লেখা, লেখানো এবং জ্ঞানচর্চার জমিন

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : আগস্ট ২১, ২০১৯

কোনো বড় লেখকই শুধু নিজের লেখা নিয়ে পড়ে থাকেননি। তারা চেষ্টা করেন সৃজনশীল বা মননশীল চর্চার ঐতিহ্য তৈরি করতেও। পরামর্শ দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে এবং পত্রিকা বের করেও। বঙ্কিমচন্দ্র বের করেছিলেন বঙ্গদর্শন পত্রিকা, রবীন্দ্রনাথ সাধনা, ভারতী, ভাণ্ডার প্রভৃতি পত্রিকাসহ ‘বঙ্গদর্শন’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন কিছুকাল। প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ভাষা ও চিন্তার পরিমণ্ডলে। T.S Eliot প্রায় দেড়যুগ সম্পাদনা করেছেন The Criterion নামক পত্রিকাটি। তার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল, শিল্পের উচ্চমান বজায় রাখা ও ইউরোপীয় ইন্টেলেকচুয়াল কমিউনিটিকে একীভুত করা।

The Criterion এর প্রথম সংখ্যায়ই বের হয় এলিয়টের বিখ্যাত কবিতা The waste Land. এলিয়টই কোনো ইংরেজি সাহিত্যপত্রিকায় প্রথম ছাপেন মার্সেল প্রুস্ত, পল ভালেরির মতো ফরাসি উপন্যাসিক ও কবির লেখা। সাহিত্যের অনবদ্য পৃষ্ঠপোষক হিশেবে ইতিহাসে প্রায় অক্ষয় হয়ে থাকবেন কবি Ezra pound। বিশ শতকের প্রায় সকল বড় কবির অভিভাবকতুল্য তিনি। হ্যারিয়েট মনরোর ‘পয়েট্রি’ পত্রিকায় কত কত জনের কবিতা ছাপানোর ব্যবস্থা যে তিনি করেছেন! ওভারসিস এডিটর হিশেবে তিনি রবার্ট ফ্রস্ট, এলিয়ট, কার্লোস উইলিয়াম কার্লোসসহ দেশ-বিদেশের অগণিত কবির লেখা ছাপান। ছোট ছোট সাহিত্য জার্নাল প্রকাশের মাধ্যমে এজরা তার চিন্তা প্রচার করতেন ও পরিচয় করিয়ে দিতেন নতুন কবিদের কাব্যকীর্তির সাথে। তার লেখা অনেক পত্রিকাকেই বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করতো। ছদ্মনামে সঙ্গীত ও শিল্পবিষয়ক রিভিউ লিখতেন নিউ এইজ পত্রিকার জন্য।

পাউন্ড The Little Review পত্রিকার ফরেন এডিটর হন এবং এই পত্রিকাকে তিনি জেমস জয়েস, উইন্ডহাম লিউইস, এলিয়ট ও তার নিজের লেখালেখির এক সমবেত ভূমি বানাতে চান যাতে বিচ্ছিন্ন, অনিয়মিত ও দীর্ঘ অকার্যকর বিলম্বের চেয়ে একসাথে নিয়মিতভাবে, একই পরিসরে গদ্য লিখে যেতে পারেন। তার নিজের দীর্ঘ দিনের পরিকল্পিত জার্নাল দ্য ইক্সাইলের চারটি সংখ্যাও বেরিয়েছিল। এফ আর লিভীস ও তার স্ত্রী কিউ ডি লিভীস মিলে Scrutiny নামে যে-পত্রিকা বের করতেন, কয়েক দশক ব্যাপী সাহিত্য ও সমাজচিন্তাকে তা প্রভাবিত করেছিল, ইংরেজি সাহিত্যের মানচিত্রকেই পুনঃঅংকন করেছিল।

আমাদের দেশে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীরর মতো প্রবন্ধ লিখে এত জনপ্রিয় আর কেউ হননি। বার্ধ্যক্যে এসেও তিনি সম্পাদনা শুরু করেন ‘নতুন দিগন্ত’ নামক ত্রৈমাসিক পত্রিকাটি। শুধু লেখালেখি করে গেলেই তো চলতো ইংরেজির এই অধ্যাপক ও লেখকের। কিন্তু নতুন লেখা পড়বার ও পড়াবার সুতীব্র আকুলতা, সমাজ-রূপান্তরের ভাবনা এবং চিন্তা, মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতার বিস্তারের আকুতিই তাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে এই শ্রমসাধ্য কাজ। প্রয়াত খোন্দকার আশরাফ হোসেন দীর্ঘদিন বের করেছেন সাহিত্য ও নন্দন ভাবনার কাগজ ‘একবিংশ’। অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদ ও লেখা প্রকাশ হতো এতে। উপকৃত হতাম আমরা। মীজানুর রহমান ও তার নিজনামে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকার কথা আরেকদিন বলবো।

এদেশে বাংলাভাষায় জ্ঞানচর্চার শক্ত জমিন তৈরি করতে উন্নতমানের জার্নাল, ম্যাগাজিন বা পত্রিকার  বিকল্প নাই। স্রেফ সাহিত্য পত্রিকা বা দৈনিক পত্রিকার কথা বলছি না, বলছি নানা বিষয়ে সিরিয়াস মননশীল প্রবন্ধ নিয়ে পত্রিকার কথা। সোসাল মিডিয়ায় লেখালেখির গুরুত্ব স্বীকার করলেও এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, ফেসবুক তত্ত্বচর্চার জমিন হয়ে উঠেনি, গভীর চিন্তামূলক লেখালেখির ক্ষেত্র নয় এটি। ত্বরিৎ প্রকাশ ও সাড়া পাওয়ার সুযোগ থাকায় মন্তব্যধর্মী ও কিছুটা বিশ্লেষণী লেখাগুলো এতে জনপ্রিয় হয়। ফেবু আসলে চিন্তাচর্চার ফলাফল প্রকাশের জায়গা। প্রিন্টেড জার্নালে বড় পরিসর ও যখন-তখন হাতে নিয়ে পড়তে পারার আরাম থাকায় আরো কয়েক দশকেও এর গুরুত্ব ম্লান হবে না।

নীরব ও নিঃশব্দ সাধনায় যারা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা চর্চা করেন তাদের লেখালেখি ও গবেষণার ভূমিতে দাঁড়িয়েই ফেবুতে আমাদের সমাজ, রাজনীতির বিশ্লেষণ ও ইনসাফের বয়ান চলে। দেশের নানা প্রান্তে, শহরে-শহরে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোতে প্রকাশিত হোক অজস্র জার্নাল ও চিন্তামূলক পত্রিকা।

দর্শন, ইতিহাস, নন্দন, বিজ্ঞান, অর্থনীতিশাস্ত্রের প্রভাবশালী চিন্তাগুলোকে জনমানুষের কাণ্ডজ্ঞানে পরিণত  করতে প্রকাশিত হওয়া দরকার অসংখ্য মননশীল পত্রিকা। বিশ্ববিখ্যাত আমেরিকান সাহিত্য পত্রিকা ‘পয়েট্রি’র সম্পাদক হ্যারিয়েট মনরো রবীন্দ্রনাথের কবিতা ছেপেছিলেন, ও ঠাকুরের চেয়ে বয়সে এক বছরের ছোট ছিলেন; তিনি শিকাগো শহরের একশো ধনাঢ্য ব্যক্তির সহায়তা নিয়ে দুইযুগ ধরে (১৯৩৬ সালে তার মৃত্যুর আগপর্যন্ত) সম্পাদনা করে গেছেন তার পত্রিকাটি, গভীর নিষ্ঠায় ও শ্রমে। বিশ্বময় কাব্যের ‘আধুনিকতা’ নির্মাণে এ-পত্রিকা রেখেছিল অবিসংবাদিত অবদান। আমাদের দেশেও দরকার এমন সম্পাদক, এমন মননশীল পত্রিকা, এবং এমন অকুণ্ঠ বিত্তবান ও বিদ্বৎসাহী পৃষ্ঠপোষক।

লেখক: প্রাবন্ধিক