শামীমা জামান

শামীমা জামান

শামীমা জামানের কলাম ‘এই আজরাঈল লীগকে থামান মাননীয়া’

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৮, ২০১৯

দিনে দিনে বহু বাড়িয়েছে দেনা
শুধিতে হইবে ঋণ।

খুব মারাত্মক ঘটনাগুলোর পরে আমি আসলে থমকে যাই। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটুকুও আসে না সকলের মতো। চুপচাপ ঘটনার আপডেট, জনতার ক্রোধ দেখতে থাকি। ইনবক্সে কেউ কেউ বলে যান, ‘এটা নিয়ে লিখছেন না যে।’ কাগজের মানুষেরা মৃদু অনুরোধ রেখে যান, ‘এ বিষয়ে একটা লেখা দিন।’ এরপর হয়তো নড়েচড়ে একটা কিছু লেখা হয়।

আসলে এসব আর লিখতে ইচ্ছে করে না। এসব থেকে পালাতে ইচ্ছে করে। ঘুম থেকে উঠে মিনিট পনের বিছানায় শুয়েই ফেসবুক ঘাটা হয় মনকে চাঙা করতে। অথচ নিউজ ফিডে ভেসে বেড়ায় আবরারের লালচে দেহ। ঠিক কতক্ষণ ধরে এই নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে বাচ্চাটাকে? বাচ্চাই তো। আবরারের মায়ের ছোট কোলের শিশুটি। কত যত্নে মা তাকে আগলে রেখেছিল!

স্বপ্নের বিদ্যাপীঠে পাঠিয়েছিল স্বপ্ন পূরণ করতে। মেধাবী আবরার মেধা তালিকায় তার নাম রেখেছিল। মেডিকেলে চান্স পেয়েছিল। পরমাণু বিজ্ঞানে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়েও সুযোগ পেয়েছিল যাবার। স্বদেশের মিছে মায়ায় সে হাতছানিতে পা বাড়ায়নি। দেশপ্রেম লালন করতো বলেই দেশের ক্ষতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যৌক্তিক বয়ান রেখেছিল। আর তাতেই কাল হলো!

কী এমন লিখেছিল সে! যে সত্যি বাঘা বাঘা কাগজের মানুষেরা পয়সার বিনিময়ে কিম্বা প্রাণের ভয়ে বলতে পারে না। কে হায় কবর খুঁড়ে সাগর-রুনী হতে ভালোবাসে! সেই সাধারণ কথাগুলোই সে বলে গেল প্রাণের বিনিময়ে!... “কাবেরী নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চায় না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দেব। কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে, অথচ আমরা তাদের গ্যাস দেব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে, সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব।

হয়তো এ সুখের খোঁজেই কবি লিখেছেন:
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি,
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।”

আহা! কত সুন্দর কত যৌক্তিক একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস। এই স্ট্যাটাসটি লেখার কারণে একটি মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে! এ কেমন দেশ? এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। কথার কথা ফাজলামি নয়, এই দেশ এখন হীরক রাজার দেশের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

ছাত্রলীগের একটি গৌরবোজ্জ্বল অতীত ছিল। না, সেই অতীত ইতিহাস ঘাঁটার বিন্দুমাত্র রুচি এখন নেই। গত কয়েক বছরে ছাত্রলীগের খুন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, রাজপথে প্রকাশ্য রক্তাক্ত খুনের ঘটনা— সবই প্রশ্রয় দিতে দিতে এই ছাত্রলীগ আজ আওয়ামী লীগ তথা স্বয়ং শেখ হাসিনার জন্য ফ্রাংকেনস্টাইন ছাড়া আর কিছু নয়। মাত্র দুদিন আগেও আশার আলো জেগেছিল জি কে শামীম ও সম্রাটদের মতো প্রভাবশালী মানুষদের গ্রেপ্তারের ঘটনায়।

আহা! আর কেউ না থাক, মায়ের মতো আমাদের একজন প্রধানমন্ত্রী আছেন, যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছেন। কিন্তু আসলেই কি তাই? ভারত প্রশ্নে সারাজীবনই কেন মেরুদণ্ডহীন থাকবে এ দেশ? দেশের স্বার্থ বড়, নাকি ক্ষমতায় থাকা বড়? আমার দেশের পরিবেশ বড়, না ব্যক্তিগত একটি নোবেল প্রাইজ বড়? বিশ্বজিতের খুনের বিচার ঠিকঠাক হলে আবরারের হত্যাকারীদের হাত কি একটু কাঁপতো না? ছাত্রলীগ জানে, তাদের সাত খুন মাফ। ছাত্রলীগ জানে, তাদেরই বাংলাদেশ। তারা এদেশে যা খুশি করার ক্ষমতা পেয়ে গেছে। এবং তা কত নির্মম নৃশংস নিপুণতায় তারা সম্পন্ন করে ত্বকীর লাশ আমাদের বলে গেছে।

ক্লাব কালচারে টর্চার সেল আজ একটা হেডমের ব্যাপার। ছাত্রলীগের এই নৃশংস মনোভাব নতুন নয়। মনে আছে বহু বছর আগে কোনো এক বৈধ নির্বাচনে আওয়ামী বিজয়ের দিনে ছাত্রলীগের পরিচিত ছেলেরা রামদা হকিস্টিক নিয়ে আনন্দ মিছিল করেছিল। মিছিল থেকে একটি লাইন ভেসে আসছিল বারবার, ‘রক্তের বন্যা বইয়ে দেব এবার...।’ আমার ফ্রেন্ডলিস্টের যেসব লীগার বন্ধুরা ছাত্রলীগের চামচামি করে ইনিয়ে বিনিয়ে মানুষকে রাজাকার বানিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছে তাদের বোধের জায়গাটি কোথায় নেমে গেছে ভেবে অবাক হচ্ছি। আবরারের মায়ের স্থানে নিজেকে বসিয়ে দেখুন, তারপরও যদি আপনি দলকানা হতে পারেন তবে আপনি ঠিক মানুষ নন, অন্য কিছু।

ভারতের বিপক্ষে কোনো কথা বলা যাবে না কেন? আমাদের অবস্থা হয়েছে সেই অসহায় রমণীর মতো যাকে তার ডান পাশের প্রতিবেশী ধর্ষণ করতে আসলে বাম পাশের প্রতিবেশী বন্ধুর হাত বাড়িয়ে তাকে রক্ষা করে। অতঃপর কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হয়ে রমণী সারা জীবন বাম পাশের প্রতিবেশীর বলাৎকার সয়ে যায়। বন্ধু বলে কথা! আবরার জীবন দিয়ে যে কথা বলে গেছে, চলুন দেশের স্বার্থে আমরা যখন যা বলা উচিত তা বলতে শুরু করি।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট