শামীমা জামানের গল্প ‘মরহুমা প্রিয়তমা’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৯

ব্যাপারটি মোটেই ভালো হলো না। ছি ছি, কী লজ্জা! এত গাধা কেন আমি! কেন নিজেকে এত বেকুব মনে হচ্ছে? আসলে আজকে আমার যাওয়াই উচিত হয়নি। কিন্তু টিউলিপকে আমি না বলতাম কি করে! ওর জন্মদিনে বন্ধুদের সবাইকে খাওয়াবে, সব আড্ডাতে উপস্থিত থেকে এটা বাদ দেই কি করে? সে যে মুখফোড় মেয়ে, ঠিক খোটা দিতে ছাড়ত না সবার সামনে, ‘এই ইয়ামিন, তুই না হয় আমার থেকে ধার নিয়ে একটা গিফট নিয়ে আসতি। তাই বলে গিফটের ভয়ে জ্বর বাধিয়ে ফেললি...।’ তাছাড়া এদিনটি ঘিরে সে কত দিনের প্রস্তুতি আমার। মায়ের দেয়া সামান্য হাতখরচ জমিয়ে রাখা গিফটের জন্য, আরচিস গ্যালারির সবচেয়ে বড় কার্ডটি কেনা, মায়ের পাজামা চুরি করে দর্জিকে দিয়ে ডিরেকশান দেয়া ঠিক এভাবে বানাবে মামু...। এত গিফট থাকতে দর্জির দোকান থেকে সালোয়ার কামিজ বানানো, এরও শানে নুজুল আছে বৈকি। আচ্ছা, তোরা এসব কি পরিস ঢোলা কোলবালিশ?

ওকে দোস্ত, তুমি যেই ডিজাইন পছন্দ করো আমারে একটা গিফট কইরো পরুমনে, ঠিকাছে? আমি কি সে কথা ভুলেছি, ঠিকই সেই অসাধ্য সাধন করেছি। কিন্তু সবই ঠিক ছিল মরার কবিতাটা কেন লেখতে গেলাম টিউলিপকে নিয়ে! এমনিতে একটু আধটু কবিতা লিখি বলে আমাকে নিয়ে ওদের টিটকারির শেষ নেই। ক্যাম্পাসে ঢোকা মাত্র সব হইহই ‘আইসা গেছে কবি মামু..., কুবি ...কুবি...। আনিসুল হকের একটা নাটকে জাহিদ হাসান কবির ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। ওরা আমায় নিয়ে অনেকটা অমন তামাশাই করে। আমি চুপচাপ মুখখানায় মিটিমিটি হাসি ধরে সব উপহাস মেনে নেই। বলে নে তোরা মন ভরে। ফেসবুকে লিখি, তামাশা তো করবিই। নেক্সট বইমেলায় বই বের করে তোদের এই রঙ্গ তামাশার জবাব আমি দিয়ে দেব। কিন্তু তাই বা পারছি কই! সেদিন এক প্রকাশকের কাছে গেলাম। পাণ্ডুলিপি না পড়ে চশমার উপর দিয়ে আপাদমস্তক খানিক দেখে বলল, ‘বুঝেছেন, পড়তে হবে অনেক, পড়ার বিকল্প নেই। পত্রিকায় লিখুন, হাত পাকা করুন। এরপর বই বের করবেন...’।

কষ্টে দুঃখে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল। আমি কি পণ্ডিত রাজ্জাক সাহেব, সারাজীবন শুধু পড়েই যাব, কিছুই লিখব না। এত পড়ার কি আছে! তবে আমি পড়ি তো। ক্লাসে সে যখন আচমকা রিনিঝিনি হেসে ওঠে, আমি সে হাসি পড়ি, চোখ পড়ি, চোখের কাজল পড়ি। নাকের বিন্দু বিন্দু ঘাম। যন্ত্র দিয়ে সোজা করা চুল, প্লাক করা ধনুক দুটো। আজকাল লেখাপড়ায় ফাঁকি হয়ে যাচ্ছে কি? কিন্তু তুমি সামনে থাকায় আমি অন্য কিছুতে কি করে মনোযোগ দেই! অতটা স্বার্থপর আমি হই কি করে! তুমি কি টের পাও দুহাত দূর থেকেও আমি তোমার চুলের ঘ্রান নি? কি শ্যাম্পু মাখো তুমি? ওতে কি সেডিল আছে? আমার চোখ মুদে আসে কেন! আজকাল তোমার আরাফের সাথে খুব মাখামাখি। বেশিরভাগ খাবারের বিল ও দেয় বলে কি তোমার এই প্রাঞ্জল কৃতজ্ঞতা?

স্টার কাবাবের চায়ে তুমি শব্দ করে চুমুক দাও আর আমি কি বসে থাকি, আমিও চুমুকে চুমুকে পান করে ফেলি তোমায়। অথচ তুমি দেখতে পাও সামনে একটা আবুল বসে চামুচ দিয়ে ফালুদা ঘুটছে। আর সব ডিজুস ওয়াটস আপ ব্রদের মাঝে আমি তোমার কাছে এক বোরিং সাদাকালো সত্যজিতের সিনেমা। ও হ্যাঁ, তুমি তো তাকেও ভালো করে চিনতে না। আমি চিনিয়েছি। হয়তো নিজেকে চেনাতে। বলি বলি করে কোনোদিনও সাহস করে যে কথাগুলো বলতে পারিনি, আজ এই বিশেষ দিনে বলব বলে তুলে রেখেছিলাম ঈদের নতুন জামার মতন যত্নে। সেই কবিতা হয়ে উঠল যখন ভরপেট না খেয়েও কেমন তৃপ্তির ঢেঁকুর উঠেছিল মনে। কিন্তু হায়! আরাফের ইশারায় নকীব যখন পাঠ করে শোনালো সে কবিতা, ততক্ষণে সকলের অট্টহাসিতে আমি বনে গেছি গরিব দেশের সেলিব্রেটি হিরো আলম। আমার খরগোশ দাঁতে তুমি খোঁজো তোমার বিনোদন। কিন্তু তবু কেন মনে হচ্ছে এই যে মেসেঞ্জারে কেবলই যে টুং টাং প্লুপ প্লুপ, এ তুমিই।

আমার বানানো থ্রিপিস পরে পিক দিয়ে বলছ, ‘কি আমাকে কি এবার ৯০ দশকের মেয়েদের মতো লাগছে?’ ওয়েট আ মিনিট মেয়ে আমি জাস্ট কফির মগটি ওভেনে দিয়ে আনব। তুমি জানো, ঈষৎ উষ্ণ কফিতে আমার চলে না। ক্যাফেইনের চনমনে ঘোরে আমি তোমায় ছোঁব।

কোথায় তুমি! এত কেবল তোমার নেইল আর্ট করা হাত। হাতে ওটা কি চকচক করে? উফ! আমিও না। আবার জিগায়। আরাফের হাতে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের প্যাকেট দেখেও বুঝিনি, তুমি হয়ে গেছ তার, হে মরহুমা প্রিয়তমা আমার!