
রূপনির রূপকথা
উপন্যাস ১৭
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জুন ০৭, ২০১৯
১৮.
চেতন-অচেতনের মাঝামাঝি একটা অবস্থায় কতটা সময় কেটেছে, রূপনি জানে না। মায়ের হাতের ছোঁয়া পেয়ে রূপনি চোখ খুলল। মায়ের দিকে তাকাল। এই দু’তিন ঘণ্টা সময়ে মায়ের ওপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে। মা যেন এই সামান্য সময়ে অনেক বুড়িয়ে গিয়েছেন। মায়ের বয়স বেড়ে গেছে। রূপনি মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, বলো মা এসব মিথ্যা। তারপর প্রবল বেগে ওর মাকে ঝাঁকাতে লাগল। রূপনির মা মেয়ে কিছুই বলতে পারলেন না। মেয়েকে ধরে কাঁদতে লাগলেন। তারপর অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললেন, মা, তুই শক্ত হ। তোকে বাঁচতে হবে মা।
রূপনি বলল, তাহলে বলো মা, এসব কি!
আমাদের সামনে আরও বিপদ। তুই শক্ত না হলে তো আমি বাঁচবো না, মা।
এমন সময় ড্রইং রুমের এক কোণায় রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠে। কাজের বুয়া টেরিফোন তুলে নেয়। ও প্রান্তের কথা শুনে রিসিভারটা এগিয়ে এনে মাকে দেয়। ‘খালাম্মা, আপনার ফোন।’ রূপনির মা রূপনিকে ছেড়ে দিয়ে রিসিভার হাতে নেয়। ও প্রান্ত থেকে কেউ একজন বলছেন, ‘আমি পত্রিকা অফিস থেকে বলছি, মিসেস মহব্বতের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি।’
বলছি, বলুন।
আপনি তো মহব্বত তথা ‘লাল শুয়ারের’ দ্বিতীয় স্ত্রী। আপনার প্রথম স্বামীকে লাল শুয়ার খুন করেছে।
রূপনির মায়ের হাত থেকে রিসিভারটা পড়ে গেল। রূপনির দিকে তাকিয়ে তিনি সোফায় বসে পড়লেন। ভাবলেশহীনভাবে তিনি চারদিকে তাকালেন, যেন ভূত দেখছেন।
রুপা বেগম যেন বিশ বছর আগের মফঃস্বল শহরটায় ফিরে গেলেন। ছোট শহরটায় নিস্তরঙ্গ জীবনটা ভালই চলছিল। উপচে পড়া সম্পদ না থাকলেও ওদের পরিবারে অভাব ছিল না। টনটনে ছিল আত্মসম্মান জ্ঞান। দুটি বেনি দুলিয়ে রূপা নামের মেয়েটা স্কুলে যেত। রূপাকে দেখার জন্য ছেলেরা পথেঘাটে দাঁড়িয়ে থাকত শিস্ বাজাতো, নানা মন্তব্য করতো। ও সব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় রূপার ছিল না। ছেলেদের উৎপাতও সহনীয় পর্যায়ে ছিল। এ সময় উদয় হলো এক সন্ত্রাসী, লালশুয়ার। লালশুয়ার আর ওর দলবলের অত্যাচারের কাহিনি বড়দের গালগল্পে মাঝে মাঝে শোনা যেত। এই সব নিয়েও রূপার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। রূপা নিজের মতোই ছিল। তারপর একদিন লাল শুয়ার ওর স্কুলে যাওয়ার পথে পথরোধ করে দাঁড়াল। সাথে সাঙ্গপাঙ্গ। অদ্ভুত আবদার, লাল শুয়ারের সাথে প্রেম করতে হবে। লাল শুয়ারকে বিয়ে করতে হবে। একরাশ আতংক নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়েছিল। পাছে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় এই ভয়ে বাড়ির কাউকে কিছু বলা হয়নি। ফলে পথেঘাটে লাল-শুয়ারের বিরক্ত করাটা যেন রুটিন হয়ে উঠল। লাল-শুয়ার সামনে এলো লোকজনও ভয়ে দুরে সরে যেত। তারপর অবস্থা অসহনীয় হয়ে উঠলে বাবা-মাকে জানানো হলো। কিছু আত্ময়-স্বজন লাল-শুয়ারকে নিষেধ করতে যেয়ে বেধড়ক মার খেল। মফঃস্বল শহরে যা হয়, রূপা বেগম আর লাল-শুয়ারের কাহিনি নানা ডালপালা গজিয়ে শহরের বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল। স্কুল বন্ধ হয়ে প্রায় গৃহবন্দি হলো রূপা বিবি। আর লাল শুয়ার আড্ডা দেয়ার জন্য বাড়ির সামনের রাস্তাটা বেছে নিল। রূপা বেগম তো বটেই বাড়ির লোকদের শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার অবস্থা। বাবা পূর্ব পরিচয়ের সুত্র ধরে স্থানীয় এমপির কাছে নালিশ জানাতে গেলেন। অবাক হয়ে দেখলেন, এমপির ঠিক পাশের চেয়ারে বসে লাল শুয়ার পা দোলাচ্ছে। শুধু দেখা করার উদ্দেশ্যে আসা, এ কথা বলে বাবা ওখান থেকে চলে আসেন। ধূর্ত লাল শুয়ার যা বোঝার বুঝে নেয়। এবার সরাসরি বাড়ি এসে লাল শুয়ার শাসিয়ে গেল। সাতদিনের মধ্যে রূপা বিবিকে সে বিয়ে করবে। ওর ক্যাডাররা রাতদিন পালা করে বাড়ি পাহারা দিতে থাকে। যেন রূপা বেগমকে বাবা-মা কোথাও সরিয়ে না দেয়। বাসার সবার যখন হার্ট এ্যটাকের যোগাড় তখন ঠিক তিনদিনের মধ্যে বাড়ির সামনে থেকে লাল শুয়ারের ক্যাডাররা হাওয়া। লাল-শুয়ারকে কোথাও দেখা গেল না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল নতুন এক এসপি শহরে এসে অপরাধীদের ধরতে বিশেষ তৎপরতা চালাচ্ছে। এই এসপি শহরের একনম্বর ক্রিমিনাল লাল শুয়ারকে ধরতে বদ্ধ পরিকর। রূপা বেগমের পরিবার স্বস্তি পেল। আল্লাহ যেন নিজ হাতে ওদের সম্মান বাঁচিয়েছে।
দু একদিনের মধ্যে এক প্রবাসী পাত্রের সাথে রূপা বেগমের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। বিয়ের পর রূপা বেগমকে নিয়ে পাত্র তার কর্মস্থল দুবাই চলে যাবে। এর চেয়ে ভাল পাত্র আর হয় না। শঙ্কা থাকলেও বিয়েটা নির্বিঘ্ন হয়ে গেল। ঠিক সাতদিনের মাথায় হাতের মেহেদির রঙ মুছে যাওয়ার আগেই রূপা বেগমকে বিধবা হতে হলো। রেললাইনের ধারে রূপা বেগমের স্বামী রিয়াজুল হকের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেল। কড়া এসপি যিনি এসেছিলেন, তিনি কারও অদৃশ্য ইশারায় শহরটাকে অরক্ষিত রেখে বদলি হয়ে গেলেন। এবার সবার কাছে রূপা বেগমের নিগৃহীত হওয়ার পালা। রূপা বেগমের জন্যই স্বামীটা মারা গেছে, অপয়া না হলে বিয়ের সাতদিনের মাথায় কেউ বিধবা হয়! সেই সময় কেন আত্মহত্যা করেনি, সেই প্রশ্নের উত্তরটা এখনো রূপা বেগম খুঁজতে চেষ্টা করে। সেই সময় কেন বেঁচে থাকল সেটা আজও তার কাছে বিস্ময়।
প্রাথমিক শোক কাটিয়ে উঠার পর রূপা বেগমের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাবা মা যখন সিধান্তহীনতায় তখনই লাল শুয়ারের আর্বিভাব। এবার ভদ্রবেশে। অতীত কৃতকর্মেও জন্য প্রায় আনুষ্ঠানিকভাবে বাবা-মায়ের কাছে ক্ষমা চাইল। ওদের দুয়েক জন আত্মীয়-স্বজনকে টাকা দিয়ে হাত করে ফেলল। দিন দিন কিভাবে যেন লাল-শুয়ার ওদের পরিবারের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল। লাল-শুয়ারের সাথে বিয়ের প্রস্তাবে রূপা বেগম প্রবলভাবে আপত্তি জানিয়েছে। কিন্তু সবার প্রবলচাপে তার প্রতিবাদ দিন দিন দুর্বল হয়েছে। বিধবাকে কে বিয়ে করবে? বয়সের দোষে লাল-শুয়ার অনেক কিছু করেছে। ভবিষ্যতে আর না করলেই হলো। রূপার রুপ আছে দেখেই তো লাল-শুয়ার অমন আচরণ করেছে। ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে অথবা নিজেকে বিসর্জন দেয়ার জন্যই রূপা বেগম লাল-শুয়ারকে বিয়ে করতে সম্মত হলো। অনেক ধূমধাম করে বিয়েটা হলো। খরচের বাহানাক্কা দেখিয়ে লাল-শুয়ার মফঃস্বল শহরের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল।
বিয়ের পর ঢাকায় এসে বিলাসবহুল জীবনে রূপা বেগম প্রবেশ করলো। বিয়ের কয়েক মাস পর, রূপনি যখন পেটে, তখন একরাতে রূপা বেগমকে কতটা ভালবাসে সেটা বোঝাতে মাতাল অবস্তায় লালশুয়ার জানায় যে, সে নিজেই গুলি করে রূপা বেগমের প্রথম স্বামী রিয়াজুলকে মেরেছে। রিয়াজুলকে খুন না করলে যে সে রূপা বেগমকে পেত না। মেয়েটা পেটে থাকায় রূপা বেগম সেই রাতে আত্মহত্যা করেনি। সেইদিনের পর থেকে লাল শুয়ারের আচরণও কেমন পাল্টে গেল। রূপা বেগমকে তোয়াজ করে চলতে লাগল। ঠিক অনুগত ভৃত্যের মতো, ভয়ে অথবা অনুশোচনায়। অনাগত সন্তানের কথা ভেবে রূপা বেগমও পুরানো প্রসঙ্গ না তুলে বর্তমান নিয়ে থাকার সিন্ধান্ত নিল। রূপা বেগমের মুখে একটু হাসি দেখার জন্য লাল-শুয়ার কাঙালের মতো তাকিয়ে থাকত। মেয়ে হওয়ার পর মেয়েকে লালন-পালন করতে গিয়ে রূপা বেগমকে অনেক কিছু ভুলে থাকতে হলো। একজন খুনির সাথে বসবাস করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত অর্ন্তদহনে জ্বলতে হয়েছে। আত্মীয়স্বজন, এমনকি মেয়ের সাথে সারাক্ষণ অভিনয় করতে হয়েছে, সংসারের উপচে পড়া সুখ সবাইকে দেখাতে হয়েছে। প্রতিনিয়ত প্রতিশোধ নেয়ার কথা ভাবতে ভাবতে প্রায় বিশটা বছর কোত্থেকে পার হয়ে গেল! প্রতিশোধ নেয়ার স্পৃহাও এখন ফিকে হয়ে গিয়েছে।
অতীত থেকে ফিরে, রূপা বেগম রূপনির দিকে তাকালেন। প্রাকৃতিক নিয়মে লাল-শুয়ার ধরা খেয়েছে। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে এখন। সমস্যা হবে মেয়েকে নিয়ে। এই মেয়েটা এখন এই ঝক্কি কিভাবে সামলাবে? রূপা বেগম অসহায় বোধ করলেন। চলবে