের একটু টেনশন হলো। প্রাইভেট ভার্সিটির ওরা তো বটেই, মিছিল অভিজ্ঞতা ঈশানেরও নেই। পুলিশ হামলা চালালে কি ভাবে সামলাতে হবে কে জানে? সত্যি যদি এই মিছিলে কিছু হয় তবে রূপনিরা কি করবে! ঈশান ঠিক করল ওদেরকে গাইড করার জন্য কাউকে বলতে হবে। ইকবাল ভাই তাঁর জীবনে অনেক মিছিল মিটিং  করেছেন। তাদের যৌবনে অপরিহার্য্য ছিল মিছিল, মিটিং, কাদন্ েগ্যাস। সুতরাং আজকের মিছিলে গাইডের দ্বায়িত্ব নিশ্চিতভাবে ইকবালভাইয়ের।

‘ও সব নিয়ে তুই ভাবিস না। পুলিশকে কিভাবে সামলাতে হয় আমার জানা আছে।’ ইকবাল ভাই ঈশানকে বলল। ঠিক এ সময় পুলিশের একটা জীপ এসে বিপরীত দিকের রা¯তায় এসে পার্ক করে দাড়ালো। একজন পুলিশ অফিসার নেমে এসে ওদের কাছে এলো। লোকটি কিছু না বলে জটলার সামনে দাড়িয়ে আনার বক্তৃতা শুনল যেন, তারপর জীপে ওঠে চলে গেল। ইকবালভাই ঈশানের দিকে তাকিয়ে যেন ভারসা দিল। আনার বক্তৃতার পর মিছিলের প্রস্তুতি শুরু হলো। ঠিক তখনই রূপনির ফোন বেজে উঠল। জকি। রূপনি ফোনের সফট্ টাচ বাটন স্পর্শ করতেই জকির গলা ভেসে এলো। ওরা যেখানে জটলা পাকিয়ে মিছিলের আয়োজনে ব্যস্ত তার ঠিক বিপরীত রাস্তায় সাদা পাজেরো পার্ক করিয়ে গাড়ির সামনে জকি দাঁড়িয়ে আছে। জকিকে দেখে রূপনি প্রায় দৌড়ে রাস্তার এ পাড়ে চলে এলো। রূপনিকে দেখে জকি তেমন কিছু বলল না। শুধু শোফারদের ভঙ্গিতে গাড়ির দরজা খুলে রূপনিকে গাড়িতে বসার ইংগিত করল। রূপনি সুরসুর করে গাড়িতে উঠে বসল। বিপরীত দিক থেকে জকি এসে ড্রাইভিং সিটে বসল। জকি আস্তে করে একটা রাখলো রূপনির কাঁধে। তারপর নিজের মুখটা এনে রূপনির চুলে বুলাতে লাগল-যেন রূপনির চুলের ঘ্রান নিচ্ছে।

মুখে বলল,‘আই মিস ইউ, হানি।’ পরমূর্হুতে জকি গাড়িতে স্টার্ট দিল। হঠাৎ করে লাফিয়ে উঠল যেন গাড়িটা। রূপনি কিছু একটা বলার আগেই ইউটার্ন নিয়ে ফেলেছে গাড়িটা। রূপনি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল প্রস্তুতি রত মিছিলটা। জকিকে নিয়ে রূপনির এক জ্বালা। জকি সামনে এলেই রূপনি সব কিছু ভুলে যায়। মিছিলে যাওয়ার ভেতর গত তাগিদটা এখন আর নেই। রুপনি জকির সাথে আরও ঘন হয়ে বসল। ঈশান রূপনির সাদা গাড়িতে চড়ার ব্যাপারটা দেখল। পরমূর্হুতে ওর মনযোগ গেল মিছিলের দিকে। ইকবালভাই ওকে ইশারায় ডাকছে। ঈশান গিয়ে ব্যানারের এক মাথা ধরল। তখনই সাদা গাড়িটা ওদের পাশ কাটিয়ে প্রায় উড়ে চলে গেল। ঈশান বিরক্ত হলো। মিছিলটা চারুকলার কাছে আসতেই ওদের চোখে পড়ল পুলিশের গাড়ি। রাস্তার ধারে দাড়িয়ে থাকা একদল পুলিশ ওদের মিছিল কাছে আসা মাত্রই আড়াআড়ি ভাবে দাড়িয়ে একটা পুলিশ-দেয়াল তৈরী করে ফেলল। ওরা আর দশ কদমের বেশি যেতে পারবে না। ওরা না থেমে প্রায় পুলিশ দেয়ালের কয়েক ইঞ্চি দুরে গিয়ে থেমে গেল। আগে দেখা সেই পুলিশ অফিসার এসে কড়া ভাষায় মিছিল ভেঙ্গে দিয়ে এখান থেকে সরে পড়তে বলল। জরুরি অবস্থায় মিছিল করার নিয়ম নেই। পুলিশের এই হুমকিতে মূর্হু র্মূহূ শ্লোগানে মুখরিত মিছিলের উত্তেজনা। পেছন থেকে চাপ বাড়ছে। এই চাপে সামনে যারা ছিল তারা প্রায় ছিটকে পড়ল পুলিশ প্রাচীরের ওপর। পুলিশরা এক কদম পিছিয়ে গেল। তারপর লাঠি তুলে তেড়ে এলো। মূর্হুতের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল মিছিলটা। চোখ-কান বন্ধ করে যে যেদিকে পারল ছুটল। ওদের ছাত্রভঙ্গ করে পুলিশরা দাড়িয়ে গেল। ওদেরকে ধরা কিংবা পিটুনী দিতে পুলিশকে তেমন উৎসাহি মনে হলো না। ব্যাপারটা ওদের অনেককে সাহসী করে তুলল। বিশেষ করে ইকবাল ভাইকে। ইকবাল ভাই কিছুটা বেপরোয়া ভঙ্গিতে পুলিশের দিকে তেড়ে গেলেন। মধ্যবয়সি একটা লোককে তেড়ে আসতে দেখে পুলিশ একটু ভ্যাবাচেগা খেল। দুজন পুলিশ একটু সরে দাঁড়ালো। ইকবাল ভাই পুলিশের বেষ্টনিতে ঢুকে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাত-পা ছুড়তে লাগলেন, তিনি নিশ্চয়ই কিছু একটা বলছেন। কিন্তু এত দুর থেকে ঈশানরা কিছুই বুঝতে পারছে না। একজন পুলিশ ইকবালভাই মারার জন্য লাঠি তুলল। পাশে দাড়িয়ে থাকা আরেক পুলিশ ইকবালভাইকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। ভাগিস্য ধ্বাক্কা দিয়েছিলেন। নয়তো লাঠির বাড়িটা ইকবালভাইয়ের মাথায় লাগত। কিন্তু ধ্বাক্কার ফল হলো মারাত্বক। ইকবালভাই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। ঈশানরা ছত্রভঙ্গ অবস্থায় কি করবে ভাবছে। এ সময় পুলিশ অফিসার গাড়ি থেকে নেমে ইকবালভাইয়ের কাছে গেলেন-উপুর হয়ে ইকবালভাইকে দেখলেন, তারপর দুশত গজ দুরে থাকা ঈশানকে ইশারায় ডাকলেন। লোকটির ডাকার ভঙ্গিটা বন্ধুত্বপূর্ণ। ঈশান একছুটে ইকবালভাইয়ের কাছে পৌছে গেল। ইকবাল ভাইয়ের দুচোখ বন্ধ। দু পা বেঁকে আছে। অসহায় ভঙ্গিতে যেন ঘুমিয়ে আছেন। পুলিশ অফিসার ভদ্রলোক ইকবালভাইয়ের পালস্ টিপে টিপে দেখছেন। ঈশানকে দেখে বললেন,‘নার্ভাস্ ব্রেকডাউন। নেশা টেশা করে বোধ হয়। এসব লোককে লক আপে রাখলেও বিপদ। নেশাখোরদের নিয়ে কি মিছিল করা যায়?’

‘উনি কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা।’ ঈশান আস্তে করে বলল। ‘বলেন কি! তাহলে একে নিয়ে এখনই পিজিতে ভর্তি করান। স্টোকও হতে পারে।’ঈশানকে কথাগুলো বলে ভদ্রলোক দাড়িয়ে পড়লেন। ড্রাইভারকে গাড়িটা এগিয়ে আনতে বললেন। দুজন পুলিশ ধরাধরি করে ইকবাল ভাইকে গাড়িতে তুলে সিটের ওপর বসালেন। কোন কিছু না ভেবে ঈশান গাড়িতে চড়ে ইকবালভাইয়ের পাশে বসে তাকে ধরল। গাড়িটা দ্রুত বাঁক নিয়ে ছুটতে লাগল। এ সময় একটা আশঙ্কা মনে উকি দিল। ইকবালভাই আর ওকে থানায় নিয়ে যাচ্ছে না তো! ঈশান ইকবাল ভাইয়ের এপিসোডটা কাছ থেকে দেখলেও অন্যরা বেশ দুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এই মিছিলে যারা এসেছে সবাই আনাড়ি। মিছিল মিটিংএর অভিজ্ঞতা তেমন নেই। তবে ইকবাল ভাইকে পুলিশের গাড়িতে তুলতে দেখেছে। পরে ঈশানও গাড়িতে উঠেছে। অথাৎ পুলিশ এদের দুজনকে তুলে নিয়ে গেছে। ব্যাপরটা ওদের বিহ্মুদ্ধ করে তুলল। একজন একটা ইট তুলে পুলিশের দিকে ছুড়ে মারল। দেখাদেখি আরেকজন। পুলিশের প্রতিক্রিয়া হলো মারাত্বক। এমনিতেই এখানে মিছিলকারিদের চেয়ে পুলিশের সংখ্যা বেশি। তারপর মিছিলকারিরা ছত্রভঙ্গ। গোটা এলাকাই পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। সুতরাং পুলিশ বেপরোয়া। পুলিশের তাড়া খেয়ে ওরা দিকবিদিক ছূটতে লাগল। কেউ একজন পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটের টুকরা ছুড়ে মারল। পুলিশ যেন টিয়ার গ্যাস মারার জন্য তৈরী হয়ে ছিল। টিয়ার গ্যাসের শেল এসে পড়ল পাবলিক লাইব্রারীর ফটকে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল এলাকাটা। পুলিশের নাগালে এলো দু একজন পথচারি। তারা কিছু বুঝে উঠার আগেই পুলিশের বেধড়ক মার খেল।

পুলিশের তাড়া খেয়ে অনেক কস্টে আনা এসে পৌছল চারুকলার ক্যাম্পাসে। আনার পা খালি, দৌড়াতে গিয়ে স্যান্ডাল হারিয়েছে। এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। পুলিশ যে ওদের মিছিলে এভাবে বাধা দেবে আগে ভাবেনি। পুলিশ ওদের মিছিল আটকানোর জন্য আগে থেকেই তৈরী ছিল। তার মানে ওদের কার্য্যক্রম আগেভাগেই পুলিশ জানে। ব্যাপারটা এখন আর ছেলেখেলা নয়। আনা ওর ফতুয়ার পকেটে হাত দিল, স্বস্তি পেল। ওর মোবাইল সেটটা খোয়া যায়নি। অন্তত সবার সাথে যোগাযোগ করা যাবে। ইকবালভাই আর ঈশানকে হারিয়ে আনা সত্যি দিশেহারা! সন্ধ্যার সাথে সাথে ওরা একজন দুজন করে পিজি হাসপাতালের সিসি ইউ’র সামনে জড় হতে থাকে। এই হাসপাতালে আনার এক ডাক্তার বন্ধু আছে। সেই লোকই ওদেরকে নানা তথ্য দিচ্ছে। ইকবালভাইয়ের অব¯হা সত্যি শঙ্কাজনক। চব্বিশ ঘন্টার আগে কিছুই বলা যাবে না। পরে গিয়ে তিনি সামান্যই আঘাত পেয়েছেন। কিন্তু একই সময় হয়ত স্টোক করেছে। এ ছাড়া নানা ধরনের জটিল রোগে ভুগছেন। জীবন ফিরে পেলেও তাকে দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা সেবা নিতে হবে। দীর্ঘ দিনের অনিয়মের খেসারত ইকবালভাইকে দিতে হবে। ইকবাল ভাই আকাশ পথ নয়তো পানি পথে থাকতে ভালবাসতেন। এখন তিনি কোন পথে আছেন কে জানে! ঈশানের মনটা খারাপ হয়ে গেল। আনা যখন পিঠে হাত রাখল তখন ঈশান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ওর শরীরটা কেঁপে উঠল। দুচোখ জ্বালা করতে লাগল। ইকবাল ভাই কারও কাছে তেমন কিছু চায়নি। শুধু নিজের মত করে থাকতে চেয়েছিলেন। এ জন্যই খেসারত দিতে দিতে জীবন পার করেছেন। এই পৃথিবীতে নিজের মত থাকাই সবচেয়ে কঠিন।

হাসপাতালে ওরা আর বেশিক্ষণ থাকতে পারল না। ঐ ডাক্তার ভদ্রলোকই ওদেরকে হাসপাতাল থেকে চলে আসতে বললেন। আজকের মিছিলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধর পাকড়াও হতে পারে। এ ছাড়া কালকের কর্মসূচির ঠিক করতে হবে। ওরা সবাই আনার বাসার দিকে ছুটল। চলবে