শামীমা জামান

শামীমা জামান

শামীমা জামানের প্রবন্ধ ‘গল্পের কথা’

প্রকাশিত : আগস্ট ১৭, ২০২১

গল্পের কাছে চাওয়া। এই চাওয়া পাঠক হিসেবে এক রকম, আর লেখক হিসেবে আরেক রকম। একটা গল্প সত্যিকারের একটা ভালো গল্প হলো কিনা, সেটা গল্পটি পড়া শেষ হলে যেমন বোধগম্য হবে, গল্পের শুরুর বাক্যটিতেও তা হতে পারে। মর্নিং শোজ দ্য ডের মতো। বলা হয়, প্রথম বাক্যটি জাদুকরি। প্রথম বাক্যই গল্পের ভেতরে টেনে নেয়ার ক্ষমতা রাখতে সক্ষম বা অক্ষম।

তারও আগে কিম্বা যদি বলি সবকিছুর আগে ভাষা। লেখকের ভাষা এতটাই গুরুত্তপুর্ণ যে, তা একটি ভালো আখ্যানকেও যেমন সাদামাটা প্রতিবেদন করে দিতে পারে তেমনি আখ্যানহীন কোনো বোধকেও পরিপূর্ণ গল্পে রূপ দিতে পারে। ভাষা আসলে লেখকের মূলশক্তি। গল্প আপনি জীবন থেকে পাবেন, খবর থেকে পাবেন, কিম্বা নিজের কল্পনাশক্তিতেও তা আপনার লেখক হলে পাওয়ার কথা। কিন্তু আপনার ভাষা যদি শক্তিশালী না হয় তা আর যাই হোক, শিল্পরূপ পাবে না।

রবীন্দ্রনাথের গল্পের চমকপ্রদ সব আখ্যান আবার বলে ভিন্ন কথা। আখ্যান গল্পের প্রাণ। তবে সেই প্রাণে পানি সঞ্চার করে ভাষা। বড় গল্প তথা উপন্যাসিকায় যেমন আখ্যানের বিস্তারের সুযোগ থাকে, ছোটগল্পে সেই সুযোগটি ওভাবে থাকে না। সে হয়তো জীবনের একটি দিক বা অনুভুতিকেই প্রকাশ করতে পারে। বাকিটা না পারার মাঝে থাকে হাজারো আখ্যান। শরৎচন্দ্রেও আমরা আখ্যানের গুরুত্ব দেখতে পাই। তিনি তার গল্পের কলাকৌশলমূলক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, কতগুলি চরিত্র বেছে নেই প্রথমে, তারপর গল্প আপনি আসিয়া যায়।

চরিত্রের মনস্তত্ত্বই মহান গল্প হতে পারে। যেদিক দিয়ে সফলকাম হয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তার গল্পে চরিত্রের মনস্তত্ত্বই প্রধান গতি হয়ে এসেছে। সেখানেই আখ্যান খুলেছে। যদিও তার গল্পে নাটকের প্রাণ সংলাপের ভূমিকাও ব্যাপক। রবীন্দ্রনাথের সেই যে ছোট প্রাণ ছোট ব্যথার মাঝে গল্পের সংজ্ঞার সমস্ত উপাত্ত থাকলেও সময়ের বাঁকবদলে আজ তা অভিনব আঙ্গিকেও দেখতে ভালো লাগে। সমসাময়িক গল্পকার মোজাফফর আহমেদের এক্সপেরিমেন্টগুলো এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। বাঁকবদলের এ ধারা সব যুগেই ছিল বৈকি। তাই তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যয়ের নোটবইয়ে সেই সময়ের নতুন ছোটগল্প সম্পর্কে তার ভাবনাগুলো এভাবে পাওয়া যায়:

১. গল্প-অনেক পরিবর্তন-ছোটগল্প।
২. ঘটনাপ্রধান ছিল-এখন ঘটনা তুচ্ছ।
৩. স্থান কাল পাত্র।
৪. বর্তমান ছোটগল্পের প্রধান লক্ষণ-স্থানের সীমা, কালের সীমা, পাত্রের সীমা-আজ এই ঘটলো তারপর দশ বছর পরে, এই ধরনের টেকনিক প্রায় নয়-যত কম সময়ে যত কম চরিত্র এনে জীবনের একটা দিকের ছবি দেয়া যায়।
৫. শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প আরম্ভ থেকে শেষপর্যন্ত সময়ের ছেদ নেই, দু’মিনিট হোক দশ মিনিট হোক একটি মনের একটানা চিত্র-ইজিচেয়ারে বসে একজন ভাবছে তা অবশ্য নয়-অন্য চরিত্র ও ঘটনা থাকবে কিন্তু তার মনে যতটা থাকে।
৬. একটির বেশি মনের সাময়িক চিত্র দিলে বড় গল্প বা ছোট উপন্যাস হয়, ছোটগল্প হয় না।
৭. সময়টুকুর মধ্যে মনে যা নেই তার সামান্য বর্ণনাও থাকবে না-লেখক নিজে বলছে এমন কিছুই থাকবে না।

মানিক তার এই গল্প ভাবনা নিজের লেখায় প্রয়োগ করেছেন, সে কথা বলা বাহুল্য। প্রাগৈতিহাসিক বা সরীসৃপ গল্পে আরো নানা ব্যঞ্জনা থাকলেও অন্যান্য গল্প তিনি এ ছাঁচেই ফেলেছেন।

ভালো আখ্যান আর ডিটেইলস থাকলে গল্প সুখপাঠ্য হয় বটে। গল্প লেখার সময় যদিও খুব ভালো আখ্যান খোঁজার ইচ্ছা হয় না, গল্প তো চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। জীবন মানেই গল্প। বোধগুলো নিয়েই কাজ করা উচিত। গল্প তাতে কিছু একটা রয়েই যাবে। যখন সেখানে চেনা দেখা কোনো চরিত্রের অস্তিত্ব থাকে। চেনা চরিত্র নিয়ে কাজ করার একটা লাভ হচ্ছে গল্প আর নিজে থেকে কল্পনা করতে হয় না। নানান গল্প সেখানে খুব জলজ্যান্ত থাকে। হয়তো কিছু  রিপুও তাতে থাকে। যা একদম জমিয়ে দিতে পারে আখ্যানভাগ। চরিত্রের নামকরণও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ধরেন মেয়েটির বাড়ি গুলশান, ঢাকা শহরের রাস্তার আবর্জনা ধুলো উড়িয়ে সে অডি গাড়ি চালায়। আপনি তার নাম রাখলেন শাহেদা। অথবা মোহাম্মাদপুর শিয়া মসজিদের বস্তিতে বাস করা গার্মেন্টস কর্মীর নাম রাখলেন জারা।

এইসব ছোট ছোট জিনিস ও গল্পের ভিতরে মগ্ন হতে সময় ক্ষেপণ করিয়ে দেয়। ঠিক যেমনটা উত্তম পুরুষে লিখলে তাৎক্ষণিকভাবেই পাওয়া যায়। একটা বক্তব্য যে সব সময় ঠিক করে নিতে হবে, এমনও নয়। জীবনের কোন ছবিটি আঁকবেন, সেটুকু ঠিক করে নিলেই হয়। সেখানেও কোনো না কোনো বক্তব্য কিন্তু উপস্থিত হয়ে যাবে। তবে ভুলেও যেন লেখক নিজে উপস্থিত না হন।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যক