লুঙির গিঁট শক্ত করে বাঁধা, ভেতরে সব খোলা

পর্ব ৯

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৬, ২০২১

কথাসাহিত্যিক মারুফ ইসলাম ‘দহনদিনের লিপি’ শিরোনামে আত্মজীবনীর মতো করে গদ্য লিখছেন ছাড়পত্রে। আজ প্রকাশিত হলো নবম পর্ব।

২৩ এপ্রিল ২০২১ শুক্রবার
বেলা দ্বিপ্রহর হয়নি, সূর্য মাথার চাঁদি বরাবর ওঠেনি, তবু জোহরের আজান পড়ে গেল! কেন? আজ যে শুক্রবার। জুম্মার দিন। জুম্মাবারে একটু আগেই  আজান পড়ে। এটাই নিয়ম।

আমি তখন গোসল সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়েছি মাত্র। দরজায় ঠকঠক। এ সময় আবার কে এলো? সাধারণত সদর দরজা পেরিয়ে দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে সিঁড়ির কাছে আরও একটি গেট পেরিয়ে দোতলা অবধি বাইরের কেউ আসা সহজ নয়। ভাবলাম, আমাদের ফ্ল্যাটেরই কেউ হবে হয়তো।

কিন্তু না। আমার ধারনা ভুল প্রমাণিত হলো। দরজা খুলে দেখি, একজন বাইরের লোকই দাঁড়িয়ে আছেন। আপাদমস্তক কালো বোরখায় ঢাকা। চোখ দুটো অবশ্য খোলা।
`খুব বিপদে পড়ে এসেছি। আমাকে একটু সাহায্য করবেন?`
এই দুটো বাক্য বলতে প্রায় আধা মিনিট সময় নিলেন ভদ্রমহিলা। তার কণ্ঠ ভারাক্রান্ত। চোখে পানি। বোরখার নেকাবের অন্তরালে মুখটা লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠেছে, তা না দেখেও ঢের বুঝতে পারি। তার প্রমিত উচ্চারণে অবাক হলাম। তিনি যে পেশাদার ভিখিরি নন, তা বুঝতে আর বাকি রইল না।
‘আমরা চার দিন ধইরা ঘরে বসা। খাবার সব ফুরাইয়া গেছে। স্বামী রিকশা চালাইতো, ডাম্পিংয়ে নিয়া গেছে। টাকার অভাবে ছাড়াইতে পারতেছে না।’
এরকম পরিস্থিতিতে কী বলা কর্তব্য আমার জানা নেই। আমি বিব্রত হই। অস্বস্তিতে পড়ে যাই। মনে হয়, ওই মানুষটার দুরবস্থার জন্য আমিই দায়ী। আসলে তো আমি দায়ী নই। তারপরও কেন এমন বোধের জন্ম হয় তা আমার বোধের অগম্য। আমি দ্রুত ঘর থেকে কিছু টাকা এনে ভদ্রমহিলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তৎক্ষণাৎ দরজা আটকে দেই মূলত নিজের লজ্জিত মুখ আড়াল করার জন্য।

মানুষের কষ্ট বাড়ছে। মানুষ খুব দ্রুত নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। দুদিন আগেই মনে হয় প্রথম আলোতে দেখলাম, দেশে নতুন করে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে দুই কোটি ৪৫ লাখ! আমার মনে পড়ল, রাজা চতুর্থ হেনরি যখন প্যারিস আক্রমণ করেছিল তখন প্যারিসের লোকসংখ্যা ছিল এক লাখ, যার মধ্যে তিরিশ হাজার ছিল ভিক্ষুক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি যখন পোল্যান্ড আক্রমণ করে, তখন সেই অভিঘাত এসে লেগেছিল লন্ডনেও। তখন শুধু লন্ডন শহরেই প্রস্টিটিউট বেড়ে গিয়েছিল আশি হাজার। পেটের দায়ে কে কী করছিল তখন তার ঠিক নেই।

আমরা কি এক আক্রমণের কাল পাড়ি দিচ্ছি? এই বাসায় প্রায় চার বছর ধরে আছি। কখনো দোতলা অবধি ভিক্ষুক উঠে আসতে দেখিনি। আজ দেখলাম। ভবিষ্যতে আরও দেখতে হবে বলেই অনুমান করি। কেন না আমরা তো এক আক্রমণের কালই অতিক্রম করছি। কোভিডের আক্রমণ, দুর্নীতিবাজদের আক্রমণ, স্বৈরাচারদের আক্রমণ, ধর্মান্ধদের আক্রমণ, লুটেরাদের আক্রমণ, ভণ্ডদের আক্রমণ…। আক্রমণের শেষ নেই। ভিখিরির সংখ্যা তো বাড়বেই।

এরমধ্যে খবর পেলাম ২৫ তারিখ থেকে, মানে রোববার থেকে খুলে যাচ্ছে দোকনপাট, শপিং মল। কিন্তু কড়া লকডাউন চলবে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত! কীভাবে? জবা কি পারবে? এই অসম্ভবকে তো অনন্ত জলিলের পক্ষেও সম্ভব করা সম্ভব নয়। বাঙালি রসিক আছে। এমন কড়াকড়িকে অনেকই তুলনা করছেন লুঙ্গির গিটের সঙ্গে। শক্ত করে বাঁধা, কিন্তু ভিতরে সব খোলা।

সবাই তো আর রসিক নন। কেউ কেউ বেশ চটে গিয়ে বলছেন, সব কিছুই যখন খুলে যাচ্ছে, শুধু শুধু গণপরিবহণ বন্ধ কেন? ওটাই তো আগে খোলা উচিত। আমরা কি হেঁটে হেঁটে শপিং করতে যাব?

এই চটে যাওয়া ভদ্রমহোদয়া ভ্যানের উপর সাজিয়ে রাখা হলুদ হলুদ কলা কিনছিলেন। তখন ইফতার উত্তর সময়। আমিও সেখানে কলা দেখছিলাম। ভাবছিলাম, একছড়ি কিনলে মন্দ হয় না। রোজা রমজানের দিন। হঠাৎ ওই মহিলার দিকে তাকিয়ে দেখি, তিনি প্রশ্নটা আমাকেই করেছেন। উত্তরের জন্য ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছেন। দশাসই বপু। খাম্বার মতো হাত। চোখে কাজল নাকি অন্যকিছু সেঁটেছেন বুঝলাম না। তাকে দেখাচ্ছিল আলিফ লায়লার জাদুকরী মহিলাদের মতো।

কোনোমতে ঢোক গিলে বললাম, তা বটে। তা বটে। এ কেমন অনাচার! আমরা কি হেঁটে হেঁটে শপিং করতে যাব নাকি?
তারপর কলা না কিনেই দ্রুত পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলাম। চলবে