
রূপনির রূপকথা
উপন্যাস ১৬
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জুন ০৪, ২০১৯
১৭.
আজ শুক্রবার। বাদ জুম্বা লালনের ভাস্কর্য ভাঙা হবে। কাল অনেক রাতে ঈশান বাড়ি এলেও আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে। কালকে ওদের মিছিলকে সফলই বলা যায়। অন্তত ওদের প্রতিবাদ আলোচনায় এসেছে। কিন্তু ইকবাল ভাইয়ের জন্য ওরা অস্বস্তিতে আছে। প্রায় জীবন্মৃত অবস্থায় হাসপাতালে শুয়ে আছেন তিনি। হয়ত আজ রাতে খারাপ ভালো বোঝা যাবে। সকাল দশটার মধ্যে ঈশানকে টিএসসি তে যেতে হবে। ওখান থেকে আজ আবার মিছিল বের হবে। ওরা চেষ্টা করবে এয়ারপোর্ট রোড পযর্ন্ত মিছিল নিয়ে যেতে। রুমের বাইরের বারান্দা থেকে ঈশান আজকের পত্রিকা তুলে নিল। পত্রিকার ফাস্ট লিড ‘লাল-শুয়ার’ নামের এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর গ্রেফতার হওয়ার কাহিনি। সেকেন্ড লীড ভাস্কর্য ভাঙা নিয়ে নানা ধরনের স্টোরি, সেই সাথে শাহবাগ মোড়ে টিয়ার গ্যাস ছুড়ে ওদের মিছিল ছত্রভঙ্গ করার ছবি। যাক, ওদের চেষ্টা বৃথা যায়নি!
শাহবাগ যেতে যেতে রূপনির কথা মনে পড়ল ঈশানের। কাল এসেও আবার মেয়েটা চলে গেল। এ ধরনের মেয়েদের কাছ থেকে এর বেশি আর কী আশা করা যেতে পারে? তারপরও আজকের কর্মসূচির কথা রূপনিকে জানাতে হবে। রূপনিকে ফোন করলো। এঙ্গেজ টোন, সম্ভবত ফোন বন্ধ। টিএসসির সামনে পুলিশ ও র্যাবের ছড়াছড়ি। রাস্তায় কাউকে দাঁড়াতে তো দিচ্ছেই না, হাঁটতেও দিচ্ছে না। পথচারীদের ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে বাধ্য করছে পুলিশ। এ সব দেখতে ঈশান টিএসসির ভেতরে ঢুকে যায়। সুইমিং পুলের সামনে বসে ওকে আর বেশিক্ষণ বসতে হলো। আনা, নোভা, রুশনি একে একে সবাই এসে হাজির হলো। এক ফাকে ওদেরকে রূপনির কথা জিজ্ঞাস করলো। রূপনির সাথে ওদের আর যোগাযোগ হয়নি। সবাই একমত এখন মিছিল নিয়ে টিএসসি থেকে বেরুনো সম্ভব নয়। পুলিশ যেভাবে গিজগিজ করছে মিছিল নিয়ে বের হলেই ওদের ওপর নিশ্চিত হামলা হবে। বিশ-ত্রিশ জনের মিছিলভঙ্গ করতে পুলিশ এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করবে না। এছাড়া মৌলবাদীদেরও পুলিশ নিশ্চয়ই বাধা দেবে। সুতরাং লালন ভাস্কর্য বেঁচেও যেতে পারে। সুতরাং ঝুঁকি না নিয়ে অপেক্ষা করা ভালো। তারচেয়ে ভালো হয় ওরা যদি রবীন্দ্র সরোবরে আজ সারাদিন প্রতিবাদ সমাবেশ আর গানের আয়োজন করে। আনার এই প্রস্তাবে ওরা সবাই চাঙা হয়ে ওঠে। পুলিশের চোখ এড়াতে বিচ্ছিন্নভাবে, বিভিন্ন পথে সবাই ছুটল ধানমন্ডির পথে।
রবীন্দ্র সরোবরে যুদ্ধকালীন উদ্যমে ওর মঞ্চ সাজিয়ে ফেলল। দুঘণ্টার মধ্যেই ওদের সাউন্ড সিস্টেমসহ সব ব্যবস্থা ঠিক হয়ে গেল। দুপুর দুটো থেকে ওদের মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে। এ সবের পাশাপাশি ওরা ফোনে যোগাযোগ করতে লাগল ওদের অন্য বন্ধুদের সাথে। রবীন্দ্র সরোবর এলাকায় এমনিতে প্রচুর মানুষ সময় কাটাতে যায়। সুতরাং ওর যখন গান শুরু করলো তখন দর্শকের খুব অভাব হলো না। আড়াইটার দিকে ওদের এক বন্ধু, উত্তরা এক কলেজ ছাত্র ফোন করে জানাল এই মাত্র মাদ্রাসার ছাত্ররা লালানের ভাস্কর্য গুড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশের চোখের সামনেই এই ব্যাপারটা ঘটেছে। ঐ কলেজের ছাত্ররা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে ক্লাশ বর্জন করেছে। সংহতি প্রকাশের জন্য ওরা রবীন্দ্র সরোবরে আসছে। কান্না জড়িত কণ্ঠে আনা মাইক্রোফোনের সামনে দাড়িয়ে এই ঘোষণা দিল। এ সময় দল বেঁধে চারুকলার একদল ছেলেমেয়ে সমাবেশে চলে এলো। মৌলবাদ বিরোধী শ্লোগানমুখর হলো এলাকাটা।
এতক্ষণে নিজের কথা ভাবার সময় পেল ঈশান। আজ সকাল থেকেই কেন যেন রূপনির কথা মনে পড়ছে। ওর সাথে যোগাযোগ হলে রূপনিকে এখানে আসতে বলবে। কললিস্ট থেকে রুপনির নম্বরে আবার ফোন করে ঈশান। পাওয়া গেল না। রূপনির মোবাইল ফোন এখনো বন্ধ। ম্যাসেজ পাঠানো ধৈর্য এখন নেই। রূপনিকে আজ বোধ হয় আর পাওয়া যাবে না। দেখতে দেখতে রবীদ্র সরোবর চত্বরটা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠল। আসলে এতদিন লালনপ্রেমী, যারা প্রগতি নিয়ে ভাবে, তাদের অনেকের মধ্যে মৌলবাদীদের সামর্থ নিয়ে দ্বিধা ছিল। সরকারের ওপরও আস্থা ছিল, নিশ্চয়ই প্রশাসন এই ব্যাপারটা হতে দেবে না। কিন্তু কোনো ধরনের প্রতিরোধ তো দূরের কথা, অনেকটা আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই লালনের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভুলুণ্ঠিত হয়েছে। এ নিয়ে কোনো বড় ধরনের প্রতিবাদ না ওঠায় এ ধরনের মানুষ দুঃখ পেয়েছে। ঈশানদের প্রতিবাদ সমাবেশের কথা এক কান দুকান হতে হতে সারা ঢাকা শহরেই ছড়িয়ে পড়েছে। চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা এগিয়ে থাকলেও বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে দল বেঁধে ছাত্রছাত্রীরা আসছে। ওদের প্রতিনিধিরা সংহতি জানিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। আসলে লালনের কোনো জাত নেই তেমনি কোনো শ্রেণিও নেই। লালন সব শ্রেণির র, সব মানুষের। এখন আর পূর্ব পরিকল্পনা নয়, আজকের অনুষ্ঠনের চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে। এই প্রতিবাদে অংশ নিতে পেরে সবাই যেন তৃপ্ত। এমন কি শান্তি রক্ষার জন্য বিভিন্ন বাহিনীর লোকজনরা হিংসা ভুলে মনযোগ দিয়ে অনুষ্ঠান দেখছে। অবশেষে আনা ইকবাল ভাইয়ের লেখা গান ধরল, ওদের থিম সঙ।
ধর্ম ব্যবসায়ী, তুমি দোজগ বেহশতের আজব কারবারি
তোমার জন্য গোশত পোলাও আমার পেট খালি..
ইকবাল ভাই আনার মধ্যে তার স্বপ্নের যোয়ান বায়েজকে দেখতে চেয়েছিলেন। এই গান গাওয়ার সময় কেমন পরিবেশ দরকার, আনার পোষাক-আষাক কেমন হওয়া উচিত এ সব খুটিনাটিও ইকবাল ভাই ভেবে রেখেছিলেন। নিয়তির অদ্ভুত এক হিসাবে ইকবাল ভাই আজ এখানে নেই। অবস্থা খারাপ হওয়ায় সিসিইউ থেকে তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়েছে। ইকবাল ভাইয়ের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা এখন কয়েক শতাংশ কমে গেছে। চলবে