শশী হকের গদ্য ‘দ্বিতীয় গন্দমের দুনিয়া থেকে’

প্রকাশিত : জুন ২৯, ২০২০

এই ক্রান্তিকাল যেন অজানা ধোঁয়ার মতো ছেয়ে ফেলছে আমাদের। করোনা-ভয়ের তীব্র স্থবিরতার ভিতর যখন মাস্ক-গ্লাভস পরে আমি বাইরে বেরই, আমি আমাদের পরিচিত দুনিয়াটাকে আর চিনতে পারি না। এখানকার সবাই, সবকিছুই, যেন অজস্র বোবা প্রশ্নের রূদ্ধতায় ডুবে আছে। ব্যাপারটা এমন যে, যেন হুট করে সেই পৃথিবী (Earth, Gaia), যাকে আমরা হারায়ে ফেলেছি বহু আগে, তার একটা অদ্ভুত বন্যতা নিয়ে ঢুকে পড়েছে আমাদের দুনিয়ার (World) ভিতর আর আমরা বুঝতে পারছি না, কী ঘটছে।

সেই পৃথিবী একসময় আমরা হারিয়ে ফেলেছি; যা ছিল সর্বজনীন— সকল প্রাণ, সকল বস্তু আর সকল মানুষের। এবং তখন, সেই ফাঁকার ওপর, অসংখ্য কাহিনির জন্ম দিয়ে তৈরি হলো আজকের এই দুনিয়া, এই চোখ ধাঁধানো ঝকমারি দুনিয়া। পৃথিবী আমাদের কাছে এখন শুধু একটা ভূপৃষ্ঠ, কাঁচামাল, কিংবা ময়লার ভাগাড়। কিন্তু পৃথিবী তো তা না। পৃথিবী তো মাতা। বিপুল এক তরংগের মহামাতা। আমরা সেই মৌলিক ভাবটাকে একসময় চাপা দিয়েছি, আর বিচ্ছিন্ন থেকেছি মূল স্রোত থেকে। আর তাই, সেই স্রোতের বাস্তবতার একটা হাওয়া যখন ঢুকে পড়ল আমাদের সাজানো দুনিয়ায়, এবং বন্য হাতির মতো যাকে আমরা পিটিয়ে মারতে পারছি না, তখন সেই অক্ষমতা অদ্ভুত এক অপেক্ষার ভিতর ক্রমাগত ক্রুদ্ধ আর ভীরু করে তুলতে থাকে আমাদের।

স্ক্রিনভরা শুধু মৃত্যু-খবর, কারণ তারা মানুষ। কারণ তারা বিশেষ মানুষ এবং যে কোনো জায়গার মানুষ। এই করোনা ভাইরাস এমন এক বন্যতা, যা জায়গা বোঝে না, ধর্ম বোঝে না, এবং যার কোনো দেশ নাই। এই ভাইরাসটা যেন এলিয়েন, কোনো এক টাইম-হোলের ভিতর দিয়ে ঢুকে পড়েছে আমাদের সময়ে।

ইদানীং আমি, প্রায়ই, আদম-হাওয়া আর গন্দম (বোধি/জ্ঞান ফল) বিষয়ক অই সেমেটিক মিথটার ছলনা নিয়া ভাবি (সৃষ্টির পথ ছলনাই বটে)। তারপরও যখন দেখি, আমরা আর আমাদের আদি পিতা-মাতাদের সেই সর্বজনীন পৃথিবীতে নাই, আছি এমন এক দুনিয়ায় যা শুধু মানুষের। পৃথিবী যেন এখানে ঢেকে আছে অজস্র জ্ঞান-চাদরে, আলোর ইলিউশানে; আর ঝলসে কানার মতো মানুষেরা শুধু ভাবতে আছে, এই তো বিকাশ, এই তো শ্রেষ্ঠত্ব। তখন কেন জানি প্রশ্ন জাগে, ঈশ্বরের ইশারা না বুঝে আমরা কী তবে দ্বিতীয় কোনো গন্দম খেয়ে ফেলেছি? হ্যাঁ, অনেক ভেবে আমার মনে হয়েছে, সম্ভবত তা কোনো একসময় আমরা খেয়ে ফেলেছি। আর তা যদি না খেতাম, তাহলে তো এই পৃথিবীটাই আরেক স্বর্গ হয়ে উঠতে পারতো। গন্দমের জ্ঞানে কিন্তু সেই সক্ষমতা ছিল, সেই চেতনা ছিল।

অন্যদিকে শাপ বরে পরিণত হতে পারার প্রতিশ্রুতিও তো কম ছিল না। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে আমরা তা পারি নাই, দ্বিতীয় কোন গন্দম খেয়ে টেকনোলজির শক্তিখেকো (energy based) এক দুনিয়ার দিকে পা বাড়ালাম, যেখানে রাজত্ব শুধু শক্তির। তাই আরো শক্তির লোভে মানুশ একসময় মাটি খুঁড়ে তেল-গ্যাস-কয়লা পোড়াল, বিষ ছড়াল, আর বন সাফ করে একে একে তৈরি হতে থাকল নগর থেকে মহানগর। নষ্ট হয়ে গেল পৃথিবীর পরিবেশ আর সাথে সাথে নিজের মতো করে সবার বাঁচার অধিকার। ধোঁয়াটে এই স্বার্থপর দুনিয়া, যা এতদিন না-মানুষদের টুটি চেপে রেখেছে, আজ সে তো তার মানুষদের নিয়ে নিজেই নিজের হুমকি— এই ভাবনাটাই যেন আজ সবার মনে ঘুরেফিরে জাগতেছে, এবং আমি যতই সেটা শুনি, মনোযোগী হই।

বৈদিক সত্য যুগের ইতিহাস থেকে সেদিন `কর্ম` শব্দটার নতুন এক অর্থ জানলাম। সেখানে কর্ম আবিষ্কারের বিষয়, এবং কর্মই জ্ঞানের জনক; আর বেদ হচ্ছে, কর্মান্তে যে জ্ঞান উপলব্ধির অভিজ্ঞতায় জমা পড়ে, শুধু তাই। কর্ম ছিল তপস্যা, পৃথিবী-বাস্তবতা, তার সময় আর তার ইচ্ছার মধ্যে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে পারার বিকাশ। কর্মই নিরন্তর প্রবাহ, কর্ম থেমে গেলে সময় থেমে যায়, জ্ঞান থেমে যায়। দ্বিধা নাই, অসাধারণ এক চিন্তা, অথচ এখনকার বিচারে আজগুবি। কারণ আমরা আসলে সেই কর্ম-প্রবাহ একসময় হারিয়ে ফেলেছি। এখন `কর্ম` নাই, `বেদ` নাই, দেখা নাই, শুধু শোনা আছে। এখন শুধু জ্ঞান থেকে জ্ঞানের জন্ম হয়, জ্ঞান কুক্ষিত হয়, বিক্রিত হয়, পণ্য (technology) হয়। আমরা তাই প্রথমে জ্ঞান শিক্ষা নেই, তারপর সেই মতে কর্ম করি, যা আসলে কর্ম নয়, মোট টানা। জ্ঞান আর শ্রম দুই-ই বিভাজিত হতে হতে এখন এমন অবস্থা যে, আমরা আমাদের জীবনধারনের (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ যাবতীয়) সব সমস্যার জন্য নির্ভর করে থাকি অন্যের ওপর— হতে পারে সে কোনো উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান বা বিশেষজ্ঞ ব্যাক্তি, বা রেডিমেড কোনো ম্যানুয়েল।

আসলে পুঁজি আর শক্তির উত্থানের সাথে সাথে, মার্ক্স মতে, এই দুনিয়ায়, "অনেক বেশী-বেশী দরকারী (useful) জিনিশ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে অনেক অদরকারী (useless) মানুশের উদ্ভব ঘটেছে।"

এখানে আমাদের অজান্তেই শ্লথ হয়ে গেছে সময়, আর দুনিয়াদারি বিশাল এক জ্ঞান-রাবারের অজস্র সুতার মতো বিপুল টানে শুধু লম্বা হতেছে। কিন্তু পৃথিবীর জীবন তো তরংগ। যেখান থেকে আমাদের সময় শ্লথ হয়ে গিয়েছিল, পৃথিবী তাই সেখান থেকে এগিয়ে গেছে অনেক। আর সে কারনেই ধীরে ধীরে আমাদের সাথে তার একটা বিশাল টাইম-গ্যাপ তৈরি হয়েছে। আমাদের পক্ষে হয়ত তাই এখন আর সেই একই পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়, এবং সম্ভবত আমরা খেয়ে ফেলেছি কোন দ্বিতীয় গন্দম।

কিন্তু এই দ্বিতীয় গন্ধমের ইশারা ত ছিল? আমরা বুঝি নাই, বুঝতে চাই নাই, কেন ঈশ্বর তার বিমূর্ত সত্যসূত্রগুলি আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখে শুধু রূপসম্ভারকে সামনে এনেছেন। আমরা টের পাই নাই আমাদের দেহে বিবর্তনের যে জেনেটিক নির্দেশ (আলেকের বিধান), তার মর্মকথা, তার গভীর আকুতি। এই নির্দেশনা কখনই সুপ্ত সত্যকে (hidden truth) ধারনে রাখে না, বরং তাকে ঢাকতে চায়। এবং যা অবিরত বলে যাচ্ছে, বোঝ, মইজ না, যোগ্য হয়, শুধু যোগ্য হতে থাক। আর এখন, এই করোনা-ভাইরাস এসে আমাদের বুঝায়ে দিল, যোগ্যতা কী জিনিশ!

রুদ্ধশ্বাস এক পরিস্থিতির ভিতর, আফ্রিকান দার্শনিক আশিল এমবেম্বে, আমার মনে হয় সবচেয়ে খাঁটি কথাটা বলে ফেলেছেন এই সময়ের। তিনি সকল প্রাণের `শ্বাস নেয়ার নিরন্তর আর সর্বজনীন অধিকারের` প্রশ্ন তুলেছেন, যা এই দুনিয়া এতকাল অস্বীকার করে এসেছে। অথচ তার মতে, সেটাই ছিল অস্তিত্বের মৌলিক অধিকার (Originary right), যা এক মহান সার্বভৌমত্ব। আলাদা ভাবে শ্বাস নিয়ে আলাদা বাতাসে মানুষের বাঁচতে চাওয়াটা তাই বোকামি। পৃথিবী, যে সবের মাতা (Gaia), সে তো আর সেটা বেশি দিন হতে দিতে পারে না। তাই ভাবি, এই হেল্পলেস করোনা-ক্রাইসিসের পর, শ্বাশত শ্বাসের মর্ম তারপরও কি মানুষ না বুঝে থাকতে পারবে? কত দিন? কত বছর?