
লেখালেখি বড় দায় বই বেচার কী উপায়
মাহবুব মোর্শেদপ্রকাশিত : এপ্রিল ১৮, ২০২১
সাহিত্যিকরা আছেন ভীষণ বেকায়দায়। উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ কিছুই বিক্রি হয় না। সাকুল্যে তিনশো কপি বই বিক্রি হলে লেখকরা বর্তে যান। ভাবেন, ইতিহাসে একটু হলেও জায়গা হলো। ঘনিষ্ট সার্কেলে নিজেরা নিজেদের পিঠ চাপড়ে একটু স্বস্তি পান বটে, কিন্তু পুরো শান্তি আসে না।
বইমেলায় গিয়ে দেখেন, নতুন লেখকদের বই লোকে লাইন ধরে কিনছে। রকমারিতে ঢুকে দেখেন, তাদের কেউ পোছে না। কেউ বলে, এখনকার লেখকরা লিখতে পারে না। কেউ বলে, এরা জনমনস্তত্ব বোঝে না, উল্টো জনবিরোধী। কেউ বলে, এদের সমাজে কোনো ভূমিকা নেই। কোনো পরিচিতি নেই। কেউ বলে, এরা সমাজবিচ্ছিন্ন। কেউ বলে, এদের ভাষা দুর্বল। কেউ বলে ভাষা কঠিন। কেউ বলে, বিষয় নির্বাচন ঠিক নেই। হালারা বোঝেই না কী নিয়ে লিখতে হবে।
উপর্যুপরি আক্রমণে লেখক জীবন ব্যর্থ হবার উপক্রম। এ অবস্থায় করণীয় কী? জিজ্ঞেস করেছিলাম এক বন্ধুকে। বন্ধু বললো, আমার কাছে খুব ভালো আইডিয়া আছে। এক কাজ করো, ইউটিউবে চ্যানেল খোলো। নিয়মিত ভিডিও আপলোড করো। বললাম, সে ভিডিওতে কী বলবো, কীই বা দেখাবো? আমি তো বলার মতো কিছু পাই না।
তাহলে এক কাজ করো। ইউটিউবে ওয়াজ করা শুরু করো। ওয়াজ তেমন না চললেও বই কিছু বিক্রি হবে।
লোকে কী বলবে? শেষপর্যন্ত ওয়াজে নামবো?
বন্ধু চিন্তায় পড়ে যায়, বলে, তাহলে অনলাইন ভিত্তিক একটা স্কুল খোলো। কিছু শেখাবা।
শেখানোর মতো কিছু জানলে কী আর বসে থাকি?
নিজের দুইটা আইডিয়া মার খেলে বন্ধু একটু খেপে যায়। বলে, তুমি ফেসবুকে করোটা কী বলো তো। একটু ভাইরালও হতে পারো না? একটা কিছু করে ভাইরাল হলেই তো হয়। সবাই কী রকম ভাইরাল হচ্ছে।
আমি বলি, ভাইরাল তো হতে পারছি না। অন্য আইডিয়া দাও।
তাহলে, ফাউন্টেন পেন নামে একেটা ফেসবুক গ্রুপ খোলো। গ্রুপটাকে জনপ্র্রিয় করো। সে গ্রুপের এডমিন হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে যাও।
বন্ধু একে একে নানা আইডিয়া বলতে থাকে। আমি আর শুনি না। ধীরে ধীরে অন্যমনষ্ক হতে থাকি। এসব তো কিছুই সম্ভব না। তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী? লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে বনবাসে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই কি আর নেই? সামাজিক মাধ্যমে একটা কিছু করে না দেখাতে পারলে সমাজে লেখক হিসেবে পরিচিত হওয়ার আর কোনো উপায়ই আর তাহলে রইলো না? এ কোন ঘোর কলিকালে এসে ঠেকলাম।
শেষে নিজেই ভাবতে শুরু করলাম, আমাদের এই দুর্দশার কারণ কী?
১. আমরা জাতি হিসেবে পড়ুয়া নই। খুব কম লোকে বই পড়ে। বিদেশি সিনেমায় নাটকে দেখি লোকে মেট্রোতে উঠে কী সুন্দর বই পড়ে। এমনকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেলেও যাত্রা পথে পেপারব্যাক পড়তে থাকে। স্টেশনে বসে পড়ে, পার্কে বসে পড়ে। বিদেশে থাকা লোকদের কাছে শুনি, নাটক সিনেমার ঘটনাগুলো সত্যি। আসলেই সেখানে লোকে বাসে, ট্রামে, ট্রেনে প্রচুর পড়ে। আমাদের এখানে এমন হয় না কেন? একজনকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, আমাদের বাসগুলো কত নড়ে দেখেছেন। বসাই যায় না আবার বই পড়া। এই জ্যাম, এই গরমে, এই ভীড়ে বই পড়বেন কীভাবে?
আমাদের যানবাহনগুলো এত নড়ে কেন? এর সমাধান কী?
বিদেশে জনপ্রিয় বই লাখে লাকে বিক্রি হয়। কিন্তু সিরিয়াস বইগুলোও তো হাজারে হাজারে বিক্রি হয়। সমস্যাটা যানবাহনের। নড়ানড়ি করা যানবাহন না বদলানো পর্যন্ত অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে হয় না।
তাহলে যে বইগুলো হাজারে হাজারে বিক্রি হচ্ছে সেগুলো লোকে পড়ে কীভাবে? এক জন জবাব দিলো, পড়ে না। পড়ে না। সোশ্যাল মিডিয়ার আইকনদের বই কিনে লোকে সাজিয়ে রেখে দেয়। ভক্ত হিসেবে বই কেনে। তারপর আর পড়ে না। অমুক ভাইকে ভাল লাগে বলে বই কিনি। অমুক আপুকে ভাল লাগে বলে বই কিনি। থাকুক। পড়বোনে।
তারপরও কিছু তো পড়ে। অন্তত উপন্যাস পড়ে। নাকি একদমই পড়ে না?
২. লেখক-সাহিত্যিকদের সমাজে কোনো দাম নাই। তাদের কেউ দুই পয়সা দিয়ে পোছে না। সাহিত্যিক মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের নিয়ে কারো কোনে আগ্রহ থাকে না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনাননন্দ, হুমায়ূন আহমেদ, শরৎচন্দ্র সহ ১২ জন লেখকের বাইরে সমাজে কোনো লেখকের বই নিয়ে মানুষের আগ্রহ নেই। এর বাইরে সমাজে প্রচুর মানুষ লেখক হিসেবে বেশ খ্যাতি পান। কিন্তু এরা হলে বিভিন্ন আমলের দরবারি লেখক, বুদ্ধিজীবী। বিভিন্ন সরকারের দরকারে বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া, পুরস্কার, প্রকাশনা সংস্থা মিলে এদের তৈরি করে। প্রকাশিত হলে এদের বই বিক্রি হয় ১২ কপি। বাকি ১২০০ কেনে সরকার।
বাকি যে অদরবারি লেখকরা থাকেন তাদের না নেয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, না নেয় কোনো মিডিয়া। এরা না পায় কোনো পুরস্কার। বই কিনে লাইব্রেরিতে বিলোবার মতো কোনো হিল্লেও তাদের হয় না। ফলে, তাদের সাহিত্য জীবন মৃত্যুর আগে কোনো রফা সমাজে করতে পারে না।
৩. আমাদের লেখকদের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল প্রবল। তিনজন লেখকের সাতটা উপদল। দরবারি লেখক হতে পারছে না। ফেসবুকে ভাইরাল হতে পারছে না। বই বিকোচ্ছে সাকুল্যে তিনশো। কিন্তু আত্মগর্বে দিনে সাতবার অমর হচ্ছে। গুণলে দেখা যাবে, লিখছে মোটে কুড়ি জন। কিন্তু কারো মুখে শুনলে দেখা যাবে, তিনি একাই জীবিত ৫০ জনকে বাতিল করে দিচ্ছেন। যত জনকে বাতিল করে দিচ্ছেন ততো লেখকই নেই। তো ভাই, আপনি যদি আপনার পাশের জনকে স্বীকার না করেন তবে আপনি মরলে মুখে আগুন কি মঙ্গলগ্র্রহ থেকে এসে কেউ দেবে। আপনি যদি পাশের জনকে লেখক না মনে করেন তবে আপনার জানাজা পড়িয়ে ফেসবুকে এক লাইনের শোকটা কী কবর থেকে উঠে এসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখবেন?
আমাদের লেখকরা ভাবেন তারা একেকজন মার্কেজ, বাকিরা ফেলনা। আরেকজন আবার তাকেই ফেলনা ভাবেন। এই করে করে সবাই মিলে সমাজের সামনে ফেলনা। অবশ্য, মার্কেজও কেউ কেউ তাদের ভাবেন। একেবারে কাছের যারা। যাদের পাতে তিনি মুলোটা আলুটা তুলে দিতে পারেন। ফলে, বেসরকারি লেখকরা সমাজে কোনো গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী হয়ে উঠতে পারছে না।
৪. আমাদের মিডিয়া একেবারে বইবিরোধী। ৩৬টা টিভি চ্যানেলের কোথাও বই নিয়ে একটা অনুষ্ঠান হয় না। সাড়ে তিনশো পত্রিকার কোথাও লেখকদের খবর ছাপাবার জায়গা নেই। সাহিত্য পাতাগুলোর বেশির ভাগ বুঝতেই পারে না কে, লেখক আর কে অলেখক। বিদেশি পত্রিকায় দেখি লেখকদের বইয়ের খবর। লেখার খবর। বই নিয়ে আলোচনা। সাক্ষাৎকার। আরও কতকিছু। আমাদের এখানে সেসবের বালাই নেই। নিয়মিত কিছুই নেই। গল্প-কবিতা ছাপার যে রেওয়াজ ছিল তাও উঠে যাচ্ছে। সাক্ষাৎকার পারলে কবর থেকে উঠিয়ে মরা লেখকের ছাপবে। কিন্তু জ্যান্ত লেখক অচ্ছুৎ। সোশ্যাল মিডিয়ায়, ইউটিউবে, ওয়েবজিনেও কোনো শক্তিশালী উদ্যোগ নেই। কিছু দেখে যে মানুষ বুঝবে এখানে সাহিত্য এই সাহিত্য তার কোনো উপায় নেই। পাঠককে বুঝতে হবে গবেষণা করে। ঠেকে শিখে তবে লেখক চিনতে হবে। পাঠকের হাতে লেখক ধরিয়ে দেবার জন্য কোনো মধ্যস্থতাকারী নেই। এরকম কত কারণ নিয়েই তো ভাবছি। ভাবলে আপনারা আরও ভাল কারণ বের করতে পারবেন। কিন্তু সমাধান কী? আমাদের দেশে সবাই কি হুজ্জতে বাঙ্গাল। ভাইরালের ক্রেতা?
সাহিত্যের পাঠক কি তিনশোই? বাসে না থাকুক ঘরে বসে বই পড়ার লোকও কি নেই? ওয়াজ না করলে বা মোটিভেশনাল বক্তব্য না দিলে কি বই বিক্রি হবেই না? এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা করলাম। শেষ পর্যন্ত দেখলাম, সমস্যাটা মূলত যোগাযোগের।
এদেশে প্রচুর পাঠক আছে। সিরিয়াস সাহিত্যের বইও হাজার হাজার বিক্রি হতে পারে। অন্তত হাজার খানেক তো অনায়াসে হতে পারে। কিন্তু সেই পাঠককে লেখক চেনে না। লেখককেও সে পাঠক চেনে না। সাহিত্যের পাঠক অনন্ত লাখ পাঁচেক আছে। এই পাঠক ও এই লেখকদের কোনো প্লাটফর্ম নেই। যোগাযোগের সেতু নেই। সেতুটা কেউ বানাবে সে উদ্যোগও নেই। ফলে, লেখকদের ইংরেজি শেখার বইয়ের বিক্রি দেখেও হাহুতাশ করতে হচ্ছে। হুজুরের বইয়ের বিক্রি দেখেও হাহুতাশ করতে হচ্ছে। জাত রাখার আর কোনো উপায়ই আর থাকছে না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী