রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ৩১

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জুন ২১, ২০১৯

আজ ঢাকার আকাশ কুয়াশায় মোড়া। অনেক বেলা হয়ে গেল, কুয়াশার দেখা নেই। ভার্সিটি থেকে পায়ে হেঁটে রুশনি, নোভা, নিউটন, রুমকি, ইলা ও ওদের অন্যান্য বন্ধুরা রূপনিদের বাসায় রওয়া হলো। বেশি দূর নয়, বনানী থেকে গুলশান। এই সকালেই ভার্সিটির প্রশাসনিক অফিস থেকে ওরা রীতিমতো শক্তি দেখিয়ে রূপনির ই্ক্স্পালশন উইদ্ড্র লেটারটা দ্রুত বের করেছে। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই লেটারটা রূপনির কাছে ওরা পৌঁছে দেবে। তারপর রূপনিকে নিয়ে সেলিব্রেট করবে। রূপনিকে আজ ঘর থেকে বের করবে। তারপর তুমুল আড্ডা দেবে এখানে ওখানে।

রুশনির মনটা খারাপ। সবার সাথে হাঁটলেও একটা অনুশোচনা বোধ ওকে আচ্ছন্ন করে আছে। রূপনির বেস্ট ফ্রেন্ড হলেও এতগুলো দিনের একদিনও রুশনি রূপনির বাসায় যায়নি। এখন কিভাবে রূপনির মুখোমুখি হবে? প্রথম কথা, কি বলবে? মোবাইলে ফোন পর্যন্ত করেনি, এর জবাব রূপনিকে কিভাবে দেবে! মায়ের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে রুশনির। ওকে কি ভীষণ বিভ্রান্তই না করেছে! রুশনি এ জীবনে আর মাকে ক্ষমা করতে পারবে না। মনে পড়ে, সেই কেজি ক্লাশ থেকে রুশনির সাথে রূপনির বন্ধুত্ব। রূপনিকে ছাড়া স্কুল, কলেজ কিংবা ভাসির্টিও একটা দিন কাটেনি। রুশনি খেতে খুব পছন্দ করে, এটা জেনে রুপনি লাঞ্চ টাইমে বাড়াবাড়ি আয়োজন করতো। তারপর খাবার নিয়ে ঠাট্টা-মশকরায় লিপ্ত হতো। কত দুরন্ত সময়ই কেটেছে রূপনির সাথে। দুজনের স্বপ্নগুলো এক সময় ভাগাভাগি করতো। চার বছর পর ভার্সিটি শেষ করে ইউরোপের কোনো দেশে চলে যাবে ওরা। কত নিশ্চিত ওদের ছিল ভবিষ্যৎ! অথচ এখন কত অনিশ্চিত রূপনির জীবন! ঈশান এমন করে না বললে রুশনি এইসব উপলদ্ধি করতে পারতো না। এ কারণে এখন নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হচ্ছে।

পথে যেতে যেতে এখন সবাই ঠাট্টা মশকরা করলেও কেন যেন রুশনির কান্না আসতে চাচ্ছে! পাছে কেউ দেখে ফেলে এ জন্য ও কান্নাটা রোধ করতে চেস্টা করছে, হাঁটছে সবার শেষে। গুলশানের বড় রাস্তা থেকে ওরা যখন রূপনিদের বাড়ির গলিতে ঢুকল তখন দলটা একটা মিছিলের আকৃতি নিয়েছে। ওদের কথার তোড়ে যেন প্রকম্পিত হচ্ছে সরু গলিটা। ওরা আরেকটু এগুতেই দেখল রূপনিদের বিশাল বাড়ি। বাড়ির গেটদুটো খোলা, গাড়ি বেরুবে বোধ হয়! আরেকটু এগুতেই ওদের কথা থেমে গেল। বাড়ির আঙ্গিনায় কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। যেন বোঝার চেষ্টা করছে ভেতরে কি হচ্ছে! বাড়ির ভেতর অনুচ্চ কণ্ঠে কে যেন কাঁদছে। রুশনির বুকটা কেঁপে উঠল। ওর হাতে থাকা রূপনির এক্সপালশন উইদড্রয়াল লেটারটা মাটিতে পড়ে গেল। রুশনি ওর সামনে থাকা নোভাকে ধ্বাক্কা দিয়ে দ্রুত রূপনিদের ড্রইং রুমে ঢুকে গেল। তারপর সবই মিলে প্রায় দৌড়ে চলে এলো দোতলায় রূপনির রুমে।

রূপনি ওর প্রিয় বেডরুমে শুয়ে আছে। রুমের টেম্পেরাচার ষোল। রূপনিকে একটা সাদা চাদর দিয়ে ওকে ঢেকে দেয়া হয়েছে। রূপনির মা সোফায় স্থির হবে বসে আছেন। তার চোখ ভাবলেশহীন, কাঁদছেন না, যেন পাথর হয়ে গেছেন। শুধু কাজের বুয়া দুজন সশব্দে কাঁদছে। ওরা সবাই বেডরুমে এলো। কেউ একজন রূপনির মুখ থেকে চাদরটা সরিয়ে দিল। রুপকথার রাজকন্যার মতো বিশাল বিছানায় রূপনি ঘুমাচ্ছে যেন! কোনো এক ডাইনি বুড়ি যাদুবলে ওকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। সোনার কাঠি আর রূপোর কাঠি বদল করে দিলেই রূপনির ঘুম ভাঙবে। রুশনি একবার রূপনির পায়ের দিকে আরেক বার রূপনির মাথার দিকে তাকিয়ে সোনার কাঠি আর রূপার কাঠি খুঁজতে লাগল। পেল না, এক ডাইনি যেন যাদু দিয়ে কাঠি দুটো অদৃশ্য করে দিয়েছে।

বাড়ির কেয়ার-টেকারের ফোন পেয়ে খুব ঈশান চলে এসেছে। মাঝরাতের পরই বোধ হয় এই অঘটনটা ঘটে। ঘুম আসতো না বলে রূপা বেগম দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের ঔষধ সেবন করতেন। বেড-সাইট টেবিলের ড্রয়ারেই ঔষধগুলো থাকতো। কালরাতে রূপনি স্বাভাবিক আচরণ করে মায়ের সাথে ঘুমাতে যায়। ঘুমানো আগে মাকে জিজ্ঞাস করে, পাপাকে তো বিচার করে শাস্তি দেয়া যেত। রূপা বেগম মেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, এসব ভেবে আর কাজ নেই। তুই ঘুমিয়ে যা।
আমার যে ঘুম আসে না, মা!
এরপরও অনেক রাত অব্দি রূপা বেগম জেগে ছিলেন। মেয়ে ঘুমিয়েছে নিশ্চিত হয়ে তিনিও ঘুমিয়ে যান। রূপা বেগম ঘুমিয়ে গেলে কোনো এক সময় রূপনি নিজের প্রিয় বেডরুমে চলে আসে। সাথে নিয়ে আসে মায়ের ঘুমের ঔষধগুলো। অনেকদিন ঘুমায়নি। এ কারণেই হয়ত ঘাটতি পুরনের জন্য রূপনি সব ঔষধ একত্রে খেয়েছে। না ফেরার দেশে যাওয়া নিশ্চিত করেছে।

ঈশানের এখন আর কিছু ভাল লাগছে না। এখন রূপনিদের বাড়ির বাইরের লনে চলে এলো। থানা থেকে লোকজন চলে এসেছে ইনভিস্টিগেশনের জন্য। রূপনির দেহটা এখন কাটাছেঁড়া হবে কিনা কে জানে! আজ আর কোনো কিছু নিয়ে ঈশান ভাবতে চায় না, রূপনির কথাও না। ঈশানের পিঠে কার যেন হাতের স্পর্শ লাগে। ঈশান ফিরে তাকায়, আনা। আনার চোখ পানি টলমল, ঈশানের ভেতরটা ওলট-পালট হয়ে গেল। ঠিক তখনই আশে পাশের কোনো বাড়ির মিউজিক সিস্টেম সচল হলো। এই এলাকার বাড়িগুলোর এক দেয়ালের খবর অপর দেয়াল রাখে না। এ বাড়ির শোক-বার্তা ও বাড়িতে নিশ্চয়ই যায়নি। কাকতালিয় ভাবে ভেসে এলো রূপনির প্রিয় গানের কলি।

ঈশার চোখের সামনে রূপনি যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠে। গানের তালে তালে আড়মোড়া ভাঙে। তারপর শূন্যে ভেসে রূপনি বিছানা থেকে নামে। রূপনির বিছানাটা যেন একটা মঞ্চ হয়ে যায়। অদ্ভুত এক আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া সেই মঞ্চে রূপনি যেন গানের তালে তালে ভেসে বেড়াচ্ছে। ঈশান মুগ্ধ চোখে দ্রুতলয়ের মুদ্রায় নেচে বেড়ানো রূপনিকে দেখতে থাকে। চলবে