রূপনির রূপকথা

শেষ পর্ব

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জুন ২২, ২০১৯

আজ আনা চলে যাচ্ছে। আনা কানাডিয়ান ফোক ফাউন্ডাশনের দু বছরের জন্য স্কলারশীপ পেয়েছে। ইদানীং আনার উদ্যমে চিড় ধরেছিল যেন। গান প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। চ্যানেলগুলো ডেকে পাঠালেও গানের অনুষ্ঠনে যায় না, স্টেজ শো করাও উদ্যম নেই। মনটা কোথাও যাই যাই করছে। আনা খুব ভেঙে পড়েছিল যেদিন জানল, যে স্থান থেকে লালনের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য অপসারিত করা হয়, সেই একই জায়গায় একই ভাস্কর মৌলবাদীদের চাহিদা মতো একটা ডেকোরেশন পীস বানাচ্ছে। একটির জায়য়গায় দুটি কাজ। সুতরাং ভাস্কর দু’বার বিল পেয়েছে। ডাবল লাভ। আনারা যখন লালনের ভাস্কর্য রক্ষায় আন্দোলনে নামে সেই সময়ই সেই ভাস্কর সরকারের সাথে আপোষ রফায় আসে এবং পালিয়ে থেকে নিরুদ্দেশ হওয়ার ভান করে। এই সব ভণ্ডামি আনাকে ক্লান্ত করে।

আনার একটা চেঞ্জ দরকার ছিল। সুতরাং আনা স্কলারশীপ পাওয়ায় ঈশান খুশিই হয়েছে। ঈশানেরও বিবিএ শেষ। ভাবছে, আর পড়াশুনা করবে না। বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য ছোটাছুটি করছে। পাড়ার গলির মোড়ের দাঁড়িয়ে থাকা চিলেকোঠার সামনে এলেই ইকবাল ভাইয়ের কথা মনে পড়ত। ওখানের আড্ডা ভেঙে যাওয়ার পর আড্ডায় আসা পাড়ার চেনা মুখগুলোর সাথে আর আগের মতো দেখা হয় না। কিছুদিন আগে এক সকালে ঈশান দেখল, ওই বাড়িটা ভাঙা হচ্ছে। এক ডেভেলপার ওই বাড়িটা কিনে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট বানাবে। একদিকে ভালোই হয়েছে। ইকবাল ভাইয়ের স্মৃতিটা এখন ওকে আগের মতো কাবু করবে না। ডেভেলপাররা এখন শুধু পুরানো ভবনকেই উপড়ে দিচ্ছে না, মানুষের স্মৃতিও ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দিচ্ছে।

রূপনির জীবনের শেষ দিনগুলোতে এভাবে জড়িয়ে না পড়লে ঈশান অনেক লুকানো যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যেত। এখনো প্রতিরাতেই রূপনিকে মনে পড়ে। মাঝে মাঝে নিজের হাতের দিকে তাকায়। এই হাতে রূপনির ছোঁয়া আছে। ঈশান নিজের হাতের ঘ্রাণ নেয়, রূপনির ঘ্রাণটা পাওয়ার চেষ্টা করে।

আনার চলে যাওয়ার কথা শুনে নোভার মাথায় আইডিয়া আসে। আনাকে ফেয়ার ওয়েল দেবে, এতে করে নিজেদের মধ্যে গেট-টুগেদার হয়ে যাবে। এক-দেড় বছরে ওদের সবার জীবনই কেমন পাল্টে গেছে। অনেকেই বিদেশি ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নিয়ে দেশ ছেড়েছে। ইলা, রুমকি, নিউটন কানাডার হ্যালিফ্যাক্সে চলে গেছে। সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে রুশনির জীবনে। রুশনির মা জলি বানু প্রায় জোর করেই রুশনির বিয়ে দেয়। বিয়েটা দু মাসের বেশি টেকেনি। রুশনি আবার ভার্সিটিতে ফিরে আসে। এখন সারাক্ষণ নোভা আর রুশনি একসাথে থাকে। লিভিং টুগেদার আর কি! রুশনি আর বিয়ে করতে চায় না। নোভাকে নিয়ে জীবন কাটাতে চায়। রুশনি অনেক ওয়েট লুজ করেছে। এখন আর যখন-তখন ফার্স্টফুডের দোকানে গিয়ে খেতে চায় না। নোভা ওকে খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করে। রুশনিকে এত স্লিম দেখতে নোভার ভাল লাগে না। কিন্তু রুশনি আরও স্লিম হতে চায়। এ নিয়ে ওদের খুনসুটি লেগেই থাকে। মাত্র একদেড় বছরে ওদের বয়স কয়েকগুণ বেড়ে উধাও হয়েছে ছেলেমানুষি। রুশনি এখন আর মা জলি বানুকে ভয় পায় না, নোভা কাছে থাকলে রুশনি একাই পথ চলতে পারবে।

দেখতে দেখতে আনার ছোট ড্রইং রুমটা ভরে উঠল। নোভা, রুশনি, জাহিদ, জুয়েল যারা ঢাকায় আছে তারা সবাই। তুমুল আড্ডা জমে উঠল। মনের আগল খুলে গেছে যেন তুমুল আড্ডা জমে উঠল। আজ বন্ধুরা সবাই নানা প্রসঙ্গে উঠালে কেউ রূপনির কথা তোলেনি। রূপনির প্রসঙ্গ তুলে এই পরিবেশটা ভারি করতে চাচ্ছে না কেউ। তাছাড়া রূপনির ব্যাপারে ওদের মধ্যে একটা অপরাধ বোধও এখনো কাজ করে। মনের গভীরে থাকলেও রূপনির স্মৃতি নিয়ে কেউ আর নাড়াচাড়া করে না। দুঃখকে খুচিয়ে তুলতে কার ভাল লাগে!

আনা আজ নিজ হাতে রান্না করেছে, ইলিশ মাছ আর খিচুরি। ওরা সবাই কাড়াকাড়ি করে খেতে লাগলো। খাবার শেষে ওরা ঘড়ির দিতে তাকালো, সময়টা আজ খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। আনার পাঁচটায় রিপোর্টিং। ঈশান দেখল, আনার মুখটা সময়ের সাথে কেমন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। ঈশানের মনটা খারাপ হয়ে যায়। আনা শেষবারের মতো ওর ল্যাগেজ গোছাতে লাগল। আলমারি থেকে বের করলো একটা কাগজে মোড়ানো প্যাকেট। সবার দিকে তাকিয়ে কাগজের প্যাকেটটা ছিঁড়ে ফেলল। বেরিয়ে এলো লাল-সবুজ পতাকা। এই পতাকা দিয়ে ইকবাল ভাইয়ের কফিন জড়ানো ছিল। আনা কারও দিকে না তাকিয়ে ধরা গলায় বলল, ‘তোদের যদি আপত্তি না থাকে তবে এই পতাকাটা আমি সাথে করে নিয়ে যেতে চাই। এখনো আমি জানি না, কবে ফিরবো, আদৌ ফিরবো কিনা?’ সবাই সম্মতি দিলে আনা পতাকাটা ভাঁজ করে লাগেজে রাখল।

ক সময় আনার গাড়িতে লাগেজ ওঠানো হয়। একে একে সবাই আনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আনা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেস্টা করে। অবশেষে আনা গাড়ি ওঠে। ওর পাশের সিটে ঈশান বসে, গাড়িটা বাঁক নিয়ে ভিআইপি রোডে ওঠে। ঈশান কোন কথা বলতে চায় না। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এখন বড় জোর পনের মিনিটের পথ। এই পনের মিনিটের যাত্রায় কোন কথাই শেষ হবে না এজন্য ঈশান নীবর থাকে। আনা ঈশানের হাতে হাত রাখে। কথা বলে না, জানালা দিয়ে বাইরের পৃথিবীটা দেখার চেষ্টা করছে যেন। এয়ার পোর্টে ডির্পাচার লাউজ্ঞের পার্কিং এ গাড়িটা থামে। ঈশান একটা ট্রলি নিয়ে আসে। আনার লাগেজগুলো তোলা হয়। আনা এসে ঈশানকে জড়িয়ে ধরে কয়েক মুহূর্ত। বলে, তুই ভালো থাকিস ঈশান।

আনার গায়ের স্পর্শে ঈশানের দেহে মনে চেপে থাকা কিছু একটা যেন বিস্ফোরিত হতে চাচ্ছে। আনাকে কিছু একটা বলতে ইচ্ছে। মুখে কোনো ভাষা আসছে না, এভাবেই অন্তত কাল আনাকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। আনা পর মুহূর্তে ঈশানকে ছেড়ে দেয়। আনা সচেতন ভাবে ঈশানের দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারপর ট্রলি নিয়ে আর পিছনে না তাকিয়ে ডির্পাচার লাউঞ্জে হারিয়ে যায়। ঈশান বোকার মতো ডিপার্চার লাউঞ্জের দিকে তাকিয়ে থাকে।

গাড়ির ড্রাইভার ওর পাশে এসে দাঁড়ায়, এখানে আর বেশিক্ষণ গাড়ি রাখা যাবে না। ঈশান গাড়িতে বসার পর গাড়িটা চলতে শুরু করে। এসি চলছে তারপরও ঈশান গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দেয়। বাইরের বাতাসের একটা ঝাপটা আসে। এয়ার পোর্টের রাস্তার মোড়ে লালনের ভাস্কর্যটার বদলে একটা ডেকোরেশন পীস বসানো হয়েছে। মৌলবাদীরাই বিজয়ী হয়েছে। এখন আর এসব নিয়ে কেউ ভাবেও না। একদিন লালনের ভাস্কর্য বাঁচাতে ওরা অনেক চেষ্টা করেছিল, এ কথা খুব বেশি লোক জানে না। এক বছরে ওদের স্মৃতিটাও যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ইকবাল ভাই ওইদিন ওভাবে উত্তেজিত না হলে হয়তো আরও কিছুদিন বাঁচতেন। ওই ঘটনায় ইকবাল ভাইকে হারানো ছাড়া ওদের আর কোনো প্রাপ্তি নেই। ওরা ছাড়া আর কেউ এ সব বেদনার কথা কোনদিন জানবে না। ওরা ছাড়া ইকবাল ভাইকে কেউ মনেও রাখবে না। আনা এক রকম পালিয়ে গিয়ে অনেক জ্বালা থেকে বেঁচে গিয়েছে। ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে ঈশান গাড়ি থেকে নেমে যায়। ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলে। ঈশান একা থাকতে চায়।

ঈশান ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে। ঈশানের বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে, ইকবাল ভাই নেই, রূপনি নেই, আনাও চলে গেল! ঈশান আকাশের দিকে তাকাল, আকাশটা আজ মেঘ শূন্য, হাহাকারে ভরা। সন্ধ্যার আকাশে বরাবরই হাহাকার থাকে। আনার প্লেনটা হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশে উড়বে। ছেলেবেলায় ঈশান আকাশে প্লেন দেখার জন্য অধীর অপেক্ষা করতো। সেই উৎকণ্ঠা নিয়ে ঈশান আকাশের দিকে তাকায়। একটা বিমান উড্ডয়নের শব্দ আসছে, ঈশান সন্ধ্যার মন খারাপ করা আকাশে আনার প্লেনটা খুঁজতে থাকে।