লালন শাহ

লালন শাহ

লালন শাহ ও আত্মদর্শন

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৫, ২০১৯

ইসলামি চিন্তাবিদ, দার্শনিক, সাহিত্যিক ও সমালোচক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের আজ জন্মদিন। ১৯০৬ সালের ২৫ অক্টোবর সুনামগঞ্জে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মদিনে ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার লেখা ‘লালন ও আত্মদর্শন’ প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

এদেশে মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তারের সূচনা থেকে হিন্দু ও মুসলিম এ উভয় সম্প্রদায়কে একই ভাবাদর্শের আলোকে পরিচালিত করার সাধনা দেখা দিয়েছিল। সে সাধনা রামানন্দ, কবীর, নানক, বা চৈতন্যদেবের মধ্যে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। ধর্মীয় জগতে এসব মহামানবদের যে সাধনা ছিল হিন্দু মুসলিম উভয় সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত, সে সাধনায় রাষ্ট্রীয় প্রকাশ শাহানশাহ আকবারের দীন-ই-এলাহি নামক ধর্ম প্রবর্তনে এবং কার পণ্ডিতজনগ্রাহ্য রম্নপের প্রকাশ-শাহজাদা দারাশিকোর মুজ`মাউল বাহরেইন নামক বিরাট গ্রন্থে।

এ সাধনারই জনগ্রাহ্য প্রকাশ দাদু (দাউদ) বুলহে, শাহ আবদুল লতীফ, লালন, মদন, হাসন রেজা ও শেখ ভানু। প্রকৃতপক্ষে বাদশাহী মসনদের আওতার বাহিরে এবং পন্ডিতী মহলের গভীর ভিতরে না পৌঁছেও এ দেশের জনসাধারনের মনে যে ঐক্য চেতনা দানা বেধেছিল এসব সাধু সন্ত্ ও পীর দরবেশের জীবনদিক তার মূর্তিমান প্রকাশ।

সর্বসাধারণের মধ্যে এঁরা মানবতাবাদী বলেই পরিচিত ছিলেন। তবে এঁদের মানবতাবাদ(Humanism) ইউরোপীয় মানবতাবোধ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। ইউরোপে পঞ্চদশ শতকে যে রেনেসাঁর জন্ম হয় এবং যার ফলে মানবতাবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ হয়, তার ভাবের স্রোত আমাদের দেশে এসে পৌঁছায় উনবিংশ শতাব্দীতে, হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর, মহামতি ডিরোজিওর প্রচারণা থেকে। সে মানবতাবাদের মৌলিক সূত্রগুলো সর্বপ্রথম হিন্দু সমাজে প্রবেশ করে। তার মূল বক্তব্য ছিল মানুষই মানুষের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ। এ জগতের সর্বত্রই মানুষের জয় ঘোষণা করতে হবে। ধর্মকে মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়োজিত করতে হবে। এ মানবতাবাদের প্রচারের ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানাবিধ শাখা বিকাশ লাভ করে। তবে তার সর্বশ্রেষ্ঠ ফলশ্রুতি হিসাবে দেখা যায় ব্যক্তি জীবনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রতিপত্তি। তার ফলে ইউরোপে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয় ত্বরান্বিত।

এ উপমহাদেশে যে মানবতাবাদের ধারণা বিকাশ লাভ করে, তার মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দু মুসলিম উভয়েই যে এক ভগবানের সৃষ্টি বা এক আল্লার পয়দা সে সত্যটি জনমতে প্রতিষ্ঠিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে উভয় ধর্মের শাস্ত্রীয় আচার সর্বস্ব মতবাদ পরিত্যাগ করে তার মূল সূত্রগুলো প্রতিষ্ঠা।দাদু, বুলহে, আবদুল লতীফ, লালন, মদন বা হাসন রেজার জীবনে সে সাধনারই প্রকাশ দেখা যায়। তাঁদের বক্তব্য ছিল, শাস্ত্রের চেয়ে সত্য বড়, বিধানের চেয়ে মানুষ বড়। মানুষের মধ্যেই সর্বশাস্ত্রের আধার সে মানুষ রতন। তাকেই খুঁজে বের করতে হবে।

পাশ্চাত্যে তত্ত্বজ্ঞানে যে চর্চা দীর্ঘকাল থেকে প্রবাহিত হয়েছে, তাতে বুদ্ধির সন্তোষ বিধানই ছিল মূল লক্ষ্য। প্লেটো তাঁর রাজনৈতিক মতবাদের রুপায়নের উদ্দেশ্যে এর আদর্শ প্রজাতন্ত্রের পরিকল্পনা করেছেন সত্য, তবে তাঁর অশরীরী ধারণাগুলোকে কেবলমাত্র চিন্তার মাধ্যমে বুঝবার চেষ্টা করেছেন। সারাদেহের, প্রাণের বা জীবনের অনুভূতি দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করেননি।

গ্রীক দর্শনের পতন যুগে আলেকজান্দ্রিয়ার প্লেটোবাদের যে আস্তানার সৃষ্টি হয়, তাতে গ্রীকদর্শন সর্বপ্রথম মানবজীবনের খানিকটা সংস্পর্শে আসে এবং নব্য-প্লেটোবাদকে কোন কোন পাশ্চত্য মনীষী দর্শনের অবমাননা বলে অভিহিত করলেও প্রাচ্যের কাছে এ সাধনার ধারাই ছিল প্রকৃত মানব জীবনের সাধনার ধারা। প্রাচ্যে তত্ত্বজ্ঞানকে কোন কালেই জীবন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে মননের চর্চা বলে গ্রহণ করা হয়নি। সার সত্যকে কেবলমাত্র বুদ্ধি কা মননের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেই প্রাচীন দ্রষ্টাগণ সন্তোষ লাভ করেননি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্যকে গভীরভাবে উপলদ্ধি করার সাধনা করেছেন।

এজন্যই বুদ্ধের সাধনাজাত ফলকে যেমন বৌদ্ধধর্মও বলা যায়, তেমনি বৌদ্ধ দর্শনও বলা যায়। শঙ্করের বেদান্ত ভাষাকে বেদান্ত দর্শন ও বেদান্ত্ ধর্ম দুই বলা যায়। ওঁরা স্বজ্ঞা ও নিধিধ্যাসনের মাধ্যমে যে সত্য লাভ করেছেন-জীবনে তাকে অনুভব করার জন্য সাধনা করেছেন এবং নীতি নির্দেশও দিয়েছেন।

প্রাচ্য ও পাশ্চত্য দর্শনের তুলনামূলক আলোচনা করলে আরও একটি বিষয় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রাতীচ্যে অভিজ্ঞা বুদ্ধি বা বেদীকে জ্ঞানের মাধ্যম বলে স্বীকার করে নিলেও তাদের আবার দেহের উপর কোন গুরত্ব আরোপ করা হয়নি। প্লেটোবাদীর কাছে আত্না গুহাবাসী মানুষের মত মাঝে মাঝে তার বিগত ধারণার আভাসমাত্র। অ্যারিষ্টিটলের নিকট সক্রিয় যুক্তি-ক্ষমতা বা বুদ্ধিই মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ পর্যায়। মৃত্যুর পরে এ যুক্তিক্ষমতাশীল দিকটি অমরত্ব লাভ করে। তবে জীবনকালে সে দেহের কোন জায়গায় অবস্থিত তার নির্দেশ তিনি দেননি। প্লাটিনাস মুক্তিলাভের প্রথম সোপানকে বলেছেন কেথারসিন (Katharsis)। এর কাজ হল আত্নাকে দেহ ও ইন্দ্রিয়ের প্রভূত্ব থেকে বিশুদ্ধ করে মুক্ত করা। সাধারন নীতির অনুশীলনের দ্বারাই তা সম্ভবপর। দ্বিতীয় পর্যায়ে চিন্ত্f, যুক্তি ও দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনার ফলে আত্নার পক্ষে উর্ধ্বে আরোহন করা সম্ভবপর হয়। তৃতীয় পর্যায়ে মানোত্না চিন্তার উর্দ্ধে প্রকৃত সত্ত্বার (Nous) স্বজ্ঞা (Intution) লাভ করে। তবে এসবগুলো প্রস্তুতির পর্যায়। সর্বশেষ পর্যায়ে মানবাত্না সমাধি (Trance) উল্লাস (Rapture) ও মহানন্দের মাধ্যমে ব্রহ্মলাভে সমর্থ হয়।

এস্তরে মানবাত্না চিন্তা বা মননের উর্দ্ধে আরোহণ (Ecstacy)করে নির্জ্ঞন (Unconscious) অবস্থায় মরমী ভাবাবেগে অবশিষ্ট হয়ে ব্রহ্মের সঙ্গে মিলিত হয়।

প্লাটিনাসের দার্শনিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে অতি আধুনিক কালে ডীন ইন্জ অভিমত গ্রকাশ করেছেন যে, মানবাত্না দ্বান্তিক ন্যায় শাস্ত্রের মাধ্যমে সত্যের দ্বারে উপস্থিত হয়, তাকে উপলদ্ধি করার একমাত্র মাধ্যম স্বজ্ঞা এবং গ্রীক দর্শনে মানবাত্নার মুক্তিপন্থা নির্দেশিত হয়েছে সত্য, তবে তা মানবদেহের সঙ্গে সমাধি, উল্লাস বা মহানন্দের কি সম্পর্ক তা নির্ধারিত হয়নি।

আধুনিক দর্শনের জনক ডেকার্তে মানবদেহ ও মানবমনকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় বলে ধারণা করেছেন। তাঁর মতে দেহ তার নিজস্ব নীতি অনুসারে পরিচালিত। আত্নাও তার নীতি দ্বারা পরিচালিত। তবে তাদের সংযোগ হয় একটি মাংসগ্রন্থীতে। তার নাম Panial Glend (পিনিয়াল গ্ল্যান্ড)।

বর্তমানকালের অভিজ্ঞতাবাদী (Empiricisis),যুক্তিবাদী (Rationalists) বা স্বজ্ঞাবাদীদের (Intuitionsis) আলোচনায় দেহ ও আত্নার সম্বন্ধের বিচার হয়েছে সত্যি, তবে দেহের মধ্যে আত্নার কোন বিশেষ আসনের বা বিশেষ স্থানের কোন আলোচনা হয়নি। অথচ প্রাতীচ্যের সুফীতত্ত্বে, বজ্রযান, সহজযান, বা বাউলদের ধর্মে এ মানবদেহের অভ্যন্তরে নানাবিধ চক্র বা লতীফার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

লালনের জীবনে বিভিন্ন ধর্মের মতবাদ তথা সাধনার ধারাকে সম্বন্বয় করার সাধনা দেখা যায়। ইসলামের সৃষ্টিতত্ত্বে, হিন্দুদের ব্রহ্মতত্ত্ব, অবতারবাদ বা জন্মান্তরবাদ সম্বন্ধে নির্বাক বৌদ্ধদের দেহতত্ত্ব সম্পর্কেও তাঁর জ্ঞান ছিল। তার চিন্তাধারার অনুসরণ করলে দেখা যায়, এগুলোর মধ্যে তিনি সম্বন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। কোন মতবাদকে মৌলিক সূত্র ধরে তিনি তার সঙ্গে অন্যান্য মতবাদের সম্বন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছিলেন তা নির্ণয় করা কঠিন। কেননা তার রচিত গানগুলোর তারিখ না থাকায় তাদের পৌর্বাপৌর্ব নির্ণয় করা যায় না। তবে তাঁর রচিত বিভিন্ন বিষয় সংক্রান্ত্ গানগুলোকে গভীরভাবে অনুধাবন করলে মনে হয়, প্রথমে তিনি ইসলামের সৃষ্টিতত্ব স্বীকার করে তা থেকে মায়াবাদ, সর্বেশ্ব্রবাদ প্রভূতি মতবাদে প্রত্যয়শীল হয়েছেন। ইসলাম ধর্মের প্রেরিত পুরুষ হযরত রাসুল করিম (সা.), শ্রীকৃষ্ণ বা চৈতন্যদেবকে তিনি আল্লার বা ব্রহ্মের বিভিন্ন গুণের অবতার বলে গ্রহণ করেছেন। পরিশেষে দেহতত্ত্বের আলোচনায় এমন সব সূক্ষ ইন্দ্রিয়ের সাক্ষাৎ পেয়েছেন যাদের জাগরনের ফলে এ বিশ্ব তথা সর্ব মূলাধারের প্রকৃতরম্নপের পরিচয় পাওয়া যায়।

একমাত্র আল্লাই যে এ জগতের একমাত্র হর্তাকর্তা বিধাতা তার প্রমাণস্বরুপ লালনের নিম্নে উল্লেখিত গানটি সুপ্রসিদ্ধ:
ইলাহি আলামিন গো আল্লা, বাদশা আলমপনা তুমি
ডুবায়ে ভাসাতে পার, ভাসায়ে কিনার দাও কারো।।

এস্থলে আল্লাকে লালন এ দুনিয়ার এবং আখেরাতের সার্বভৌম শক্তি হিসাবে অর্থ্যাৎ ইলাহি হিসাবে স্বীকার করেছেন।

কেবল সর্বশক্তিমান, সার্বভৌম শক্তি হিসাবে স্বীকার করেই ক্ষান্ত্ হননি, তার কাছে নিতান্ত্ ভক্তজনের মত দয়া ভিক্ষা করেছেন:
ক্ষম ক্ষম অপরাধ, দাসের পানে একবার
চাও হে দয়াময়।।

বড় তুফানে পড়িয়ে এবার বারে বারে ডাকি তোমায়।।

তোমার ক্ষমতায় আমি
যা পার, তাই করে তুমি
রাখ মার সে নামনামি
তোমারি এ জগতময়।।

এ বিশ্বব্রহ্মান্ডের স্রষ্টা আল্লার ধারণা কিন্তু তাঁর চিন্তা বিকাশের ধারার সর্বেশ্বররুপে পরিণত হল। স্রষ্টা দু`টো পৃথক সত্তা হিসাবে পরস্পর থেকে বিছিন্ন রইলো না। তারা একাকার হয়ে গেলো :
যে যা ভাবে সেই রুপ সে হয়।।

রাম রহীম করীম কালা
এক আল্লা জগতময়।।

কুল্লে শাইইন মুহিত, খোদা
আপনি জবানে কয়,
একথা যার নাহিরে বিচার
পড়িয়ে সে গোল বাঁধায়।।

আকার সাকার নয়-নিরাকার
এক আল্লা জগতময়
নির্জন ঘরে রুপ নিহারে
এক বিনে কি দেখা যায়।।

এক নিহারে দাও মন আমার
ছাড়িয়ে রেখো খোদায়
লালন বলে একরুপ খেলে
ঘটে পটে সব জায়গায়।।

এতে সর্বেশ্বরবাদী সুফীদের মত লালন সর্বভূতে একই আল্লার রুপ দেখলেও তাতে রহীম ও করীমের সঙ্গে রাম ও কালার উল্লেখ করায়, অবতারবাদের প্রত্যয়ের ছাপও সুস্পষ্ঠ। মুসলিমদের পয়গামধরবাদের সঙ্গে অবতারবাদের সম্বন্বয় করতে যেয়ে তিনি হযরত মুহাম্মদকে আলস্নারই গুণের প্রকাশ বলে বর্ণনা করেছেন :
মদীনার রাসুল নামে কে এল ভাই
কায়াধারী হয়ে কেন, তাঁর ছায়া নাই।।

কি দিব তুলনা তারে
খুঁজে পাই না এ সংসারে
মেঘে যায় ছায়া ধরে
ধুপের সময়।।

ছায়াহীন যাহার কায়া
ত্রিভূবনে তাহার ছায়া
এ কথার মর্ম নেওয়া
অবশ্য চাই।।

ছায়াহীন যারে দেখি
শরিক নাই সে লাশরিকি
লালন বলে তার হাকিকি
বলতে ডরাই।।

এ চিন্তাধারা লালনের ধ্যান-ধারনায় নতুন নয়। আল্লার `জাতের` সম্বন্ধে মানুষের কোন ধারণাই হতে পারে না। তিনি অবাঙমানসঃ গোচর। কিন্তু তাঁর নানাবিধ গুণের সঙ্গে অঙ্গীকরণের দৃষ্টান্ত্ রয়েছে ইসলামের ইতিহাসে। মানসুর হাল্লাজের `আনাল হক` বায়েজীদের `সুবহানী`, ইবনুলফকীরের `আনহিয়া` আল্লার সে গুণাবলীর সঙ্গে একান্ত্ হওয়ারই দৃষ্টান্ত্।

মুসলিমদের একদল সাধক নবীগণকে আল্লার এক এক গুণের সর্বোত্তম প্রকাশ বলে মনে করেন। তাঁদের একটি গান রয়েছে :
কত রঙ্গ ধরো, তুমি কত রঙ্গ ধরো
কথনও ইউসুফ হইয়া মিসরেতে চলো
কত রঙ্গ ধরো, তুমি কত রঙ্গ ধরো
কখনও মুসা হইয়া তুর পাহাড়ে চলো।

ইউসুফ নবীকে ইসলামী জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দর ও মুসা নবীকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতাপশালী বলে ধারণা করা হয়। উপরোক্ত সাধকমন্ডলীর মতে তাঁরা আল্লার দুটো গুণের পরিপূর্ণ প্রকাশ ব্যতীত আর কিছুই নন। লালন কিন্তু রাসুল করীমকে ত্রিভূবণের স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের ছায়াদাতা বলে বহু ঊর্দ্ধে তুলে নিয়েছেন এবং এখানেই থামেননি। নবীকে আল্লারই রুপের প্রকাশ বলে গৌরব বোধ করেছেন।
আসমান জমিন জল আদি পবন
যে নবীর নূরে হয় সৃজন
কোথা ছিল সে নবীর আসন
নবী পুরুষ কি প্রকৃতি আকার তখনে।।

আল্লা নবী দুটি অবতার
গাছ বীজ দেখি যে প্রকার
তোমার সুবুদ্ধিতে কর হে বিচার
গাছ বড় কি ফলটি বড়, লও জেনে।।

আত্নতত্ত্বে ফাজেল যে জনা
জানতে পায় সে নিগূঢ় কারখানা
হলো রাসুল রুপে প্রকাশ রাব্বানা
লালন বলে দরবেশ সিরাজ সাঁইর গুণে।।

এস্থলে লালন `নূরে মোহাম্মাদী` ও ব্যক্তি মোহাম্মদের মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি। একদল সুফীদের মতে নূরে মোহাম্মাদী এ জগতের উৎপত্তির মূলে, তবে তিনি ঠিক ব্যক্তি মোহাম্মদ নন।

তেমনী শ্রীকুষ্ণের মহিমা বর্ণনা কালে বলেছেন :
অনাদির আদি, শ্রীকৃষ্ণনিধি
তার কি আছে কভূ গোষ্ঠ খেলা।।

(থাকে) ব্রহ্মরুপে সে, অটলে বসে
লীলাকারী তার অংশকলা।।

সত্য সত্য সরল বৃহদাগমে কয়
সচ্চিদানন্দ রুপ পরম ব্রহ্ম হয়
জন্ম-মৃত্যু যার, এই ভবের পর
সেতো নয় কভূ স্বয়ং নন্দনালা।।

পূর্ণচন্দ্র কৃষ্ণ রসিক সেজন
শক্তিতে উদয় শক্তিতে সৃজন
(কুরে) মহাভাবে সর্বচিত্ত আকর্ষণ
বেদাগমে যারে বিষ্ণু বলা।।

গুরুর কৃপা বলে-কোন ভাগ্যবান
দেখেছে সেরম্নপ পেয়ে চক্ষুদান
সেরুপ হেরিয়ে সদা যে অজ্ঞান
লালন বলে, সে-তো প্রেমেতে ভোলা।।

এ কৃষ্ণই যে নদীয়ার গোরাচাঁদ হয়ে দেখা দিয়েছেন সে সম্বন্ধে লালন নিঃসন্দেহ :
কার ভাবে শ্যাম নদেয় এলো।
তাঁর ব্রজের ভাবের কি অনুসার ছিল।।

গোলকেরী ভাব তোজিয়ে সে ভাব
ব্রজপুরে লয়েছিল যেহি ভাব
তবে নাহিত সে ভাব, দেখি নতুন ভাব
এ ভাব বুঝিতে কঠিন হলো।।

সত্য যুগে সঙ্গী বৈষিকা চিল
ত্রেতায় সঙ্গী সীতা লক্ষী হোল
দ্বাপরে সংগিনী, রাধা রঙ্গিনী
কলির ভাবে তারা কোথায় বল।।

কলিযুগের ভাব একি বিষম ভাবে
নাহি ব্রতপুজা, নাহি অন্য লাভ
দীপ্ত বেশ বেকল, দন্ড কমগুল
এসে নিতাই আবার ভেঙ্গে দিল।।

সে ভাব জেনে ভাব লওয়া হোল দায়
না জানি কখন কি ভাব উদয়
করলে তিনটি লীলে, গৌর নিতাই মিলে
লালন ভেবে দিশে নাহি পেল।।

সৃষ্টিকর্তা আল্লার রুপ অনাদি ব্রাহ্মের নানা গুণের প্রকাশস্বরুপ পয়গম্বর বা অবতার এ দুনিয়ার আবির্ভূত হচ্ছেন। তাঁদের এরুপ আবির্ভাবের মধ্যে রয়েছে মায়ার খেলা। এ মায়ার দ্বারাই আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ তার সত্যিকার রপের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে। সে তার দেহকেই আসল রুপ বলে ভ্রমে পতিত হচ্ছে। তার দেহের মাঝেই যে সে অরুপতন, সে তত্ত্বটি বুঝতে না পেরে সে তাকে খুঁজে মরছে হেথায় হোথায়।

এ পর্যায়ে লালনের গানগুলো থেকে স্পষ্টই বুঝা যায়, তিনি কখনও বা আত্ন-অন্বেষণের জন্য ব্যাকুল, আবার কোথাও বা আত্ন-দর্শনে প্রত্যয়শীল। মানুষের সারসত্তা যে তার দেহেরে মধ্যেই বিরাজমান সে তত্ত্বে প্রত্যয়শীল হয়ে তিনি নিজেকে সম্বোধন করে বলেছেন :
ক্ষ্যাপা তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়।
আপন ঘর না বুঝে বাহিরে খুঁজে পড়বি ধাঁধায়।।

অন্বেষণমূলক গান ব্যতীত অন্যান্য গানেতে মনের মানুষের স্বরম্নপ বর্ণনা করা হয়েছে :
এই মানুষে আছে রে মন
যারে বলে মানুষ রতন
লালন বলে পেয়ে ধন
পারলাম না চিনিতে।।

সেই মানুষ-রতনকে লালন সম্পূর্ণভাবে চিনতে না পারলেও তার মূল প্রকৃতি সম্বন্ধে ছিল তাঁর পরিস্কার ধারণা :
পর অর্থে পরম ঈশ্ব্র
আত্নাররুপে করে বিহার।।
সিরাজ সাঁই বণে রে লালন
গুরুপদে ডুবে আপন
আত্নার ভেদ জানলে না
আত্না আর পরমাত্না
ভিন্ন ভেদ জেনো না।।

যে আত্না আর পরমাত্নানার মধ্যে কোন ভেদ নেই, সে পরমাত্না মানবদেহের কোখায় বা কোন অংশে বিরাজ করে? তার উত্তরে লালন বলেছেন :
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মন-বেড়ী
দিতাম তার পায়।।

আটকুঠরি নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা
তার উপরে সদর কোঠা
আয়নামহল তায়।।

পরম আত্নাকে অচিন পাখি বলে লালন ধারণা করেছেন, তেমনি আরও নানাভাবে নানারুপে ধারণা করেছেন। সে সব ধারণাতে বৈষ্ণব মতবাদ ও সহজিয়া মতবাতের নানাভাবের প্রতিফলন সহজেই আবিস্কার করা যায়।

তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষ লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, লালন সে অচিন পাখির মধ্যে লীন হতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি ও তাঁর পরমারাধ্য পরমাত্তার মধ্যে একটা দ্বৈত পার্থক্য বজায় রাখতে ছিলেন উন্মুখ। একটি গানে তাঁর এ মনোভাব অত্যন্ত প্রকটিত।
চিনি হওয়া মজা, কি খাওয়া মজা
দেখ দেখি মন কোনটা মজা।
সালোক্য, সামীপ্য, সাষ্টি
সারম্নপ্য মুক্তি আদি
এসব মুক্তি পায়
তারাও হয়ে রয়, জমের প্রজা।।

নির্বাণ মুক্তি সেধে যেত
লয় হয় পশুর মত, মুক্ত হওয়া চিনি
কি খাওয়া চিনি
কি ভাবে তাতে যায় দুঃখ সুখ বোঝা।।

রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব সম্বন্ধেও এরম্নপ জনশ্রম্নতি রয়েছে যে, তিনি নাকি বলতেন, `আমি চিনি হতে চাইনে, চিনি খেতে চাই।" এ-দ্বৈতবাদ লালন শাহের বহু গানে তা প্রকাশিত। লালন শাহের কাছে তাই এ পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা অথবা পরম ব্রহ্ম মানবদেহে বাস করেও মানুষ থেকে একটু পৃথক রয়ে গেলেন। মানুষ সাধনার দ্বারা সে মনের মানুষকে উপলদ্ধি করবে তবেই না তার মানবজনম সার্থক ও সফল হবে।

যদিও লালন দ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদ এ দ্বন্দে দোল খেয়েছেন তবুও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়-জীবন ভরেই তিনি ছিলেন সত্য সন্ধানী। খোলা ও প্রশস্ত্ম মন নিয়ে তিনি জ্ঞানের ÿেত্রে অগ্রসর হয়েছেন। এখানেই রয়েছে-তাঁর সত্যিকার পরিচয়। জ্ঞানের পূর্ণ বিকশিত আদর্শ সর্বকালেই মানবদেহে আদি সঞ্চালক বা মহাআকর্ষণকারীরম্নপে বিরাজমান। তাঁর সান্নিধ্যে জ্ঞানসাধক কতটুকু অগ্রসর হয়েছেন, সে বিষয়ই প্রধান বিচার্য বিষয় নয়। তিনি সে সাধনার ধারাই নিষ্ঠাবান ছিলেন কিনা-সেইটে দার্শনিক মহলের প্রাণিধানযোগ্য বিষয়। লালন অবিচলিত চিত্তে সত্যের পথে অগ্রসর হয়েছেন বলে সর্ব যুগেই তিনি সত্যানুসন্ধানী মানুষের শ্রদ্ধার্য্য সমর্থ হবেন নিঃসন্দেহে।

প্রমাণপঞ্জি:
    A short History of Muslim Rule of India : Dr. Ishwari Prosad
    The Din-i-Ilahi of the Religion of Akbar : Makham Lal Roy Chawdhury
    মুজমা উল-বাহরেইন : শাহজাদা দারা শেকোহ
    History of Philosophy : Frank Thiiy
    Humanism in the East and the
    The Republic : Sylvan Leor Plato
    Philosophy of Plotimust : Dean Inge
    History of Philosophy : Welery Thilly
    লালন শাহ ও লালন গীতিকা : মুহম্মদ আবু তালিব।
    লালন শাহের পূণ্যভূমি : হরিশপুর: খোন্দকার রিয়াজুল হক।
    ভাবসংগীত : খোন্দকার রফীউদ্দীন।
    হারামণি : মুহাম্মদ মনসুরউদ্দীন।
    বাংলার বাউল ও বাউলগান : ড. উপেন্দ্ররাথ ভট্টাচার্য।
    লালন-পরিচিতি : মুহম্মদ আবু তালিব।