এস এম সুলতান

এস এম সুলতান

শামীমা জামানের আত্মগদ্য ‘আমার সুলতান দর্শন’

প্রকাশিত : আগস্ট ১১, ২০২০

খুব ছোটবেলা থেকেই আমি বাজারে যেতাম। বাজার মানে মাছের বাজার, শাকসব্জি তরিতরকারির বাজার। রোজ সকালে নাস্তা করে মহাসমারোহে বাজারে যাওয়া ছিল আব্বার রোজকার রুটিন। আব্বার পিছে পিছে থাকতো তার অফিস সহকারী বুড়ামিয়া আশরাফ ভাই। আশরাফ ভাইয়ের ঘাড়ে আমি। আমাকে নেয়াই লাগতো। কোনও কিছু কেনার চেয়ে মানুষ দেখতেই ভালো লাগতো আমার। কত রকমের মানুষ। কালো মানুষ, ফর্সা মানুষ, ঘামে ভেজা গন্ধঅলা মানুষ, পান চিবানো মানুষ। ভুঁড়িঅলা, সুঁড়িঅলা, পাগড়ি জুব্বাঅলা মানুষ।

মহিষখোলা পেরিয়ে চৌরাস্তার দিকে এগোলেই দেখা যেত, ওয়ালাইকুম সালাম বলতে বলতে আব্বার মুখে ফেনা উঠে যেত। কারো কারো আবার করমর্দনে বাড়িয়ে দেয়া হাতটা আর ছুটতো না। বকবক পকপক করেই যেত তারা। কখন বাজারে যাব, বাজারের সবকিছু সবাই কিনে নিয়ে যাবে, সেই টেনশনে মনে মনে লোকগুলোর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতাম। সবসময় দেখতাম, এইসব নানান ধরনের লোকেরা সিও সাহেব সিও সাহেব করে আব্বাকে খাতির যত্ন করছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই একজন লোকের সাথে দেখা হতো, তিনিও আব্বাকে দেখে ফোকলা দাঁতে হেসে দিয়ে হাত এগিয়ে দিতেন ‘আরে সিও সাহেব যে, একটু বসে যান।’

এই লোকের বেলায় দেখতাম, আব্বা তার চেয়েও আন্তরিক ভঙ্গিতে বত্রিশ দন্ত বিকশিত করে তার আহ্বানে বসে যেতেন সেই সেলুনের চেয়ারে। সেখানে মাঝে মাঝেই সেই অদ্ভুত লোকটিকে দেখা যেত। সনাতন ধর্মের মালিকের সেই সেলুনটি ছিল চিত্রাবাণী সিনেমা হলের সামনে। সেখানে কালো আলখাল্লা পরা লম্বা মেয়েদের মতো চুলঅলা লোকটিকে ঘিরে জনাকয়েক লোকের আড্ডা চলতো। আব্বা মোটেই আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন না। কিন্তু টের পেতাম, এই লোকটিকে আব্বা একটু বেশি রকমের খাতির করতেন, তিনিও আব্বাকে। সে সময়টি ছিল আমার জন্য খুবই বিরক্তিকর, যতক্ষণ পর্যন্ত সাধু সুইটসের রসগোল্লা চমচম এসব প্লেটে করে সামনে আসতো।

সেলুনের দেয়ালে ঝুলানো শ্রীরাম কৃষ্ণের সাদাকালো ছবিটার দিকে তাকিয়ে অই ছবির লোকটি আর এই আলখেল্লা পরা লম্বাচুলের লোকটির মধ্যে কোনও যোগসুত্র আছে কিনা মেলাবার চেষ্টা করতাম। অই ছবিটি সব হিন্দুদের ঘরের দেয়ালে কেন থাকে, সেই জটিল অংকও মেলাতে পারতাম না। সেই সময় অইখানে কীসব কথা হতো, তাও মনে আছে। যা ছিল আমার কাছে নিতান্তই অর্থহীন। বিরক্তি চরমে যেত যখন অদ্ভুত লোকটি আমার কদম ফুল ছিলে ফেলা মাথায় হাত বুলিয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘মেয়েতো একটাই না? ছবি আঁকতে পারো তুমি?’

ছোটবেলায় মুখচোরা ছিলাম। কখনো হু-হা, কখনোবা শুধু টাক মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিতাম। আর এই সাপুড়ের মতো দেখতে লোকটার হাত থেকে কখন রক্ষা পাব, সেই চিন্তা করতাম। ‘একে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন, বাচ্চাদের সাথে বসে শিখে যাবে।’ আব্বাকে তিনি এই কথা বলতেই মনে মনে ভাবতাম, ‘ইস, এর কাছে কেন যাব? আমাদের মিনু স্যার কত সুন্দর ছবি আঁকেন!’ পরে তার ঐতিহাসিক বাড়িতে অনেকবার ঘুরতে গেলেও ছবি আঁকা শিখতে যাওয়া হয়নি। ছোট ভাই মাহমুদকে তার বন্ধু পরশ অনুরোধ করাতে সে কয়েকবার গেলেও কন্টিনিউ করেনি। পরশ রহমান করেছিল। সে আজ বেশ ভালো ছবি আঁকিয়ে হয়ে সুলতানের শিষ্যের মান রেখেছে। তবে তার সাথে এই সেলুনেই প্রথম দেখা নয়। সেটা ছিল রাজস্ব অফিস। তৎকালীন রাজস্ব কর্মকর্তা আব্বার রুমে বসে আছেন সেই আলখেল্লা পরা অদ্ভুত লোকটি। তার হয়ে আরো দুজন লোক আব্বার কাছে তদারকি করছেন তার কাজের।

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মাদ এরশাদ সুলতান সাহেবকে একটা জায়গাসহ বাড়ি উপহার দিয়েছেন। সেই বাড়ি তার নিজের করতে যেসব ভূমি বিষয়ক জটিলতা ছিল সেই কাজ মহা আগ্রহে করে দিলেন আব্বা। সেই দুজন লোক যারা সুলতানের হয়ে কাজ করছেন তারা আব্বাকে টাকা (মানে ঘুষ আরকি) সাধলেন। এরপর শান্ত আব্বার কাছে ‘ধ্যাৎ মিয়া আপনার সাহস কি’ বলে একটা ধমক খেলেন। আব্বার রুমের পিছনে ছিল গাদা গাদা ফাইলে ঠাসা একটা রুম। সেই রুমে ছিল একটা টাইপ রাইটার। আমি স্কুল ছুটি হলে প্রায়ই আব্বার অফিসে এসে পিছনের সেই রুমে বসে টাইপ রাইটারে খুটখাট করতে করতে নিজেকে অ্যাডভোকেট ওয়ালিউর রহমানের ব্যক্তিত্বে কল্পনা করতাম। তাকে দেখতাম পুরু চশমা পরে টাইপ রাইটারে কাজ করতেন। বেশ একটা জ্ঞানী জ্ঞানী লুক ছিল।

তো সেই রকমের একটা দিনে আব্বার অফিস রুমেই সুলতানকে প্রথম দেখি। তখনো জানি না উনি কে। পরে বাসায় বড়দের মুখে মুখে কিছু কমন গল্প শুনতাম উনাকে নিয়ে। ‘আরে এস এম সুলতানকে তো এরশাদ চেনে না, যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিগ্যান এরশাদকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমার বন্ধু সুলতান কেমন আছে?’ তখন তো এরশাদ রিগ্যানের সামনে ম্যা ম্যা করে কাটিয়ে দিয়েছে। পরে দেশে ফিরে এরশাদ সুলতানকে খুঁজে এই বাড়ি উপহার দিলো।’

তার সাথে শেষ দেখা হয় ৯১ সালে। বড় হয়ে গেছি। সেজেগুজে কোনও এক ঈদের ছুটিতে তার বাড়িতে গেলাম আব্বার সাথে। দলবলসহ বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখছি। ছোটখাট এক চিড়িয়াখানা। হরিণ, ছোট একটা বাঘ, পাখি, বনবেড়াল। একটা খাঁচায় বিশ-ত্রিশটা বিড়াল বন্দি ঘুরছে লেজ উঁচিয়ে। দেয়াল জোড়া ক্যানভাসে তার সেই বিখ্যাত মাসলম্যান কৃষকেরা। পালিত কন্যাদের বিরক্তিকর ‘কী চাই’ ভঙ্গির চাউনি। এই পালিত কন্যাদের নিয়ে নানান রূপকথা প্রচলিত ছিল। অবশেষে  একটি কক্ষে অসুস্থ শিল্পীর দেখা মিললো। তার পরের বছর বিশ্ব বরেণ্য এই শিল্পী কালের যাত্রায় অমরত্বের  পথে পাড়ি জমান।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক