রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ১৫

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জুন ০৩, ২০১৯

১৬.
আজ রূপনির ঘুমটা আগেভাগেই ভেঙেছে। কালরাতে রূপনি ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। টিএসসি থেকে ওভাবে চলে আসাটা ঠিক হয়নি। ঈশানরা নিশ্চয়ই মাইন্ড করবে। চলে আসার সময় ভদ্রতা দেখিয়ে ওদের কাছ থেকে বিদায়ও নেয়া হয়নি। আসলে জকি সামনে এলে রূপনির সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। রূপনি ভেবেছিল, জকিও ওদের সাথে মিছিলে যাবে। রূপনি জকিকে এ জন্য অনুরোধও করেছিল। কিন্তু রূপনি গাড়িতে বসতেই জকি যে ঝড়ো গতিতে উড়তে চাইবে যেটা রূপনি বুঝতে পারেনি। জকি রূপনিকে নিয়ে প্রায় উড়তে উড়তেই গুলশানের একটা রেস্টহাউসে চলে এসেছিল। জকির সব কিছুই প্রি-প্লানন্ড, নিঁখুত। আগেই ওখানে একটা প্রাইভেট রুম বুক করা ছিল। ক্যান্ডেল নাইট ডিনার শেষে, ব্লাক লেভেলের সিপ নিয়ে রূপনির গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে জকি ওর নিজের স্বপ্নের কথা বলেছিল। দুবাইতে হবে জকির ফাইভ স্টার হোটেল। চেইন হোটেলের শুরুটা। একে একে হোটেল হবে প্যারিসে, লস এঞ্জেলসে, লন্ডনে, বেইজিংয়ে, কোথায় নয়! দুদিন এখানে দুদিন ওখানে করে জীবন চলতে থাকবে ঝড়ো গতিতে। জকি আরও কত কি বলছিল... ওদের দুজনের দেহে কত কি ঘটে গেছে... এখন আর রূপনির সব মনে নেই। সম্ভবত রাত আড়াইটার দিকে জকি রূপনিকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল। সব সময় যা হয়, বেশি রাত হলে মা বেডরুমে দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। বুয়ারা যে কোনো একজন রূপনির অপেক্ষা করে। গতরাতেও তাই হয়েছে। মা ঘুমিয়ে পড়েছে। রূপনি দেখেছে মা খুব ঘুম কাতরে। মা বেশি রাত জাগতে পারে না। অন্যদিকে খুব ভোরে মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। নাইট লাইফ বলতে মায়ের ডিকশনারীতে কিছু নেই। মা জেগে না থাকায় রূপনি স্বস্তি পেয়েছিল। এতটা বেশামাল অবস্থায় মায়ের মুখোমুখি হতে চায়নি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে রূপনি ভেবেছিল খুব সহজেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাবে। কিন্ত হয়নি আধো ঘুম আধো জাগরণে সময়টা শুধু পার হয়েছে। রূপনি ঠিক করল এখন আর ঘুমাবে না। তারচেয়ে সকালের ঢাকা দেখা যাক। রূপনি ঘরের পর্দা সরিয়ে দিল। ভোরের আলো এখনো ভালোভাবে ফুটে উঠেনি। আধো আলোয় শহরটা এখনো ঢাকা। রূপনি জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো। ওদের বাড়ির প্রাচীর লাগোয়া রাস্তায় তাকিয়ে রুপনি অবাক হলো। ঠিক প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দুটি গাড়ি। একটি সম্ভবত পুলিশের অন্য নিঃসন্দেহে র‌্যাবের। কালোর ওপর হলুদ র‌্যাব লেখাটা এই আঁধারিতেও পড়তে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। গাড়ি দুটোর পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ আর র‌্যাবের লোকেরা। এরা যেন কিছু একটা অপেক্ষা করছে।

লোকগুলো তাকিয়ে আছে ওদের বাড়ির দিকে। এরা এখানে কি চায় কে জানে? সাত-সকালে পুলিশ দেখে রূপনির মুড অফ হয়ে গেল। রূপনি আর জানলায় দাঁড়ালো না। ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল। ওয়াশরুম থেকেই রূপনি শুনতে পেল বাইরে থেকে কে যেন ওর রুমে নক করছে। নিশ্চয়ই মা। রূপনি ওর স্বচ্ছ নাইটির ওপর হাউস কোন জড়িয়ে নিল। দরজা খুলতেই রূপনির মুখটা বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। বিধ্বস্ত চেহারায় মা দাঁড়িয়ে আছে। মাকে স্কটের মতো করে দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে দুজন মহিলা র‌্যাব। পেছনে দুতিনজন পুলিশ আর র‌্যাব। রূপনি মায়ের চোখের দিকে চেয়ে চেষ্টা করল ঘটনা জানতে। মা এক কদম এগিয়ে এসে বললেন, ‘এরা তোমার রুমটা চেক করবে।’ এ কথা বলে মা রূপনির খাটে বসে পড়লেন। তারপর উদ্গত কান্না সামলাতে না পেড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ‘ফর হোয়াট?’ রূপনির গলাটা চিৎকারের মতো শোনাল। এ ধরনের অবস্থায় রূপনি জীবনে কখনো পড়েনি। কি করা উচিত ও জানে না। মাকে ঠাণ্ডা করবে নাকি এই লোকগুলোর সাথে কথা বলবে, দিশা পেল না। র‌্যাব ও পুলিশের লোকেরা রূপনির প্রশ্নে উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করল না। রূপনির সারা রুমে ছড়িয়ে পড়ল। রূপনির পাড়ার টেবিলে রাখা বইপত্র, ওয়ার্ডরবের কাপড়-চোপড় সব ঘাটাঘাটি করতে লাগল। রূপনি আর থাকতে পারল না।

মা এ সব কি হচ্ছে? বলে চিৎকার করে রূপনি মাকে জড়িয়ে ধরল।
আমাদের বড় বিপদ মা। তোর বাবা... এ পর্যন্ত বলে মা আর কথা বলতে পারল না। ডুকরে কেঁদে উঠল।
আমার পাপা! পাপার কি হয়েছে? রূপনির গলায় বিস্ময় ঝরে পড়ল। রূপনি এতক্ষণ ভেবেছিল ঈশানদের সাথে মিছিলে থাকার জন্য পুলিশ এসেছে। এর মধ্যে পাপার ইনভলভমেন্ট এলো কি ভাবে? ‘পাপার কি হয়েছে মা, বলো? চুপ করে থেকো না।’ রূপনি মাকে ধরে ঝাঁকাতে থাকে। ‘তোর বাবাকে পুলিশ ধরেছে। আমাদেরও থানায় নিয়ে যাবে বলল।’ ফোপাতে ফোপাতে মা বললেন।

‘কেন, আমার পাপা কি করেছে?’ রূপনি মাকে ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে পুলিশদের দিকে তাকিয়ে ফুঁসে উঠল। রূপনির ফুঁসে ওঠা দেখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা পুলিশটা যেন মজা পেল। ‘তোমার বাবা এমন কিছু নেই যা করেনি।’ তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই যে শুনেছেন আপনার মেয়েকে ঠাণ্ডা হয়ে বসতে বলুন। নয়তো ওকেও থানায় যেতে হবে।’

মাকে রূপনির আর কিছু বলতে হলো না। রূপনি এই হুমকি শুনে একেবারে ঠাণ্ডায় জমে গেল যেন! ও থপ করে খাটে বসে পড়ল। তারপর শীতের সকালে ওর ঠাণ্ডা রুমে বসেও রূপনি কুলকুল করে ঘামতে লাগল। রূপনি প্রাণপণ চেষ্টা করছে যেন জ্ঞান হারিয়ে না ফেলে। পুলিশগুলোকে শত্রু মনে হচ্ছে। ওদের সামনে রূপনি দুর্বল হতে চায় না। পুলিশগুলো ধীরেসুস্থে তল্লাশি চালিয়ে গেল। ওরা তেমন কিছু পেল না। তল্লাশি শেষ করে একজন মহিলা পুলিশ মাকে অর্ডারের সুরে বলল, ‘এই যে শুনছেন, আপনি আমাদের সাথে আসুন।’

রূপনির মাথায় হাত বুলিয়ে মা উঠে দাঁড়ালেন। রূপনিও মায়ের পেছন পেছন যেতে লাগল। শুধু রূপনির রুমই নয় প্রতিটি রুমেই যেন ঝড় বয়ে গেছে। সাজানো-গুছানো রুমগুলো সব এলোমেলো হয়ে আছে। পুলিশ তা হলে রূপনির ঘুম ভাঙ্গার আগেই এসেছে। কাজের লোক আর বুয়ারা ড্রইং রুমে পুলিশের সামনে সার বেধে দাড়নো। নিশ্চয়ই ওদের কাছ থেকে পুলিশ নানা কথা জানতে চেয়েছে। এই তুমি আপাতত বাড়িতে থাক। আমরা তোমার মাকে থানায় নিয়ে যাচ্ছি। ভয় নেই মেয়ে কিছু তথ্য জেনে তোমার মাকে বাড়িতে পৌছে দেব।’ একজন পুলিশ কর্মকর্তা রূপনিকে বলল।

আমিও মায়ের সাথে যাব। পুলিশের কথা শুয়ে রূপনি এক কদম এগিয়ে বলল।
‘দেখ মেয়ে তোমাকে যা বলছি তা কর, আমাদের কাজে একদম বাধা দেবে না বলছি।’ পুলিশ অফিসার প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন। তারপরও রূপনি মাকে জড়িয়ে ধরে গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত এলো। দুই মহিলা পুলিশ এসে রূপনিকে সরিয়ে নিয়ে মাকে গাড়ি তুলল। রূপনি শুনতে পেল বুয়াদের ফোপানি। বুয়ারা কাঁদছে। রূপনির ফের কান্না চলে এলো। কিন্তু কোত্থেকে একশক্তি এলো ওর ভেতর। ঠিক করল আর কাঁদবে না। লড়াই করবে। স্থিরভাবেই রূপনি মাকে নিয়ে পুলিশের গাড়ির চলে যাওয়া দেখল। তারপর ধীরস্থির ভাবে ড্রইং রুমে এসে বসল। পুরো ঘটনা ও আবার ভাবতে চেষ্টা করল। পাপাকে নিয়ে নিশ্চয়ই কোন ঝামেলা হয়েছে। সেই ঝামেলাটা কি? পাপার অফিসের লোকজনের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। এছাড়া জকির সাথে যোগাযোগ করতে হবে। জকি পাশে থাকলে অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে। মাকে সাহস দেয়ার জন্য থানায় কারও না কারও যাওয়া উচিত। রূপনি কান্নারত এক বুয়াকে ধমক দিয়ে শান্ত করে ওপর থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে আসতে বলল।

আরেক বুয়া কান্না থামিয়ে দরজার বাইরে থেকে আজকের দৈনিক পত্রিকা দুটি তুলে এনে সেন্টার টেবিলে রাখল। এ বাড়িতে দুটি পত্রিকা রাখা হয়। একটি ইংরেজি অন্যটা বাংলা। রূপনির চোখ গেল সেন্টার টেবিলে রাখা বড় বড় হরফে ছাপা শিরোনামের দিকে। রূপনি ছো মেরে ইংরেজি পত্রিকাটা তুলে নিল। তারপর দেখল বাংলা পত্রিকা। দুটো পত্রিকায়ই শিরেনামের পর পাপার ছবি ছাপা হয়েছে। পাপার নাম মহব্বত আলি এটাই রুপনি জানে। কিন্তু পত্রিকায় লিখেছে পাপার আরো নাম আছে। ‘লাল-শুয়ার’ ওরফে মিয়াভাই। খুনসহ আঠারো মামলার আসামি। পত্রিকা পড়তে পড়তে রূপনি কাঁপতে লাগল। পত্রিকার হরফগুলো ঝাপসা দেখাচ্ছে। রূপনি সোফার ওপর লুটিয়ে পড়ল। চলবে