
রূপনির রূপকথা
উপন্যাস ১৮
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জুন ০৯, ২০১৯
১৯.
ওরা ভেবেছিল, সন্ধ্যার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করে ফেলবে। কিন্তু বিকেল থেকেই যে রবীন্দ্র সরোবরে মানুষের ঢল নামবে তা কে জানতো? সাধারণ মানুষের পাশাপাশি কিছু অসাধারণ মানুষ এখানে এসেছেন। কেউ শিক্ষক, কেউ নামি পেশাজীবী। মঞ্চে উঠে তারা সংহতি জানিয়েছেন। আরও অনেকে আসবেন। সময়ের সাথে সাথে যেন জনস্রোত বেড়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্র সরোবর এখন জনস্রোতে পরিণত হয়েছে। বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে চলছে লালনগীতি আর জাগরণী গান। সব বক্তাদের দাবির একটা সারমর্ম বানিয়ে একটা ঘোষণা পত্র তৈরি করা হলো। প্রায় মধ্যরাতে ঘোষণা পাঠ শেষে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো।
ঝক্কি-ঝামেলা শেষ করে ঈশান পিজি হাসপাতালের দিকে পা বাড়াতেই আনা সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল, চল আমি হাসপাতালে যাব। ঈশান আনার দিকে তাকালো। রাতের আলো-আঁধারিতে আনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সারাদিন ওর ওপর অনেক ধকল গিয়েছে। সে বলল, তুমি না হয় সকালে এসো। একটু ঘুমিয়ে আসো। আনা বলল, তোকে আর পাকামো করতে হবে না। এই বলে, আনা ঈশানের হাত ধরে গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। গাড়িতে আলো-আঁধারির মধ্যে ঈশান দেখল আনার চোখে পানি। আনা কাঁদছে।
রাত প্রায় ১টা বাজে। যানযটমুক্ত রাস্তায় প্রায় নিমিষেই ওরা পিজি হাসপাতালে চলে এলো। রাতে পিজি হাসপাতালের চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন দিনের মতো ভিড়ভাট্টা নেই। ওয়ার্ডগুলোতে হালকা আলো জ্বলছে। ঘুমঘুম চোখে চেয়ারে বসে নার্সরা ডিউটি করছে। কোনো কোনো রোগির আর্তচিৎকার ভেসে আসছে মাঝে মধ্যে। সবকিছু মিলিয়ে একটা মন খারাপ করা পরিবেশ। আইসিইউ’র রুমের বারান্দায় একটা ট্রলিতে একটা সাদা চাদরে ইকবাল ভাইকে ঢেকে রাখা হয়েছে। আশপাশে কেউ নেই। ইকবাল ভাইয়ের আত্মীয়-স্বজনরা এখনো আসেনি। অথবা আসতে পারেনি। আনা ঈশানের হাত আঁকরে ধরল। আনার নখ বসে যাচ্ছে ঈশানের বাহুর মাংসপেশিতে। ঈশান গিয়ে মুখের চাদরটা সরিয়ে দিল। ইকবাল ভাই যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গিয়েছেন। ঘুমানো আগে আকাশের তারা চিনতে চেষ্টা করেছিলেন বোধহয়। অনেক ঘুমহীন রাতে ইকবাল খোলা ছাদে শুয়ে আকাশের তারা দেখতেন। তারপর শেষরাতে আকাশের দিকে তাকিয়েই ঘুমিয়ে যেতেন।
ইকবাল ভাইয়ের মুখটা দেখে ফুপিয়ে উঠল আনা। এ সময় হাসপাতালের একজন ওয়ার্ড বয় এগিয়ে এলো। লাশের ছাড়পত্র সকালের আগে পাওয়া যাবে না। এই সময় পর্যন্ত লাশ মর্গে রাখতে হবে। আনা লাশ মর্গে রাখতে চাইলো না। কিন্তু ওই ওয়ার্ডবয় নাছোর বান্দা। ওর সাথে বাদনুবাদ চলতে লাগল। ঠিক এসময় আনার পরিচিত ডাক্তার ভদ্রলোক চলে এলেন। সকাল পর্যন্ত লাশ মর্গে না ঢুকিয়ে মর্গের বারান্দায় রাখার সিদ্ধান্ত হলো। লাশটা মর্গের বারান্দায় রাখার পর আনা একটা দু হাতে মুখ লুকিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসলো।
ইকবাল ভাই প্রায়ই বলতেন তিনি একশো বছর বাঁচতে চান। দু হাজার চল্লিশ সালে জিন টেকনোলজি সহজ লভ্য হবে। মানুষ এই টেকনোলজি ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত দেহে যে জিনের ক্ষয় তথা মৃত্যু হচ্ছে তার চেয়ে বেশি করে জিন জন্মনো সম্ভব হবে। ফলে মানুষ তার হারানো যৌবন ফিরে পাবে, বৃদ্ধ হবে না। অন্তত ইকবাল ভাইয়ের একটা আশা পূর্ণ হয়েছে তিনি বৃদ্ধ হতে চাইতেন না। বৃদ্ধ জীবনটাকে ঘৃণা করতেন, কারণ ওই বয়সে লড়াই করা যায় না। ইকবাল ভাই বৃদ্ধ হয়নি। মরার আগেও তিনি লড়াই করেছেন। চলবে