
রূপনির রূপকথা
উপন্যাস ১৯
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জুন ১০, ২০১৯
২০.
টেলিফোনটা একটানা বেজে চলছে। রূপা বেগম কাজের লোকদের ঈশারায় ফোন ধরতে নিষেধ করেছেন। প্রেসের লোকজনের উৎপাত শুরু হয়েছে। বাইরে একদল লোক হা হয়ে বাড়িটা দেখছে। দারোয়ানরা গেট লাগিয়ে বসে আছে। পুলিশ ছাড়া আর কাউকে বাড়িতে ঢুকতে না দিতে বলা হয়েছে। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে একদল আলোকচিত্রী সম্ভবত প্রেস ফটোগ্রাফার নানা এঙ্গেল থেকে বাড়িটার ছবি তুলছে। রূপা বেগমের এখন নিজেকে চিড়িয়াখানার জীবের মতো মনে হচ্ছে। জীবনে রূপা বেগম থানা পুলিশ মাড়ায়নি। অথচ আজ সকালে কি কঠিন ঝড়ের মোকাবেলাই না করতে হয়েছে। ডিবি আফিসে ঘণ্টাখানেক বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। যখন পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকবে তখনই যেতে হবে, এই শর্তে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। রূপা বেগম ভেঙে পড়তেন, কিন্ত মেয়ের জন্য তিনি নিজেকে ভেঙে পড়তে দেননি। নিজেকে শক্ত রাখার জন্য এখনো লড়ছেন, লড়ে যাবেন।
রূপা বেগম মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েটা সোফার ওপর চোখ বুঁজে শুয়ে আছে। ভীষণ অসহায় দেখাচ্ছে রূপনিকে। রূপা বেগমের দুচোখ ভিজে গেল। ওদের বিপদ সম্পর্কে রূপনি নিশ্চয়ই ধারণা করতে পারেনি। রূপনির পাপা লাল-শুয়ারের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই বলেই চলে। র্যাব ওকে নিয়ে কি করবে কে জানে? এখন পর্যন্ত এমন একজনও পাওয়া যায়নি যিনি ওদের সাহায্য করতে পারেন। লাল শুয়ারের পার্টনার-কর্মচারী সবাই পালিয়েছে। এই শহরে রূপা বেগমের কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। মফঃস্বল শহরে যারা আছেন তাদের কেউ হোমড়া চোমড়া নন, এরা কতটা কাজে লাগবে আদৌ কোনো কাজে আসবে কি না সন্দেহ! রূপা বেগম আর কিছু ভাবতে পারলেন না। মূষড়ে পড়লেন।
রূপনি চোখ বন্ধ করে আছে বটে তবে পত্রিকার পাতার লেখাগুলো চোখের সামনে ভাসছে যেন! পাপার ছবি না দেখলে রূপনি এসব মোটেই বিশ্বাস করত না। পাপা একজন খুনি, গ্যাং স্টার ভাবতেই রূপনির সব শূন্য হয়ে যায়। একটা ক্ষীণ আশা ওর বুকের মাঝে জেগে আছে হয়ত আগামীকাল শোনা যাবে যে পুলিশ ভুল করেছে। অন্য এক লাল শুয়ারকে ধরার বদলে পাপাকে ধরেছে! রূপনি কি পাপাকে বাঁচাতে কোনো সাহায্য করতে পারে না? এ ধরনের অবস্থায় পড়লে কি ভাবে সামলাতে হয় কে জানে! কারও সাহায্য নেয়া যেতে পারে। প্রথমেই মনে এলো জকিকে, ওর প্রচুর জানাশোনা, পুলিশের সাথে সম্পর্ক আছে। জকির সাহায্য নেয়া যেতে পারে। আরও আগে জকিকে ফোন করা উচিত ছিল। রূপনি চোখ খুলে তাকালো। মা সোফার হাতলে মুখ লুকিয়ে সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে। মা নিশ্চয়ই কাঁদছে। রূপনি মাকে কিছু বলল না। সেন্টার টেবিলে থাকা ওর মোবাইল সেটটা তুলে নিল। রূপনি সেন্ট বাটন স্পর্শ করল। রিং হচ্ছে, জকি ধরছে না। রূপনি ফের ফোন করলম, একই অবস্থা। তৃতীয় বার ফোন করতেই এঙ্গেজ টোন ভেসে এলো। জকি মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিয়েছে। এখন রূপনি কি করবে? অভিমান আর অপমানে ওর ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে যেন! একটু শান্ত হয়ে রূপনি মোবাইল ফোনের দিকে তাকালো। ঈশানের কথা মনে এলো। ওর মোবাইল কল লিস্টে ঈশানের অনেকগুলো মিসকল। রূপনি ভরসা পেল। ঈশানও অনেক বুদ্ধি রাখে। মন বলছে ঈশানের সাহায্য পাওয়া যাবে। অনেক আশা নিয়ে রূপনি ঈশানের নম্বব বের করে সেন্ড বাটন স্পর্শ করলো। এনগেজ টোন ভেসে এলো। বারবার সেন্ড করে একই ফল। ঈশানও ফোন বন্ধ করে রেখেছে। অন্য বন্ধুদের কথা মনে হলো। রুমকিকে ফোন করা যেতে পারে। হঠাৎ করে কথাটা ওর মনে এলো, কালকের রূপনি আর আজকের রূপনি এক নয়। আজকের রূপনি এক খুনির মেয়ে, খুনির মেয়ের সাথে সম্পর্ক কে রাখবে!
কী লাভ আর বন্ধুদের ফোন করে! ওদেরকে ফোন করলে ওরা বিব্রত হবে। রূপনি ওর বন্ধুদের খুব ভালবাসে। এই সব ভালবাসার মানুষদের বিপদে ফেলার মানেই হয় না। এতক্ষণে রূপনির চোখের সামনে ওর ভয়াবহ ভবিষ্যৎটা স্পষ্ট হলো। রূপনিকে এখন সবাই উপেক্ষা করবে, ওর সামনে আছে এক নির্বাসিত, একাকি জীবন। যে মনোবল নিয়ে রূপনি সোফা থেকে উঠে বসেছিল সেই মনের জোরটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল! রূপনি ফের সোফায় লুটিয়ে পড়ল। চলবে