শামীম রেজা

শামীম রেজা

শামীম রেজার কবিতায় অনুসন্ধানধর্মী ও সংশ্লেষণাত্মক পর্যটন

হেমায়েত উল্লাহ ইমন

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২৪

পুরাণ-ইতিহাস-ঐতিহ্য-মিথ-নদী ও চলতি ভাষার ভাঙনের মাধ্যমে শামীম রেজাকে তার কবিতার মাধ্যকে নব্বই দশকের অন্যান্য কবিদের থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। তার কবিতায় প্রধান শক্তিরূপে তাগিদহীন বুনন থাকে। এই বুনন তার নিজস্ব সুর। কবির ব্যক্তিগত গন্ধম । উত্তরসূরীদের আলোছায়া কিংবা চিরায়িত শৈলীতে এই সুর জমাট বাঁধতে চায় না। আবার তাকে নতুনত্ব তৈরির কসরতও করতে হয় না। লৌকিক ধর্মের আবেদন, সহজ সুরের আনমনা ভঙ্গি, ভাটিয়ালি কিংবা মাঝিমাল্লাদের উন্নাসিক সুরের আবেদন ধরতেই তিনি চলতি ভাষায় ক্রিয়াপদ ভেঙে দেন। ভেঙে যাওয়া শূন্যস্থানে টেনে নেন পাঠকের নাতিশীতোষ্ণ হৃদয়কে।

কবির বাল্যবন্ধু বিষখালী নদী, পরিণত বয়েসে ফেলে দেয় জানা-অজানা ভূগোলহীন নদীস্রোতে। এসব নদীর হাওয়া-জল-কলতান-কল্লোল পরিণত কবিকে ‘মানবিক’ প্রশ্নে জর্জরিত করে। বৈশ্বিক রাজনীতিতে তার কবিতা মানবিকতার জয়গান করে পুরাণ-ইতিহাস-ঐতিহ্যের রেফারেন্স টেনে। কবি নদী ও নারীকে ভূগোল করেছেন তার কবিতায়। আর ঈশ্বরকে দিয়েছেন অবিরাম মুক্তি, কবিতার ফানাফিল্লা বা বাকাবিল্লাহর পুরোটাই জুড়ে আছে মানবিক প্রেম, বিবেকের প্রতি সমর্পণ। বিবেকের এই বোঝাপড়ার বয়সটা ঠিক কত? এ প্রশ্নে তিনি সূক্ষ্ম গণিতের চেয়ে পাঠককে ইতিহাসের দিকে ঠেলে দেন।

আবার ইতিহাসের ঠিক-বেঠিকে কবি আটকে থাকেন না। শুধুমাত্র ইতিহাসের পরিচিত শব্দের প্রতীতীটুকু দেন কবিতার মানসপটে। কবি ধর্মের চেয়ে বেশি পুরাণ আশ্রয়ী। পুরাণের অনুষঙ্গ ধরে তিনি ফিরে যান ভারতবর্ষের পৌরাণিক সব চরিত্রে, বিষয়ে, স্থানে। আবার এরই সিলসিলা ধরে সেন-পাল-মুঘল ও ইংরেজদের কাছে আসেন। কবিতায় তিনি অনেক প্রশ্ন রাখেন, প্রশ্ন হাতে তিনি অর্জুন। প্রতিটা প্রশ্ন পাঠককে রাষ্ট্রিক-সামাজিক-রাজনীতিক অবস্থানে বিদ্ধ করে। তিনি নরম কথায় বিবেকের সামনে বাস্তবের নির্মমতা বুঝতে চান। তিনি সবথেকে বড় পরিসরে যে প্রশ্নটি করেন, সেটি আত্ম পরিচয়ের প্রশ্ন। শুধু তিনি নিজের আত্মানুসন্ধান করেন না।

দেশহীন মানুষের দেশ, প্যারিসের রাস্তায় সিরীয় যুবতী কিংবা পাসপোর্টে লেখা ঠিকানা— এসব বৈশ্বিক প্রশ্ন কবিতায় নিয়ে আসেন। এক্ষেত্রে কবিতায় তার রাজনৈতিক অবস্থান বা প্রজ্ঞা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আবারো আমরা দেখতে পাব তিনি মানবিকতার কথা বলেন, মানুষকে সবার ওপরে স্থান দেন। ঈশ্বর বা পরমাত্মা মুখোমুখি হয়ে তিনি প্রাপ্তির আশা করেন, অমরত্বের চেয়ে তিনি মানব হৃদয় ও বিবেককে চিরকালীন স্থান দিতে চান।

শেষরাতে শাঁখাভাঙা গোঙানিতে বধু
ফিরে পেল নাগরের পাখিসুর
সর্পনী মেঘ
এভাবে ফেলছে গিলে চিরচেনা চাঁদের শরীর
                                 পরানী ও মথুরার মাঠ

নাগরের পাখিসুর মনে করিয়ে দেয় বৈষ্ণব কবিদের কথা। বিরহই যাদের সম্বল, রস ও আশ্রয়। কবি এখানে বৈষ্ণবদের এ বিরহ-ব্যথায় বধুকে সান্ত্বনা দিতে হাজির করেন প্রকৃতির স্বভাবকে। কিন্তু এই প্রকৃতি কবির কাছে কোনো রহস্যের বস্তু নয়। চিরচেনা অধিবিদ্যার সংজ্ঞায় তিনি বিশ্বাসী নন। লোকপুরাণের মনসা চরিত্রতেই তিনি বশ হয়ে যেতে চান, বিম্বিত বাস্তবতাকে মানতে চান না, পৌরাণিক সত্যই তার কাছে সত্যরূপে হাজির হয়।
 
এ কী বিভ্রম দেখি?
মেয়েটি নালন্দা থেকে
নীলাচল আঁচল খুলে
নিজেই নদী হয়ে ঢেউ তুলে…
                     নালন্দা মেয়ের পুরাণ

পরাবাস্তবতার রাস্তায় কবি শামীম রেজা হেঁটেছেন একান্তই নিজস্ব স্বকীয়তায়। ইতিহাসে তিনি প্রেমিক। তাজমহলের প্রেম উৎরিয়ে আরও পিছনে, আরও আদিম আঁচলের সুবাসে সুবাসিত হন। নালন্দার রাস্তায় তিনি ইতিহাসবিদ হয়ে দাঁড়ান না, নিভৃতচারীও নন। তিনি প্রেমিক হিসেবেই দাঁড়ান। কারণ নিজস্ব এই ইতিহাসকে মধুরভাবে আলিঙ্গন করতে চান তিনি। প্রশ্ন উঠতে পারে, ইতিহাসের রাজনীতি সম্পর্কে কবি সচেতন কিনা? ইতিহাসের সত্য নাকি পৌরাণিক বিলম্বিত সত্য? শামীম রেজা ইতিহাসের পক্ষের লোক। কিন্তু ইতিহাস পাঠে সত্যান্বেষী নন, তাই পুরাণকে আশ্রয় করেন হয়তো।

…আহা জনপদ! রাত্তিরের পর রাত্তির যায় যার ঊষার খোঁজে; কবে নামবে ভোর চারিদিকে আন্ধার কবর? শশাঙ্ক পাল কত কত সেন সুলতান আর মুঘল সিরাজ এরা কস্তুরী রক্ত শুষেছে দুগ্ধবতী মায়ের শরীরে আমার। একদিন নৃত্যরতা পটুয়া-চিত্র শোভিত নীলগাই এঁকেছিল ট্রয়ের রাজসভায়, বাহবা মিলেছিল যার; আমি জানি, সেই একমাত্র আত্মীয় আমার। … এখন উপনিবেশ নাই, তবু নতুন শিকারীর থাবায় কেন প্রাণপাখি ঝলসায়? যখন রাত্রি নাইমা আসে সূবর্ণ নগরে ২৩

কবি কী ইতিহাসে নিজের অবস্থান নির্ণয় করতে চায়? কার সাপেক্ষে কবির এই অবস্থান?  হাজার বছরের উপনিবেশ অন্ধকারে চাপা পড়া নিজস্বতা খোঁজার লড়াই কিংবা বলতে পারি অস্তিত্বের তদন্ত এসব কবিতা। কবিতায় তিনি সমসাময়িক সংকটকে বুঝতে চান ইতিহাস দিয়ে, সংকট মিলিয়ে নিতে চান প্রকৃতির সহজাত বৈশিষ্ট্যে। ইতিহাসকে তিনি শুধু প্রশ্ন করেন না, প্রশ্ন খোঁজেন, প্রশ্ন তোলেন। প্রশ্নবাণে যেমন বলেছিলাম তিনি অর্জুন। বলা যায়, কবিতায় তিনি অনুসন্ধানধর্মী ও সংশ্লেষণাত্মক।

শামীম রেজার কবিতার শিরা-উপশিরায় নদী বয়ে যায়। এসব নদীর বেশিরভাগেরই ভূগোল নেই। কোনোকালের মানচিত্রেই হয়তো তাদের পাওয়া যাবে না । সঞ্জীব চৌধুরীর গানে যেমন প্রশ্ন করে ‘সমুদ্র কী তোমার সন্তান?’ তেমনি শামীম রেজার কবিতাকে বা কবি শামীম রেজাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে জাগে, ‘নদী কী তোমার সন্তান?’ তার প্রথম দিককার কবিতা থেকে শুরু করে সমসাময়িক সব কবিতায় সচেতন-অবচেতনে নদী, নদীর প্রসঙ্গ-প্রাসঙ্গিকতা চলে আসে। শামীম রেজার জন্ম ঝালকাঠীর রাজাপুরে; বিষখালী বুকে চিৎ হয়ে, উপুড় হয়ে শুয়ে শৈশব কৈশোর কাটিয়েছেন। নদীর সন্তানই তিনি।

বকের ঠোঁটে কাছে ফাঁদ নিয়ে কিংবা গোসলরত যুবতীর ইশারায় ডুবেছেন শত-শত বার। জীবন ঘনিষ্ঠ অভিঘাত কিংবা অভিব্যক্তি হয়তো শুনাতো বাপের ভিটার কাছে ভাসতে থাকা বিষখালীকে। পরিণত বয়েসে এই বহমানতাই তিনি লালন করছেন, গতি দিয়েছেন কবিতায়, শূন্যতা পূরণ করেছেন নিজস্ব নির্মিত শত-শত বিষখালীতে।

…কি তামাশার খেয়ালে প্রভু নদীর জলে শ্যাওলা বানালেন?
... প্রভু এদের সদৃশ কি শুধুই নিঝুম নদী বানালেন?
…কেউ বিষখালী আবার কেউবা কীর্তনখোলা নদী
                                                     নদী ও আমরা

শামীম রেজা জগৎকে বুঝতে চান লৌকিক-অলৌকিক দ্বন্দ্বের পরিসীমায় । নদী তার কাছে আপন অস্তিত্বের মতোই পবিত্র, কেননা নিজের বয়েসের সাথে নদীগুলোর কাবুকাবু-হৃদয়ে মিলিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে; অভিজ্ঞতার ভারে।  স্মৃতির দুয়ারে শ্যাওলার অস্পষ্টতা তাকে পীড়া দেয়, তাই বিষখালী-কীর্তনখোলাকে ব্যক্তির মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করেন। গুরুত্বপূর্ণহীন করে তোলে শ্যাওলার আস্তরণ কিংবা নদীর সবিশেষ নিঝুমতা। কবি-প্রভু-নদী সমরেখ হয়ে যায় স্মৃতির গ্রাফে।

মৃতদের পাঁজরের দাঁড়টানা বাতাসে কীর্তনীয়া নদী কীর্তনখোলায় ওঠে উত্তাল ঢেউ... আর গুণটানো কত শত কঙ্কালের হাড় অসীমের সাথে ঘর বান্ধে কীর্তনীয়া কোন জন? আমি কি কীর্তনিয়া নদী কীর্তনখোলা যিনি প্রতিদিন পায় ভাঙনের হাজারটা সমন? (কীর্তনীয়া নদী কীর্তনখোলা)

তিনি কীর্তন খোলার উত্তাল ঢেউয়ে কাছে অস্ত্বিত্বের প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়ান। পূর্বপুরুষের পাঁজরে শাসকের ঘাত-প্রতিঘাতের নির্মমতার সাথে তার ভাঙনের মিল খুঁজে দেখতে চান।  এরকম স্নিগ্ধ শ্যামল দেশে এত উত্তাল কিসের বহিঃপ্রকাশ? তাহলে কী সময়ের বদল হচ্ছে কেবল যুগ যুগ ধরে যে লুণ্ঠন, পীড়ন চলে আসছে, তা চলছেই। তাতে কীর্তনখোলার সাথে তিনিও পিষ্টে যাচ্ছেন অবধারিতভাবেই।

শান্তিয়ানো নদীর পাশে ঘুরে ঘুরে ঘুঘুপথ বাঁক নেয় দূর-অজানায়, আমি ভোরের কুঁছনায় কতটা কাঁঠালি চিংড়ি বেঁধেছে-আর কতটা বা বুঁইছা মাছ তা দেখার কৌতূহলে মেহগনি বনের ধারে চুপ হয়ে বসি, বসে থাকি যোজন-যোজন বছর অফুরন্ত মহাকালের পারে; (শান্তিয়ানো নদীটি দেখিনি কোনদিন)

শান্তিয়ানো নদী কবির নিজস্ব কল্পনাপ্রসূত নদী।  মানসপটে এই মানচিত্র আমাদের কাছে এক্কেবারেই অপরিচিত নয়। কাঁঠালি চিংড়ি, বুঁইছা মাছ ও মেহগনি বন এগুলো দৃশত বাস্তবতাই। কিন্তু কবি বাস্তবের উজানে দাঁড়িয়ে আরেকটি নিমজ্জিত-বাস্তবতা তৈরি করেন। যে ভূবন মায়া-ছায়ায় লীলারত তার সন্ধিকোঠরে। এখান থেকে কবির ‘কালযাত্রা’ও বুঝে নেওয়া যায়। তিনি যখন পিছনে ফিরে তাকান সভ্যতার শুরু থেকে তেমনি মহাকালের মতো যৌবন ধরে রাখতে চান। মহাকালের যাত্রায় তিনি হিমালয়ের উষ্ণতায় আলিঙ্গন করতে চান মানব-মানবীর সমস্ত অভিঘাত। তার পুঁজি হিসেবে আছে নদীর ভূগোলহীনতা-কূলহীনতা।

শামীম রেজা তার কবিতায় বাঁক-বদল করেছেন পরিণত বয়েসে। উপাদানের যোগ-বিয়োগ করেছেন কিন্তু অনুষঙ্গ ছাড়েননি। সমকালকে ধরতে চেয়েছেন শক্তভাবে। সমকাল তাকে আঘাত করে, বৈশ্বিক নানাবিধ সংকট-দ্বন্দ্ব তাকে নাড়া দেয়। তিনি সিরীয় যুবতীর নগ্ন মুখে চেয়ে শরণার্থী সংকট, কাঁটাতারকে কবিতায় প্রাসঙ্গিক করেন। রাজনৈতিক ভাবে তিনি সোচ্চার হয়ে ওঠেন। সমাধানের প্রশ্নে তিনি বরাবরের মতোই সিদ্ধান্তে পৌঁছান না; প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। কবিতায় তিনি এক্টিভিজম করেন, সচেতনভাবেই। উদ্দেশ্য প্রণীত হয়ে যায় কিনা বা শেষ পর্যন্ত কবিতা হয় কিনা এসব প্রশ্ন থেকেই যায়। কিন্তু কবির জার্নির সাথে পরিচিত না হলে তার নিজস্ব পরম্পরা বুঝতে না পারলে তাকে পাঠ করা মুশকিল হয়ে যাবে।

সমকালীন সংকট, দ্বন্দ্ব, প্রতিকূলতা সাথে তিনি এখানেও মানবিকতার সুরকে সঙ্গ করেছেন। ভালোবাসা, মানবিকতা বোধ এসব এখানার কবিতায় আরও প্রবল। তার বোধ পরিমিত হয় অভিঘাত পেরিয়ে মানবিক আবেদনে। অভিব্যক্তি প্রবণ কবি তার তরুণ-কবিতাগুলোতে করুণ-রসে যে রমণ করতে চেয়েছেন তা সমকালের এসে স্পষ্ট  হতে থাকে। প্রকৃতি, প্রভুকে বাদ দিয়ে ‘মানুষ-প্রকৃতি’ বুঝতে চেয়েছেন নতুন করে। ইতিহাসের গড়মিলের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে তিনি শত-শত মানবিক প্রশ্ন রেখেছেন। এখানে তিনি অর্জুনের তীক্ষ্ণতার সাথে ভীমের শক্তিকে সংযোগ করেছেন; কোথাও আবার উনি ইতিহাসের প্রতিনায়কদের দলে গিয়ে নায়কদের নিয়ে ঠাট্টা করেছেন।

যেমন দেখেছি কাল ইয়েমেন, রামাল্লায়
ফোরাতে আর সিরিয়ায়
মৃত মায়ের স্তনে শিশু দুধ টানে

পারাপারের সীমানা ভুইলা
ইমিগ্রেশন দাঁড়াই,
লিখি আমার পরিচয়, জন্ম পরিচয়?
ধর্ম পরিচয়?
              পার্সপোটে লেখা ঠিকানা

তিনি ক্ষমতা বিন্যাসের রাজনীতিতে সর্বজনীন বয়ান উপেক্ষা করে মৌলিকত্ব ও নিজস্বতা বুঝতে চেয়েছেন। কবিতা তাই শেষ পর্যন্ত পাঠকে জড়িয়ে ধরে। চরম বাস্তবতায় ঠেলে দেয়। পৌরণিক সত্য সমকালের চিন্তায় আর জায়গা পায় না। তিনি অভ্যন্তরীণ পলিটিক্স বা পলিটিক্যাল কারেক্টনেসগুলোতে পাঠককে দাঁড় করে মৌনতার ব্রত নেন। পাঠককে ধাক্কা দেওয়ার চেয়ে তিনি সম্মুখীনে অধিক বিশ্বাসী। তরুণ কবিতায় তিনি যেমন আত্মানুন্ধানে মগ্ন ছিলেন, সমকালে তা বিশ্বের প্রতিটি মানব-মানবীর আত্ম পরিচয়ের সংকটে যুক্ত করেছেন। সংকটের গভীরতায় নিয়ে যেতে চান পাঠককে। পাঠক হয়তো কবিতার কসরতের চেয়ে সমকালের ভূ-রাজনীতিতে তলিয়ে যাবে। কবি কবিতার হয়ে উঠার দিকে মনোযোগের চেয়ে পালাগানের সুরে সুরে তার কাব্য গেঁথে যান বাস্তবতার তৃতীয় স্তরে।

দাস জাহাজের খোলে তাজা রক্তের উষ্ণতা দোলে
কুমারী নদীর দেহ ছিবড়ে খাচ্ছে বর্মী হায়েনা শকুন
                                                   চোখে দেশ নেই

কবি ইতিহাসের এক সময়ের সাথে আরেক সময়ের, এক ঘটনার সাথে আরেক ঘটনার সংশ্লেষ করে নেন সহজে। দাসপ্রথা ও রোহিঙ্গা সংযোগ করেছেন নদীকে আশ্রয় করে। তিনি মূলত ইতিহাসের পরম্পরায় বিশ্বাসী। বিবিধ ঘটনার সূত্রপাত তিনি ইতিহাসে খুঁজে নিতে পারেন, হাজার বছরের মানবিকতার বিভৎস রূপের সাথে সমকালের সংযোগ ঘটান। এখানেই কবির প্রজ্ঞা উজ্জ্বল। কবিতার জৌলুস।

শামীম রেজার কবিতায় মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতবর্ষের আদিমতম সত্তা। গৌতম বুদ্ধের দর্শন, নাগার্জুনের মধ্যপন্থা, লালন, বাউল-ফকিরের রক্তের স্রোত শামীম রেজা চিনতে পেরেছেন, কবিতায়ও জায়গা দিতে পেরেছেন। এ কারণে হয়তো কবিতার হাত-পা অর্থাৎ দৈহিক সৌন্দর্যে তিনি অমনোযোগী ছিলেন; কেবল কবিতার মন ও মগজে সম্পূর্ণভাবে সমর্পিত হয়েছেন।

কবিতায় তিনি দর্শনের চেয়ে দৃষ্টিভঙ্গি আনতে স্বাছন্দ্যবোধ করেন। অন্যের কথা, অন্যের রাস্তায় তিনি হাঁটতে চান না। আত্মকেন্দ্রিক মন বাস্তবতায় জায়গা না পেলে স্মৃতি-কম্পনের ডুবে অনুরাগী-বাস্তবতা তৈরি  করে। সেখানে পরিচিত ভূগোল, আবেগ-অনুভূতি, বোধ সবই থাকে। কিন্তু ইতিহাস,পুরাণ, মিথের পাঠ পাল্টে যায়। সম্মুখীন করেন সত্য ও অসত্যের। প্রশ্ন তোলেন প্রসারণের, সংকোচন করতে চান কাল-মহাকাল সময় ক্ষেপণ।

নদী ও নারী অনিবার্যতা পায় পঙক্তিতে; ভাগবাটোয়ারাই তিনি নদীর পাল্লা ভারী রাখেন আর নারীকে অগণিত সমাধানহীন প্রশ্নের মৌসুম চেনান । সভ্যতার অসভ্য সুলভ আচরণে তার নিন্দ্রা ভঙ্গ হলে- দায়ী করেন মানব-মানবীকে। ভালোবাসার জয়গানে তিনি বিশ্বাসী, তার কাছে মগজের চেয়ে হৃদয় মূল্যবান।

আলোচক পরিচিতি: পড়াশোনা করছেন তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা, গল্প ও চিত্রনাট্য লেখার প্রতি ঝোঁক আছে। যেসকল গল্প শব্দে আটকায় না সেগুলোকে তিনি চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এখনও মৌলিক বই প্রকাশিত হয়নি। তবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়েছেন, বানাচ্ছেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতির তাত্ত্বিক দিক নিয়ে কাজ করতে স্বাছন্দ্যবোধ করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি `বাংলা ট্রিবিউন` পত্রিকার সাহিত্য পাতায় সহসম্পাদক ও কাগজ প্রকাশনে কর্মরত আছেন।