রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ২৮

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জুন ১৯, ২০১৯

রূপা বেগম এখন সত্যি দিশেহারা। নিত্যনতুন পরিস্থিতি মেকাবেলা করতে হচ্ছে তাকে। পরিচিতরা যেমন দূরে সরে গেছে, ঠিক তেমন নানান ধরনের লোক মহব্বতের শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে তার কাছে আসছে। এই লোকগুলো যে সুবিধাভোগী, সুযোগ সন্ধানি তাতে সন্দেহ নেই। মহব্বতের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো আপাতত স্থগিত করা হলেও ভবিষ্যতে এগুলোর মালিক তিনি নয়তো রূপনি। এ ব্যাপারটা জেনে অনেকেই এখন তার সাথে যোগাযোগ করছে। এমন কি সরকারি দলের সাথে একজন প্রভাবশালী নেতাও এখন তার সাথে যোগাযোগ করতে চাচ্ছেন। অথচ মাত্র কিছুদিন আগে তিনি কি অসহায়ের মতো এদিক সেদিক ছোটাছুটি করেছেন। মহব্বত মরলেও ওর হাতে গড়া সাম্রাজ্য অনেক বড়। বড় জাহাজ ডুবতে যেমন সময় লাগে, তেমনি মহব্বতের সাম্রাজ্য ডুবতেও সময় নিচ্ছে। জাহাজ ডোবার আগে যে যা পারে হাতিয়ে নেয়ার তাল করছে। আরেক ধরনের লোক এসে জোটার চেষ্টা করছে। পাওনাদার, এরা নাকি মহব্বতের কাছে টাকা পায়। এই সব ঝুট ঝামেলা থেকে মুক্তির একটা পথই এখন তার কাছে খোলা, রূপনিকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়া। মুশকিল হলো, রূপা বেগম মফঃস্বলে বড় হয়েছেন। রূপনি বিদেশে গেলেও তিনি বিদেশে তেমন যাননি। কোথায় যাবেন কিভাবে যাবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। অন্যদিকে রূপনি আগের মতো স্বাভাবিক হচ্ছে না। রূপা বেগম ঠিক করলেন, আজ আনা আর ঈশানের সাথে ব্যাপারগুলো নিয়ে আলাপ করবেন।

সন্ধ্যা হয়ে এলো প্রায়। তিনি বেডরুমে এলেন। রূপনি একটা চাদর মুড়ি দিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো শুয়ে আছে। চাদরটা সরিয়ে তিনি রূপনির কপালে হাত দিলেন। না, জ্বরটর নেই। তার স্পর্শে রূপনি চোখ মেলে তাকালো। রূপা বেগম বললেন, মা, এখন একটু উঠে বস। সন্ধ্যা হয়ে এলো।
মা ওরা আসেনি?
এসে যাবে, তুই উঠ মা।
আগে ওরা আসুক, তারপর উঠবো। এ কথা বলে রূপনি আবার চাদর দিয়ে মুখ ঢাকল। রূপা বেগম আর কিছু বললেন না। হয়ত মেয়েটার অবস্থা একটু একটু করে উন্নত হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ঈশান এসে হাজির। ঈশানকে দেখে রূপা বেগম নিশ্চিত হলেন। এখন যদি রূপনি বিছানা থেকে ওঠে। আজ আনা আসেনি। একটা কাজে আটকা পড়েছে। অনেকদিন পর রূপনি মায়ের বেডরুম থেকে ড্রইং রুমে বসল। রূপা বেগম স্বস্তি পেলেন। মেয়েটা আস্তে আস্তে ঠিক হচ্ছে। তিনি রাতের খাবার তদারকির জন্য কিচেনে ঢুকলেন।

আজ আনা এলো না? ঈশানের পাশে বসতে বসতে রূপনি বলল।
ওর আজ একটা কাজ আছে।
ভালই হয়েছে। আজ আমি শুধু তোমার সাথে কথা বলবো। ম্লান হেসে রূপনি বলল। ঈশানও ওর কথার ধরনে হাসল।
আমার কেমন যেন হচ্ছে, ঈশান!
কি হচ্ছে?
সেটাই তো তোমাদের বোঝাতে পারছি না। রূপনি একটু থামল, আবার বলল, আমার কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আন্টি তো সেটাই বলল। তোমাকে নিয়ে বিদেশে চলে যাবে। তখন দেখবে সব কেমন ভাল লাগবে।
কি জানি! ভাল হলেই ভাল! রূপনি যেন আপন মনে বলল।
তুমি বোধ হয় জকিকে খুব খুঁজে বেড়াচ্ছ? ঈশানের দিকে তাকিয়ে রূপনি বলল। ঈশান চমকে গেল, মেয়েটা থট রিডিং জানে নাকি!
না, জকিকে কেন খুঁজবো। ঈশান বলল। বেশ কিছুদিন ধরে ঈশান জকির পাত্তা লাগাতে চেষ্টা করছে। কোথাও জকিকে পাওয়া যাচ্ছে না। জকি যেন বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে! জকির পরিচিত এক বলেছে জকি নাকি দেশে নেই, আর কখনো দেশে ফিরবেও না। জকি প্রসঙ্গ নিয়ে ঈশান রূপনির সাথে কথা বলতে বিব্রত বোধ করে।
ওকে আর খুঁজে পাবে না। কিলারের মেয়ের কাছে কে আসে? রূপনি বলল।

ঈশান প্রমাদ গুনল। রূপনি আবার এক্সাইটেট হচ্ছে। ভাবছে প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দেয়া যায় কিভাবে?
ঈশান তুমি কি আমাকে ঘৃণা করো? রূপনি ঈশানের চোখে চোখ রেখে বলল।
কি আজব, আমি তোমাকে ঘৃণা করবো কেন? এসব কথা বললে আমি আর তোমার এখানে আসবো না।
রাগ করো না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সবাই আমাকে ঘৃণা করে। তাই কথাটা বললাম। তা ছাড়া তোমাকে কথা দিয়েও আমি তোমার সাথে মিছিলে থাকতে পারিনি। আমি খুব স্বার্থপর তাই না! আমি তোমাকে বোঝতে চাইনি।
তুমি কিন্তু আনার কাছে প্রমিজ করেছিলে এ ধরনের কথা আর বলবে না। ঈশান বলল। রূপনি মাথা দোলালো কেবল। তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললো, তুমি কি আমাকে ভালবাসো?
অবশ্যই, আমরা সবাই তোমাকে ভালবাসি।
জকির মতো! এ কথা বলে রূপনি হেসে উঠল, যেন একটা মজার রসিকতা করেছে। তারপর ফের গম্ভীর হয়ে গেল।
আমার কথায় দুঃখ পেয়ো না। মাথাটা ঠিক নেই তো, কি বলতে কি বলে ফেলি! তোমার জন্য আমার ফিলিংস ঠিক বোঝাতে পারছি না। আমার সব কিছু ডিফিকাল্ট হচ্ছে কেবল। স্কুল লাইফ থেকে তোমাকে পেলে কত ভাল হতো! কিংবা তুমি যদি আমার ক্লাশ মেট হতে! নুতন একটা কিছু হতো... কি হতো দেখ এখন মাথায় কাজ করছে না।
সব ঠিক হয়ে যাবে রূপনি, এখন তো আমরা ফ্রেন্ডই... তুমি এত ভেবো না তো! ঈশান বললো।
রূপনি ফের হাসল। বলল, ঈশান, তোমার হাতটা দাও তো দেখি! রূপনি ঈশানকে বলে। ঈশান ওর ডান হাতটা রূপনির দিকে বাড়িয়ে দেয়। রূপনি দুহাত বাড়িয়ে ঈশানের হাতের পাঞ্জা মুঠোর মধ্যে নেয়। তারপর চুপচাপ বসে থাকে। ঈশান কিছু বলে না, চুপচাপ অপেক্ষা করে। রূপনির নরম হাত খুব উত্তাপে কেমন যেন একটা ভাল লাগার অনুভূতি বয়ে যায়। ঘরের হালকা আলো-আঁধারিতে রূপনির মুখটা অপার্থিব মনে হয়। রূপনিকে নিয়ে এ মুহূর্তে কোনো অজানার দেশে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। অনেকটা সময় নীরবে কেটে যায়।

আজ অনেকদিন পর রূপনি ডাইনিং টেবিলে বসল। রূপা বেগম এতহ্মন রূপনির পছন্দের সব খাবার তৈরি করেছেন। এখন রূপনির স্বাভাবিকতা দেখে তার মনটা ভরে গেল। টেবিলে এসে নিজের পছন্দের খাবার দেখে রূপনির মুখ দিয়ে, ‘ওয়াও’ শব্দটা বেরিয়ে এলো। রূপা বেগমের সাথে ঈশানের চোখাচোখি হলো। টেবিলে বসে রূপনি নিজেই সবার প্লেটে ভাত তুলে দিল। আনন্দে রূপা বেগমের চোখ দিয়ে আসতে চাচ্ছিল, তিনি অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকালেন। চলবে